সাক্ষ্যে দাবি, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের এক গৃহকর্মী।
Published : 12 Jun 2023, 12:15 AM
বিদেশি নারী এনজিও কর্মীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের ‘সম্পর্ক’ নিয়ে বিরোধের জেরে মাহমুদা আক্তার মিতু ‘আত্মহত্যা’ করতে চেয়েছিলেন; ওই নারীর বাসাতেও সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তার যাতায়াত ছিল। আদালতে দুই সাক্ষীর সাক্ষ্যে এসব তথ্য উঠে আসে।
রোববার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম ফাতেমা এবং ওই নারী এনজিওকর্মীর গৃহকর্মী পম্পি বড়ুয়া সাক্ষী দেন। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তারা এসব তথ্য জানান।
এদের মধ্যে পম্পি বড়ুয়ার জেরা শেষ হয়েছে। মনোয়ারা বেগমের জেরা অসমাপ্ত রেখে রোববার দিনের কার্যক্রম শেষ হয়। সোমবার আবার তাকে জেরা করা হবে।
সাক্ষী মনোয়ারা বেগম বাপ্পী ওরফে ফাতেমা (১৮) কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানার রাজাখালী এলাকার মৃত আবদুল কাদেরের মেয়ে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বাবুলের সাবেক এ গৃহকর্মী বলেন, “ছোট থাকতে আমরা যেখানে থাকতাম তার পাশেই বাবুল আঙ্কেলের কোয়ার্টার। ২০১৩ সালে বাবুল আঙ্কেলের ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলা করতাম। তাদের সাথে থাকতাম। অনেক সময় রাতে ওই বাসাতে থাকতাম।
“তখন ওই বাসায় বিদেশি একজন মহিলা একাও আসত। ছেলেকে নিয়েও আসত মাঝে মাঝে। সারাদিন থাকত। বিকেলে চলে যেত। সেখানে বাবুল আক্তারের ব্যক্তিগত অফিস কক্ষে দুজন বসে কথা বলত। ওখানে আমরা যেতাম না।”
শৈশবে পিতামাতা হারানো মনোয়ারা আদালতকে জানান, বাবুল আক্তার কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে বদলি হলে তাকেও চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন।
সাক্ষ্যে মনোয়ারা বলেন, “চলে আসার এক সপ্তাহ পর বাবুল আঙ্কেলের সাথে মিতু আন্টির ঝগড়া হয় ওই বিদেশি নারীকে নিয়ে। এরপর উনারা দুজই একই বাসার পৃথক রুমে থাকত। বাবুল আঙ্কেল থাকত ছেলেমেয়েকে নিয়ে। অন্য রুমে আমি মিতু আন্টির সাথে থাকতাম।
“মিতু আন্টি রাগ করে বাসা থেকে চলে যেতে চাইত। এ রকম একদিন মিতু আন্টি চলে যেতে চাইলে ছেলে তার আব্বুকে বলল, ‘আম্মু চলে যাচ্ছে, নিয়ে আসো’। কিন্তু বাবুল আঙ্কেল যায় না। বসে থাকে। পরে আমি আর ওনাদের ছেলে গিয়ে আন্টিকে বাইরে থেকে নিয়ে আসি।”
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মনোয়ারা বলেন, “তারপর আন্টির (মিতুর) ব্যাগটা তার ছেলে খাটের নিচে রেখে দেয়। এরপর আন্টি কান্না করছিল। আঙ্কেল তখনও আসেনি। আমরা খেলা করছিলাম। তারপর আন্টি দরজা বন্ধ করে দেয়। তখন উনাদের ছেলে কান্না করে করে দরজা খুলতে বললেও আন্টি খোলেনি। পরে আঙ্কেল আসলে দরজা খোলে।
“তখন দেখি ওই রুমের ভিতর আন্টির গলার ওড়না ফ্যানের সাথে লাগানো। আঙ্কেল এসে সেটা খোলে। ছেলেটা কান্না করে ওর মাকে ধরে রাখে; বলে, ‘তুমি এরকম কাজ কেন করেছ?’। এরপর দুই দিন ভালো ছিল। তারপর আবার ওই বিদেশি মহিলাকে নিয়ে ঝগড়া হত।”
এরপর বাবুল আক্তার মিশনে যান জানিয়ে মনোয়ারা বলেন, “যাবার আগে থেকেই আঙ্কেলের রুমটা লক করা থাকত। তখনও ওই রুম বন্ধ ছিল। চাবি না থাকায় আন্টি রুমটা খুলতে পারেনি। বাথরুমে দরজার নষ্ট লক ঠিক করতে চাবিওয়ালা আসলে ওই রুমের জন্যও চাবি বানায়।
“খুলে দেখে সেখানে অনেক আবর্জনা। দুটি বইও পেয়েছে। বইতে ম্যামের (বিদেশি নাগরিক নারী এনজিও কর্মী) কিছু লেখা ছিল সেগুলো।”
মিশনে থাকা অবস্থায় বাবুল আক্তারের সঙ্গে একদিন তার ছেলে ভিডিওকলে কথা বলে জানিয়ে মনোয়ারা বলেন, “এরপর ওই মোবাইলটি (বাবুলের) দেখে আন্টি। তখন ওই মোবাইলে ম্যামের (বিদেশি নাগরিক নারী এনজিও কর্মী) কিছু এসএমএস ও ছবি দেখতে পায়। ওই লেখাগুলো আন্টি লিখে রাখে উনার ছেলের ড্রইং খাতায়।”
এর বেশকিছু দিন পর বাবুল আক্তার ঢাকায় চলে যান উল্লেখ করে মনোয়ারা বলেন, “ঢাকা যাবার তিন দিন পর আন্টির ফোনে একটি মেসেজ আসে। এরপর বলে, ছেলের স্কুলে একটু আগে যেতে হবে। তখন অন্য ভাবীদের ফোন করে জিজ্ঞেস করে তাদের ফোনে মেসেজ এসেছে কি না? কাল কি স্কুলে যেতে হবে? তারা বলে যে, মেসেজ আসেনি। আসতে পারে।
“পরদিন ওই মেসেজ ঠিক মনে করে আন্টি আগেই ছেলেকে নিয়ে স্কুল বাসে তুলে দিতে যায়। এর ১০-১৫ মিনিট পর একজন সিকিউরিটি উপরে আসে। এসে বলতেছে, বাসায় কেউ আছে? কিছুক্ষণ পর উনাদের ছেলে আসে। ও তখন কান্না করছিল। ওর জুতায় ও পোশাকে রক্ত ছিল। আমাকে বলল, আমার আম্মু তো রাস্তায় পড়ে আছে, কেউ হাসপাতালে নিচ্ছে না।”
ঘটনার দিন বাবুল আক্তারকে তার ছেলে তিনবার ফোন দেয় জানিয়ে মনোয়ারা আদালতে বলেন, “তিনবারই কেটে দেয় বাবুল আঙ্কেল। তারপর ছেলেটা তার নানা-নানিকে ফোন দেয়। কান্নার জন্য ও ফোনে কথা বলতে পারেনি। পাশের বাসার মহিলা এসে ফোনে ওর নানীকে বলে আপনাদের মেয়ে সিলিন্ডারে এক্সিডেন্ট করেছে। তাড়াতাড়ি আসতে হবে।
“উনারা আসার পর মিতু আন্টিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যায়। আমি উনাদের সাথে চলে যাই। এরপর ঢাকায় ছেলেটা নানা-নানির কাছে চার বছর ছিল। তারপর বাড়ি চলে যাই।”
এরপর কাঠগড়ায় থাকা বাবুল আক্তারকে শনাক্ত করেন মনোয়ারা বেগম ফাতেমা।
আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার পর বাবুলের আইনজীবীদের জেরার সময় মনোয়ারা জানান, তিনি ঘটনার আগে পরে মিলিয়ে মোট সাত বছর বাবুল আক্তার ও পরে মিতুদের বাসায় ছিলেন। পরে ঢাকার রমনায় আরেক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় ছিলেন। বর্তমানে মনোয়ারা বোনের সাথে গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
মিতু হত্যার পর একবার চট্টগ্রামে এসে পুলিশের কাছে এ বিষয়ে জবানবন্দি দেয়ার কথা জানালেও সেই সময় কখন তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি মনোয়ারা।
জেরায় বাবুলের আইনজীবী প্রশ্ন করেন, “বাবুল আক্তারের ওই বিদেশি বান্ধবীকে দেখেছেন কখনও? উনি দেখতে কেমন? উনার স্বামী ও ছেলেকে দেখেছ?”
জবাবে মনোয়ারা বলেন, “হ্যাঁ দেখেছি। উনি একটু খাটো ও মোটা। ছেলেকে দেখেছি, স্বামীকে দেখিনি।”
আইনজীবী প্রশ্ন করেন, “তোমার মিতু আন্টি কখনও তোমাকে ওই বান্ধবীর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন? মিতুর সাথে ওই বান্ধবীর সম্পর্ক কেমন ছিল? আসলে কতক্ষণ থাকতো?”
জবাবে মনোয়ারা বলেন, “না। তবে উনি আসতো। সম্পর্ক ছিল। প্রথমে আসলে কথা বলতো। পরে বাবুল আংকেলের সাথে পারসোনাল রুমে কথা বলতো। আসলে দুপুরের লাঞ্চ করে যেত। উনার ছেলেও থাকতো।”
আইনজীবী প্রশ্ন করেন, “আপনি আগে যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেখানে ওই বিদেশি বান্ধবীর কথা বলেন নাই?”
জবাবে মনোয়ারা বলেন, “বলেছি। যারা জিজ্ঞেস করেছে সবার কাছেই বলেছি।”
২০১৬ সালে মিতু খুন হওয়ার পর তার স্বামী, সে সময়ের পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার বাদী হয়ে এ মামলা করেছিলেন। নানা নাটকীয়তা শেষে পিবিআইয়ের তদন্তে এখন তিনিই এ মামলার আসামি।
মামলার বাকি আসামিরা হলেন- মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা ও খায়রুল ইসলাম।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এসপি বাবুল তার কিছুদিন আগেই চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে ছিলেন। বদলি হওয়ার পর তিনি ঢাকায় কর্মস্থলে যোগ দিতে যাওয়ার পরপরই চট্টগ্রামে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
নারী এনজিওকর্মীর গৃহকর্মীর সাক্ষ্য
রোববার সাক্ষ্য দেওয়া আরেকজন পম্পি বড়ুয়ার (২৪) বাড়ি কক্সবাজারের রামুতে। তিনি কক্সবাজারের থাই সোশাল ফাউন্ডেশনের ক্লিনার হিসেবে কর্মরত আছেন।
পম্পি বড়ুয়া আদালতে সাক্ষ্যে জানান, ২০১৩-১৪ সালে তিনি ওই নারী এনজিও কর্মীর বাসায় কাজ করতেন।
পম্পি বড়ুয়া আদালতে বলেন, “উনার (ওই নারীর) ছেলেকে দেখাশোনা করতাম। তাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতাম। উনার স্বামী বিদেশে থাকতেন বলে জানি। সাহেব না থাকলে মাঝে মাঝে সেখানে থাকতাম। সাহেব না থাকলে প্রায় সময় ম্যাডামের এক বন্ধু আসত। দেখতাম।
মিতু হত্যা: গ্রেপ্তার আসামি কালু কারাগারে
বাবুলের পরকীয়ার জেরে টাকা দিয়ে খুন, প্রথম সাক্ষ্যে অভিযোগ মিতুর বাবার
খুনের সুযোগ ২ বছর ধরে খুঁজছিলেন বাবুল, অভিযোগ মিতুর বাবার
মিতু হত্যা: বাবুলের বর্তমান স্ত্রী মোশাররফের বাসায় গিয়েছিলেন ডিসেম্বরে
“যখন ওই বাসায় যেত, তখন উনাকে চিনতাম না। লম্বা ও শ্যামলা ছিল। পরে টিভিতে দেখে চিনেছি। তিনি বাবুল আক্তার। ম্যাডামের বাসায় মাঝে মাঝে আসত সন্ধ্যার পর। রাতে থাকত। তবে কখন চলে যেত- জানতাম না। আমি আমার রুমে থাকতাম। মিতু হত্যার পর টিভিতে দেখে চিনেছি উনি বাবুল আক্তার।”
এরপর পিপি আবদুর রশিদ জানতে চান, “টিভিতে যাকে দেখতেন, তিনি কি এখানে আছেন?”
জবাবে পম্পি বড়ুয়া বলেন, “হ্যাঁ, কালো পাঞ্জাবি ও চশমা পড়া।”
সাক্ষ্যে পম্পি বড়ুয়া বলেন, “ম্যাডাম (নারী এনজিওকর্মী) আমাকে মেয়ের মত আদর করতেন। তিনি চলে যাবার পর আমাকে নাইজেরিয়া নিয়ে যান ছয় মাসের জন্য, বেড়াতে। উনি এখানে থাকতেই পাসপোর্ট করে দেন। আমাকে টাকা দিয়ে যান। আমি একাই যাই। ম্যাডাম চলে যাবার ৬-৭ মাস পর যাই।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানতে চান, “ওই বিদেশি নারীর সাথে এখন যোগাযোগ আছে কি না? কতদিন যোগাযোগ ছিল?”
জবাবে পম্পি বড়ুয়া বলেন, “এখন নেই। চলে যাবার পর দুয়েক বছর ছিল।”
এরপর জেরায় বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “ওই নারী চলে যাবার পর কতদিন যোগাযোগ ছিল?”
মিতু হত্যায় স্বামী বাবুল আক্তারের বিচার শুরুর আদেশ
মিতু হত্যা: বাদী বাবুল আক্তার যেভাবে আসামি
মামলায় যে অভিযোগ দিলেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর
জবাবে পম্পি বড়ুয়া বলেন, “২০১৫-১৬ সালের দিকে বিদেশ থেকে আমি ফেরার পর ২/৩ বার টেলিফোনে কথা হয়।”
কফিল উদ্দিন বলেন, “ওই নারীর সাথে ছিলেন, ছেলেকে আনা-নেওয়া করতেন, তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক। এসবের কোনো স্মৃতি আছে?”
জবাবে পম্পি বলেন, “আমার কাছে কোনো ছবি নেই। তখন আমার টাচ মোবাইল ছিল না।”
এরপর আইনজীবী কফিল প্রশ্ন করেন, “পুলিশ প্রথম কখন আপনাকে নিয়ে আসে?”
জবাবে পম্পি বড়ুয়া বলেন, “২০২২ সালের জানুয়ারিতে আমাদের বাড়ি থেকে। তারপর রামু থানায় নেয়। সেদিন ফারুক স্যার চট্টগ্রামে আনে। সেদিনই জবানবন্দি দিই। সেদিনই জবানবন্দি দেওয়ার পর ছেড়ে দেয়।”