মারধরে নিস্তেজ হয়ে পড়া শাহাদতের সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য লোকজনকে ডাকাডাকি করছিল এক কিশোর।
Published : 25 Sep 2024, 06:06 PM
চট্টগ্রামে সড়কে গান গাইতে গাইতে শাহাদাত নামের যে যুবককে পিটিয়ে মারা হয়েছিল তাকে ছিনতাইকারী সন্দেহে ধরা হয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শাহাদাতকে মারধর করার ভিডিও একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আপলোড করে আরও লোকজনকে মারধর করতে আসারও আহ্বান জানানো হয়েছিল।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এক কিশোরসহ তিন জনকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে নগর পুলিশের পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী জুয়েল (৪২), আনিসুর রহমান ইফাত (১৯) ও অপরজন ১৬ বছর বয়সী কিশোর।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘চট্টগ্রাম ছাত্র-জনতা ট্রাফিক গ্রুপ' নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে মারধরকারীদের শনাক্ত করে ধরা হয়েছে।
এ গ্রুপেই শাহদাতকে মারধরের ভিডিও পোস্ট করেছিলেন মারধরকারীরা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রেপ্তার ফরহাদ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিন ফরহাদ। তিনিই হত্যাকাণ্ডের ‘মূলহোতা’। মঙ্গলবার বিকালে ষোলশহর বিপ্লব উদ্যান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে তার দেয়া তথ্যে জেলা শিল্পকলা একাডেমি এলাকা থেকে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে এবং রাত ৯টার দিকে ষোলশহর মসজিদ গলি এলাকা থেকে আনিসুর রহমান ইফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের ভাষ্য, গ্রেপ্তাররা প্রাথমিকভাবে এ গণপিটুনির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
ভিডিও পোস্ট করে সবাইকে মারধরে অংশ নেওয়ার আহ্বান
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তারেক আজিজ বলেন, “‘চট্টগ্রাম ছাত্র-জনতা ট্রাফিক গ্রুপ' নামে হোয়াটস আপ গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা ১৩০ জন। শাহাদাতকে মারধরের ভিডিও গ্রুপটিতে পোস্ট করা বলা হয়েছিল মোবাইল ছিনতাইকারী ধরা হয়েছে। তাকে মারধর করতে সবাইকে আসাতে বলা হয়েছিল ওই গ্রুপে।
“শাহাদাতকে যারা মারধর করেছিল তাদের সাথে তার পূর্ব পরিচয় ছিল না। শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে তাকে মারধর করে তাকে হত্যা করা হয়।”
মারধরে ২০ জনের বেশি জনের সম্পৃক্ত থাকার কথা জানিয়ে তারেক আজিজ বলেন, “গ্রুপের অ্যাডমিন ফরহাদের নেতৃত্বে শাহাদাতকে দফায় দফায় মারধর করা হয়েছিল। কেউ এসে মারধর করে চলে গেছে আবার নতুন করে কেউ এসেছিল। অনেকের পরিচয় আমরা শনাক্ত করেছি। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে সেগুলো প্রকাশ করছি না।
“গ্রেপ্তার কিশোর মারধরের সময় শাহাদাত যখন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল তখন তার গাল চেপে ধরে বলতে থাকে ‘এ ভাইয়া সবাই একটা সেলফি তুলে যান’।”
যেভাবে পাওয়া যায় শাহাদাতের লাশ
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর গত ১৩ অগাস্টের রাতে শাহাদাতকে যখন মারধর করা হয়, সেসময় থানায় পুলিশ থাকলেও তাদের তেমন সক্রিয়তা ছিল না।
১৪ অগাস্ট প্রবর্তক মোড়ের অদূরে সিএসসিআর হাসপাতালের বিপরীতে বদনা শাহ মাজারের সামনের সড়কে রাস্তায় শাহাদাত হোসেনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন সেখানে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারী রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা।
তারাই প্রথমে লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। পরে পুলিশ খবর পেয়ে মেডিকেলে যায় ও পরবর্তী আইনি কাজ সারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাশের ছবি দেখে পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহাদাতের পরিচয় শনাক্ত করে।
পুলিশ বলছে, ১৩ অগাস্ট রাতে শাহাদাতকে মারধরের পর তার মৃত্যু হয়। ওই দিন রাতেই তার লাশ প্রবর্ত্তক মোড়ে কাছে বদনা শাহ মাজারের সামনে সড়কে লাশ ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল।
এক মাস পর মারধরের ভিডিও ভাইরাল
গত ১৮ সেপ্টেম্বর সম্প্রতি মোবাইল চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে এবং তার আগে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে ‘গণপিটুনির’ ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়।
এরপর ২১ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চট্টগ্রামে এক যুবককে বেঁধে গান গাইতে গাইতে পেটানোর ২০ সেকেন্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ পরিবারের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি শাহাদাত নামে যুবকটির। গত ১৪ অগাস্ট যার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
পরিবারের অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলছে পুলিশ
এদিকে ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর শাহাদাতের পরিচয় নিশ্চিত হলে সোমবার তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শাহাদাতের স্ত্রী শারমিনের বড় বোন হোসনে আরা বলেছিলেন, গত ১৩ অগাস্ট সন্ধ্যায় সাগর নামে এক যুবক টেলিফোন করে ‘কথা আছে’ বলে শাহাদাতকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যান।
তার ভাষ্য, সাগরের কাছ থেকে শাহাদাত পাঁচ হাজার টাকা পাওনা ছিল। টাকা আদায় নিয়ে দুই জনের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। শাহাদাতের মৃত্যুর পর থেকে সাগরের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তারেক আজিজ বলেন, “অভিযোগটি ভিত্তিহীন। এ ধরনের কোনো সম্পৃক্ততা আমরা তদন্তে পাইনি। যদি সাগর ফোন করে থাকে তাহলে সেটি স্বাভাবিকভাবেই করেছিল বন্ধু হিসেবে বাসা থেকে বের হতে।”
শাহাদাতের বিরুদ্ধেও ছয় মামলা
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নিহত শাহাদাতের নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। যখন যা পেতেন তাই করতেন। তবে তার বিরুদ্ধেও ছয়টি মামলা আছে।
নগরীর কোতোয়ালী থানায় শাহাদাতের বিরুদ্ধে চারটি অস্ত্র, একটি ডাকাতির প্রস্তুতি এবং একটি চোরাই মালামাল নিজ হেফাজতে রাখাসহ মোট ছয়টি মামলা আছে।
বিভিন্ন সময়ে শাহাদাত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।
পুরানো খবর:
গান গেয়ে 'হত্যা': পুলিশের জালে ৩ জন
গান গেয়ে 'হত্যা': ফোন করে বাসা থেকে ডেকে নেয়া হয় শাহাদাতকে
গান গেয়ে 'হত্যা': তথ্য পেতে 'নাকাল' পুলিশ
চট্টগ্রামে গান গেয়ে যুবককে পিটিয়ে 'হত্যার ঘটনা অগাস্টের': পুলিশ