মিতু হত্যা: বাবুলের বর্তমান স্ত্রী মোশাররফের বাসায় গিয়েছিলেন ডিসেম্বরে

“মুছা, বাবুলের সোর্স এই কথা পিবিআই শেখায়নি,” বলেন মিতুর বাবা মোশাররফ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2023, 04:44 PM
Updated : 22 May 2023, 04:44 PM

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার গ্রেপ্তারের পর গত ডিসেম্বরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের বাসায় গিয়েছিল তার দুই নাতি-নাতনি ও বাবুলের বর্তমান স্ত্রী।

সেদিন ছিল মিতু-বাবুল দম্পতির মেয়ের জন্মদিন। এর পরদিন মোশাররফ হোসেনের বাসায় বাবুলের এক ভাই, ভাবি ও বাবুলের বোনও গিয়েছিল বলে জেরার জবাবে তিনি আদালতে জানিয়েছেন।

সোমবার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে পঞ্চম দিনের মত তাকে জেরা করা হয়।

বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন জেরায় বলেন, “ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, লালন-পালন, লেখাপড়াসহ সব দায়িত্ব পালন কঠিন হওয়ায় মিতুর মৃত্যুর চার বছর চার মাস পর ২০২০ সালের অক্টোবরে বাবুল আক্তার একজন বিধবা মহিলাকে বিবাহ করেন। শর্ত অনুযায়ী তারা এই সংসারে কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। বিবাহের শর্ত ছিল যে, বাবুলের ছেলেমেয়েরা যেদিন তার প্রতি অসন্তুষ্ট হবে, সেদিনই তালাক হবে। তিনি বাবুলের স্ত্রী হিসেবে অদ্যবধি আছেন। বাবুলের সন্তানরা তাকে ‘মা’ ডাকে?”

জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমার জানা নেই।”

আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “বাবুলের বর্তমান স্ত্রী আপনাকে বাবা ডাকে।”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “ইহা সত্য নহে।”

এরপর আইনজীবী কফিল উদ্দিন একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, “২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাবুলের মেয়ের জন্মদিনের দিন বাবুলের ছেলে-মেয়ে ও বর্তমান স্ত্রী আপনার ঢাকার বাড়িতে গিয়েছিল। আপনারা একসাথে জন্মদিনের কেক কাটেন। এই সেই ছবি, যাতে আপনার স্ত্রীও আছেন সবার সাথে।”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “সেদিন নাতনির জন্মদিন ছিল। বাবুলের বর্তমান স্ত্রী মোবাইলে ফোন করে মিতুর ছেলেকে আমার সাথে কথা বলতে দেয়। তারাই ফোন করে এসেছিল। পরদিন বাবুলের ভাই, তার স্ত্রী ও বাবুলের বোন আসে আমার বাসায় কেক নিয়ে।”

যেদিন মিতু-বাবুলের সন্তানরা তার বাসায় গিয়েছিল, সেদিন তারা রাতে সেখানে ছিল কি না জানতে চাইলে মোশাররফ বলেন, “ছিল কি না স্মরণে নেই। পরে আরও একবার তারা এসেছিল।”

এর আগে ২০২১ সালের ১২ মে বাবুলসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন মোশাররফ। সেই মামলায় তখন বাবুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দীর্ঘদিন ধরে মোশাররফ হোসেন দাবি করছেন, মিতুর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। নাতি-নাতনিদের নিজের হেফাজতে চেয়ে আদালতে আবেদনও করেছেন মোশাররফ।

সোমবারের জেরায় কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “যখন আপনার বাসায় গিয়েছিল, ওই সময় বাবুলের দুই সন্তান বলে- ‘নানু, আপনিই তো শিখিয়েছেন; বাবাই আমাদের মা-বাবা দুটোই। এখন কেন বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন?’ তখন আপনি তাদের বলেন, ‘ভাই তোমরা বুঝবে না। কঠিন চাপে আছি। তোমাদের বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষী না দিলে আমি ও তোমাদের নানু দুজনই জেলে যাব, পরিবারটা ধ্বংস হয়ে যাবে’।”

জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, “এরকম কিছু বলিনি। ইহা সত্য নয়।”

জেরায় মোশাররফ-বাবুলের ‘সম্পদ’

জেরায় বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রশ্ন করেন, “আপনি পুলিশে কর্মজীবন কোন পদে শুরু করেন।”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “এটা বলতে চাই না। খুনের ঘটনার সাথে রিলেটেড প্রশ্ন করেন। ব্যক্তিগত আপত্তিকর বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিব না।”

এরপর জেরায় আইনজীবী জানতে চান, “ঢাকার মেরাদিয়ায় ১৮ কাঠা জমির উপর মোশাররফ হোসেন ও তার স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে কি না এবং সেখানে ৫-৬০টি ভাড়া ঘর আছে কি না? পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে তিন তলা দালান ও ঝালকাঠি শহরে কোটি টাকার সম্পদ আছে কি না?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “১৮ কাঠা জমির কথা সঠিক নয়। বাড়ি আছে। কিছু ভাড়া ঘর আছে, তবে অতগুলো নয়। গ্রামের বাড়ি দুই তলা। ঝালকাঠি শহরে সম্পদ আছে, কোটি টাকার নয়।”

এরপর কফিল উদ্দিনের প্রশ্ন ছিল, “বাবুল আপনার ঢাকার বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর বাবুলকে ও আপনার পরিবারকে ধ্বংসের পরিকল্পনাকারীরা আপনাকে কব্জা করে। তারা আপনাকে ভয়ভীতি দেখায় যে, তাদের প্রস্তুতকৃত কাগজে সাক্ষর না করলে আপনার কর্মজীবনে অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদের জন্য আপনি ও আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা দেবে। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে?”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “এসব সত্য নহে।”

বাবুলের আইনজীবী বলেন, “২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি ও ৬ মে দুই দফায় পিবিআই সদর দপ্তরে নিয়ে আপনাকে ধমক দেয়। পরে ওই বছরের ৯ মে আবার সেখানে গিয়ে রাজি হন। সে অনুযায়ী পিবিআই চট্টগ্রাম অফিসে চলে আসেন এবং এক সপ্তাহ থেকে বাবুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ জোগাড় করেন?”

মোশাররফ বলেন, “সত্য নহে”।

আইনজীবী প্রশ্ন করেন, “দুদকের মামলায় জড়ানোর হুমকিতে বিনা কারণে বাবুলকে মামলায় জড়িয়ে আপনি তাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন?”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “সত্য নয়।”

এরআগে আইনজীবী কফিল উদ্দিন বাবুলের শ্বশুর মোশাররফকে বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের কোনো শহরে বাবুলের কোথাও কোনো বাড়ি বা সম্পদ নেই।”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “মাগুরা শহরে, চট্টগ্রাম সিটির মধ্যে, ঢাকায় ও শৈলকূপায় সম্পদ আছে। চট্টগ্রামের ওখান থেকে ঘর ভাড়াও পায়। এখনই ঠিকানা দিতে পারছি না, পরবর্তীতে উপস্থাপন করব।”

আইনজীবী বলেন, “আপনি দেখাতে পারবেন না, তাই ঠিকানা দিতে পারছেন না। তার কোনো সম্পত্তি নেই।”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “ইহা সত্য নয়।”

পিবিআই প্রসঙ্গ

আইনজীবী কফিল বলেন, “বাবুলের মামলা তদন্ত করতে কোন দরখাস্ত পিবিআইতে দিয়েছিলেন? কিভাবে মামলা পিবিআইতে আসল?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “দরখাস্ত দিইনি, আদালতের নির্দেশে পিবিআইতে আসে বলে জানি।”

Also Read: মামলা করার এক সপ্তাহ আগে বাবুলের ‘সম্পৃক্ততার প্রমাণ পান’ মিতুর বাবা

পাঁচলাইশ থানায় মামলা করার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) কবিরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জানিয়ে আইনজীবী প্রশ্ন করেন, “আইও পরিবর্তনের জন্য কোথাও আবেদন করেছিলেন?” ‍

উত্তরে মোশাররফ জানান, তিনি কোনো আবেদন করেননি।

কফিল উদ্দিন বলেন, “আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছাকে বাবুলের দীর্ঘদিনের সোর্স বলেছেন। কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে পারবেন?”

মোশাররফ বলেন, “না, আমার কাছে নেই।”

এরপর আইনজীবী বলেন, “মুছা ছিল পিবিআই’র প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের সোর্স। মুছা, বাবুলের সোর্স এই কথা বনজ কুমার আপনাকে শিখিয়েছে এবং আপনার এজাহারে লিখেছেন?”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “শিখিয়েছেন, এটা সত্য নয়। তবে এজাহারে মুছা বাবুলের সোর্স, সেটা লিখেছি।”

আইনজীবী কফিল বলেন, “মুছা বাবুলের সোর্স, এটা মিতু হত্যার ঘটনার পর থেকে বনজ কুমার প্রচার করেন।”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “সত্য নয়।”

‘ক্রসফায়ার’ ও মুছা-কালু প্রসঙ্গ

বাবুলের আইনজীবীর জেরা শেষে অন্য ছয় আসামির পক্ষে তাদের আইনজীবীরা জেরা করেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনকে।

জেরায় আসামি মোতালেব মিয়া ওয়াসিমের আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, “২০১৬ সালের ২১ জুন ওয়াসিমের সাথে রাশেদ ও নুরন্নবী নামের দুজন, তাদের মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানসহ গ্রেপ্তার করে দামপাড়া পুলিশ লাইনের ট্রেনিং সেন্টারের গোপন কক্ষে আটকে রাখা হয়। আইও তাদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে চাপ দেয়। রাজি না হওয়ায় রাশেদ ও নুরন্নবীকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়।”

জবাবে এসব বিষয়ে তার জানা নেই বলে জানান সাক্ষী মোশাররফ।

আইনজীবী কামাল বলেন, “এরপর ওয়াসিম ও তার স্ত্রীকে একসাথে বসিয়ে বলা হয়, জবানবন্দি না দিলে তাকেও ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। ৫ দিন আটকে রেখে ২০১৬ সালের ২৬ জুন ওয়াসিমের জবানবন্দি নেওয়া হয়।”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “জানি না।”

পলাতক আসামি মুছা ও কালুর পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী (এসডিএল) টি আর খান জেরায় প্রশ্ন করেন, “মুছা ও কালু জীবিত না মৃত?”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “যতটুকু জানি, জীবিত।”

ওই আইনজীবী আবার প্রশ্ন করেন, “মুছা ও কালুর সংশ্লিষ্টতার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা আপনি দেখেননি? আইও’র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের মামলায় সম্পৃক্ত করেছেন?”

‍উত্তরে মোশাররফ বলেন, “তাদের দেখিনি, শুনেছি। প্রভাবিত হওয়ার কথা সত্য নয়।”

জেরা শেষে রাষ্ট্রপক্ষে মামলায় সাক্ষী মোশাররফের উপস্থাপিত আলামত পরীক্ষার জন্য পুনঃতলবের আবেদন করে। আদালত তা মঞ্জুর করে মঙ্গলবার এ বিষয়ে শুনানির দিন ঠিক করেন।