নিহতের মাথা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল।
Published : 23 Sep 2024, 02:59 PM
মাস দেড়েক আগে চট্টগ্রামে নির্জন সড়কে গান গেয়ে শাহদাত হোসেন নামের যে যুবককে ‘পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল’, সেই ঘটনা তদন্তে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্য পায়নি পুলিশ।
ঘটনাটি সরকার পতনের পর মাঝরাতে জনশূন্য সড়কে ঘটায় তথ্য পেতে ‘সমস্যা হচ্ছে’ বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) আবদুল মান্নান মিয়া।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনাটি ঘটেছিল ১৩ অগাস্ট মধ্যরাতে। যখন সড়ক ছিল প্রায় জনশূন্য। অগাস্টের ওই সময়ে এমনিতেই সড়কে লোকজনের চলাচল ছিল কম। আর মাঝরাত হওয়ায় ওই এলাকায় লোকজন খুবই কম ছিল।
“অন্য সময় মাঝরাতেও যেটুকু লোকজন থাকে, তাতে কোনো না কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য পাওয়া যায়। সেখানে অগাস্টের ওই সময়ের এই ঘটনা ঘটে বলে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে তদন্ত করছি।”
নিহত শাহাদাত হোসেন (২৪) নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানাধীন পাঁচবাড়িয়া ইউনিয়নের নদনা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন বয়লার কলোনিতে পরিবার নিয়ে থাকতেন। আর কাজ করতেন একই থানার বিআরটিসি এলাকার ফলমণ্ডিতে।
গত ১৪ অগাস্ট শাহাদাত হোসেনের লাশের সন্ধান মেলে শহরের বদনা শাহর মাজারের সামনে থেকে। লাশের মাথা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল।
এর এক মাস ৬ দিন পর ২১ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক যুবককে বেঁধে পেটানোর ২০ সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল হলে তার নাম পরিচয় মেলে।
পুলিশ তদন্তে নেমে জানিয়েছে, শাহাদাত হত্যা রহস্য উদঘাটনে তার পেশা, তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, মারধরে জড়িতদের পরিচয়, মরদেহ দূরের স্থান থেকে পাওয়া-সব কিছু মাথায় নিয়ে কাজ চলছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর গত ১৩ অগাস্টের রাতে শাহাদাতকে যখন মারধর করা হয়, সেসময় থানাতে পুলিশ থাকলেও তাদের তেমন সক্রিয়তা ছিল না।
এছাড়া সড়কে ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। সেই সময়ে সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছিল শিক্ষার্থীরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে রোববার ও সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়েছে। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে, শাহাদাত হোসেনকে মারধর করা হয় ১৩ অগাস্ট রাত ২-৩টার দিকে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকার সড়কের গোলচত্বরে।
“পরদিন প্রবর্তক মোড়ের অদূরে সিএসসিআর হাসপাতালের বিপরীতে বদনা শাহ মাজারের সামনের সড়কে রাস্তায় শাহাদাত হোসেনের লাশ পড়ে থাকতে দেখে সেখানে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারী রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা।”
চট্টগ্রামে গান গেয়ে যুবককে পিটিয়ে 'হত্যার ঘটনা অগাস্টের': পুলিশ
ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরাই প্রথমে লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। পরে পুলিশ খবর পেয়ে মেডিকেলে যায় ও পরবর্তী আইনি কাজ সারে।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, নিহত শাহাদাত দিনভিত্তিক বিভিন্ন কাজ করত। কখনো তিনি রিকশা চালাতেন, কখনো বিআরটিসি এলাকার ফলমণ্ডিতে কাজ করতেন।
বিআরটিসি ফলমণ্ডি ও স্টেশন রোড এলাকার সেসময়ের সরকারি দল আওয়ামী লীগের সহযোগী কোন সংগঠনের দুয়েকজন নেতার সাথে তাকে মাঝে মাঝে দেখা যেত, এমন তথ্যও প্রাথমিকভাবে পেয়েছে পুলিশ।
তবে শাহাদাতের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্তকারীরা।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করছি। যারা সেসময় সড়কে ট্রাফিক হিসেবে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সাথেও কথা বলার চেষ্টা করছি। যদি তারা কোন তথ্য দিতে পারেন। তবে এখনও বলার মত কোন অগ্রগতি নেই।”
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, “শাহাদাত হোসেন যেই হোক, সে একজন মানুষ। তার যদি কোন অপরাধও থেকে থাকে সেটার বিচারের জন্য দেশে প্রচলিত আইন আছে। কাউকে এভাবে বেঁধে পেটানো যায় না।
“আমরা সিরিয়াসলি তদন্ত করছি। অগ্রগতি হলেই জানতে পারবেন।”
যা ঘটেছিল
২০ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ২০ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক মিলে একটি ছেলেকে একটি গোল চত্বরের দুটি স্টিল পোলের সাথে বেঁধে রেখেছেন।
যুবকদের কয়েক জনের হাতে লাঠি। প্রায় অন্ধকার সড়কের মাঝখানে ওই গোল চত্বরে বেঁধে রাখা যুবককে ঘিরে গান গাইছে যুবকরা।
'মধু কই কই বিষ খাওয়াইলা' শিরোনামের গান গাইতে গাইতে ওই যুবকদের মধ্যে দু-তিনজন ভিডিও করছিল। বেঁধে রাখা যুবকের মাথা বার বার ঝুকে পড়ছিল। দুজন গিয়ে তার মাথা তুলে দিতেও দেখা গেছে।
বেঁধে রাখা ওই যুবকের পরনে ছিল আকাশি রঙের টিশার্ট এবং ছাই রঙা স্ট্রাইপড প্যান্ট। শাহাদাতকে যেখানে বেঁধে রাখা হয় তার পিছনে একটি ফ্লাইওভারের অংশ বিশেষ দেখা যাচ্ছিল ভিডিওতে।
পুলিশ জানায়, ১৩ অগাস্ট নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকায় সড়কের মাঝখানে গোল চত্বরে স্টিল পোলের সাথে দুহাত বেঁধে পেটানো হয় শাহাদাত হোসেনকে।
পেটানোর ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বদনা শাহর মাজার গেট এলাকায় পরদিন ১৪ অগাস্ট রাতে লাশ উদ্ধারের পর ১৫ অগাস্ট নগরীর পাঁচলাইশ থানায় শাহাদাতের পরিবার অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছিল।
১৪ অগাস্ট রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে শাহাদাতের লাশ সনাক্ত করেন তার স্ত্রী শারমীন আকতার।
আর ২১ সেপ্টেম্বর ভিডিও ভাইরাল হবার পর শাহাদাতের স্ত্রীকে থানায় এনে সেই ভিডিওটি দেখিয়ে শনাক্ত করার পর পুলিশ বলছে, ১৩ অগাস্ট রাতে মারধর করা ব্যক্তি এবং ১৪ অগাস্ট রাতে উদ্ধার হওয়া লাশ একই ব্যক্তির অর্থাৎ শাহাদাত হোসেনের।