ইসকন চট্টগ্রাম পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময়কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী বলেন, “আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বললে আমাদের উগ্রবাদী আখ্যা দেওয়া হয়, আওয়ামী লীগ ও ভারতের দালাল বলা হয়।”
Published : 13 Sep 2024, 09:53 PM
সারা দেশে মঠ মন্দিরে হামলা ও ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতন বন্ধসহ আট দফা দাবিতে চট্টগ্রামে বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমাবেশ করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
শুক্রবার বিকালে নগরীর জামালখান মোড়ে এ সমাবেশ থেকে সারা দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
ইসকন চট্টগ্রাম পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময়কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী সমাবেশে বলেন, “আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বললে আমাদের উগ্রবাদী আখ্যা দেওয়া হয়, আওয়ামীলীগ ও ভারতের দালাল বলা হয়। নিজেদের মন্দির বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে আমাদের মসজিদে আক্রমণকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাহলে আমরা কোথায় নিরাপদ?”
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠা মুহাম্মদ ইউনুসের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনি যদি আপনার ঘরের মানুষকে রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে সারা দেশের মানুষ কীভাবে নিরাপদ হবে?”
বিভিন্ন মঠ মন্দিরের সাধু সন্যাসীদের অগ্রভাগে রেখে এবং তাদের মতামতকে সামনে রেখে হিন্দুদের অধিকার ও দাবি বাস্তবায়েনের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান চিন্ময়কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী।
ঠাকুরগাঁ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিশোর নিহতের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “তারা কেন সীমান্তে গিয়েছিল সেটা আগে খুঁজে নিন। এখানে জীবন মৃত্যুর প্রহসন তারা মেনে নিতে পারেনি। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিগত সময়ে যারা বাংলাদেশ থেকে ভারত কিংবা অন্যদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের কাউকেতো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়নি।
“একজন উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ। তাকে আমি বলতে চাই, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন আমরা কত ভালো আছি… ।চার হাজার একর সম্পত্তি এখন দুই হাজার একর হয়েছে। জাতীয় তীর্থের যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে সাধারণ হিন্দুদের কী অবস্থা! আপনারা বুঝতে পারছেন?”
সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত ১০৬৮টি মন্দিরে হামলার খবরের প্রসঙ্গ টেনে চিন্ময়কৃষ্ণ বলেন, “গত সরকারের আমলে এ প্রথম আলোকে প্রগতিশীলতার প্রতীক বলতেন। এখন প্রথম আলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এক হাজার ৬৮টা ঘটনা উপস্থাপন করেছে। মঠ মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার তথ্য দিয়েছে। কিন্তু আজকে কেন প্রথম আলোর প্রতিবেদন আমলে নিচ্ছেন না?”
দুর্গা পূজার আগে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মঠ মন্দিরে হামলার ক্ষয়-ক্ষতি নিনূপন করে প্রজ্ঞাপন জারি এবং পূজার ছুটি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে পুণ্ডরিক ধাম অধ্যক্ষ বলেন, “আগামী ১৫ দিন দেখব। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনুরোধ করব তা নিশ্চিত করুন। যদি তা না হয়, গণ অনশন, অবস্থান কর্মসূচি করব। আমরা ঘরে ফিরে যাব না।”
২০২১ সালের দুর্গা পূজার সময় কুমিল্লায় কথিত কোরআন আবমাননার অভিযোগ তুলে সারাদেশে হিন্দুদের মঠ মন্দিরে হামলার প্রসঙ্গ টেনে চিন্ময়কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী বলেন, “আমরা তখন আন্দোলন করেছিলাম। সরকারি, বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দল আমাদের এখানে এসে সংহতি জানিয়েছিল। আমরা আমাদের অধিকারের জন্য কথা বলেছি। বিচার ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখার জন্য আমরা আন্দোলন করেছি।
“আজকে ২১ সাল থেকে ২৪ সাল এল, নতুন সরকার দায়িত্ব নিল, কই ২১ সালের ঘটনার জন্যতো কোনো কমিশন হয়নি? তাহলে আমরা কী বুঝব? আপনারা সকলে পরস্পরের মাসতুত ভাই। এ জন্য একজন আরেক জনকে রক্ষা করতে চান। আপনারা যেহেতু পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলে আপনারা ২১ সালের ঘটনা নিয়ে কমিশন গঠন করুন, বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।”
বিভিন্ন সময়ে ধর্ম অববমাননার অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন চিন্ময়কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী।
তিনি বলেন, “আমাদের ভাইয়েরা যখন কোনো উসকানিমূলক কমেন্টেসের উত্তর দেয়, তখন তাদের ধর্মীয় অবমাননার অজুহাতে মামলা দেওয়া হয়। নির্যাতন করা হয়।
“খুলনার উৎসব মণ্ডলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ম অবমাননার অজুহাতে আইসিটি অ্যাক্টে যাদের অ্যারেস্ট করে নির্যাতন করা হয়েছে, বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচার করতে হবে।”
চিন্ময়কৃষ্ণ বলেন, “প্রতিটা ধর্মের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল, আমরা সম্মান করি। বাংলাদেশে মসজিদ, মাজারে হিন্দুদের ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু আমাদের ধর্মকে নিয়ে যখন অবমাননা করে, আমাদের দেবতা নিয়ে যখন ওয়াজ হয়, উসকানি দেয়া হয়, তখন ধর্ম অবমাননা হয় না, মামলা হয় না।”
সম্প্রতি নগরীর একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “পুলিশ প্রশাসন বলছে, ওই দিনের ঘটনায় কেউ অভিযোগ করে নাই। কিন্তু অনেক ঘটনায় প্রশাসন নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছে, কিন্তু হিন্দু ধর্মের বেলায় তাদের বাদী বানিয়ে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই সব চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।”
সংখ্যালঘুদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন বরাদ্দের দাবি করে চিন্ময়কৃষ্ণ বলেন, “আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি আমরা করতে চাই না। আমাদের দলীয় ট্যাগ দেওয়ার জন্য প্রতিটি নির্বাচনের পরে আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। কোনো হামলার বিচার হয় না।
“সংরক্ষিত আসন চাই। হিন্দুদের ভোট হিন্দুরা দেবে, তাদের প্রতিনিধি তারাই নির্বাচন করবে। আমাদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ কেউ পাবে না।”
চট্টগ্রাম নগরী ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ বৃষ্টি উপেক্ষা করে জামালখান মোড়ের এ সমাবেশে যোগ দেন। তাদের ভিড় চোখে পড়ে জামালখান মোড় থেকে চেরাগীপাহাড় মোড় পর্যন্ত। বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের সাধুরাও সমাবেশে বক্তব্য দেন।