বন্দর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহায়েল টার্মিনালের কাজে সৌদি অপারেটরের যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে বলছেন ‘দ্বার উন্মোচন’।
Published : 06 Dec 2023, 10:28 PM
পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় একটি সৌদি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশে নানা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ‘বড় আশা’ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরসিজিটিআই) পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা করলে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতাও বাড়বে বলে মনে করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দরের প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল পরিচালনায় সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরও যুক্ত হবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, পিসিটি পরিচালনায় সৌদি কোম্পানির এই বিনিয়োগ দেশটির বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী করছে, যা অন্য দেশগুলোকেও আগ্রহী করবে বলে আশা করা যায়।
সব মিলিয়ে পিসিটিতে বিদেশি অপারেটর আসায় বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক নবযাত্রার দ্বার উন্মোচন’ হবে বলে তাদের বিশ্বাস।
‘টুল পোর্ট’ থেকে ‘ল্যান্ড লর্ড’
বুধবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সৌদি সরকার মনোনীত গ্লোবাল পোর্ট অপারেটর রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনালের (আরসিজিটিআই) চুক্তি হয়। এ আওতায় আগামী ২২ বছর পিসিটি পরিচালনা করবে আরসিজিটিআই।
মোহনার অদূরে নগরীর ড্রাইডক ও চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের মাঝামাঝি স্থানে কর্ণফুলী নদীর তীরে এক হাজার ২২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
৫৮৪ মিটার দীর্ঘ তিনটি জেটিতে একসঙ্গে তিনটি কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। এছাড়া অপর জেটিতে তেল খালাসের জন্য অপর একটি জাহাজ ভেড়ানো যাবে।
এ টার্মিনালে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব। টার্মিনালে রয়েছে চারটি জেটি। এর তিনটি কন্টেইনার জেটি এবং অপরটি ডলফিন জেটি। নতুন এ টার্মিনালগুলো মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে জেটির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ২১টিতে।
চট্টগ্রাম বন্দর এত দিন পরিচালিত হয়েছে ‘টুল পোর্ট’ মডেলে। তাতে বেসরকারি কোম্পানিতে কন্টেইনার ওঠা-নামার কাজের জন্য দরপত্র অনুযায়ী নির্ধারিত অর্থ দেওয়া হত। আর ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে সব ধরনের মাশুল আদায় করত বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এর বিপরীতে ‘ল্যান্ড লর্ড’ মডেলে বন্দর কেবল পিসিটির অবকাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছে। আর প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করবে পরিচালনাকারী কোম্পানি আরসিজিটিআই।
বুধবার জিটুজি ভিত্তিতে হওয়া কনসেশন চুক্তি (সরবরাহ, পরিচালনা ও হস্তান্তর পদ্ধতিতে) অনুসারে এককালীন ও বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বন্দরকে পরিশোধ করবে আরসিজিটিআই।
এছাড়া টার্মিনালে কন্টেইনার ওঠা-নামা বাবদ শিপিং কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে ফি তারা পাবে, তা থেকে প্রতি কন্টেইনার হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বন্দরকে দেবে অপারেটর।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ চুক্তি হয়েছে। আগামী মাস থেকে পিসিটির কার্যক্রম শুরু হবে। আরসিজিটিআই শিগগির তাদের রেডি ইকুইপমেন্টগুলো নিয়ে আসবে। তবে গ্যান্ট্রি ক্রেন আনতে হয়ত কিছুদিন সময় লাগবে।
“আর্থিকভাবে বন্দর লাভবান হবে সেরকম একটা চুক্তি হয়েছে। চুক্তির বিস্তারিত ও আর্থিক দিক সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে।”
‘দক্ষতা বাড়বে, আরো বিদেশি অপারেটর আসবে’
বুধবার চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আরএসজিটিআই জেদ্দা পোর্ট টার্মিনালসহ অন্যান্য পোর্ট টার্মিনাল পরিচালনা করছে। তাদের দক্ষতা, প্রযুক্তি জ্ঞান ও কর্মপদ্ধতিতে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এতে আমাদের দেশের লোকরাও প্রশিক্ষিত হবে।
“এতে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হবে। ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাসের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি আরো লাভবান হবে।”
বন্দর চেয়ারম্যান এম সোহায়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সৌদি এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনায় অভিজ্ঞ। তাদের কার্যক্রম শুরুর পর আমাদের অন্য টার্মিনালগুলোতে যে দেশীয় আপারেটর আছে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এতে তাদেরও দক্ষতা বাড়বে।”
একই ধরনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে বন্দরে বিদেশি অপারেটর এখানে বিনিয়োগ করা শুরু করল। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। আগে বন্দরে এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ ছিল না।
“প্রতিযোগিতা শুরু হলে এখন যারা টার্মিনাল পরিচালনা করেন তারাও দক্ষতা বাড়াতে বাধ্য হবেন। এটা বন্দর ব্যবহারকারী, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এবং দেশের জন্যও ইতিবাচক।”
বিদেশি অপারেটরকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিতে ‘সময়োপযোগী ভালো পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকার প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভির।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গ্লোবাল অপারেটর থাকলে আমার দেশীয় অপারেটরের সাথে তুলনা করতে পারব। ভালো সার্ভিস পাব।
“এটা আমাদের দেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা কম্পেয়ার করার সুযোগ পাব দেশি ও বিদেশি অপারেটরদের সেবার মান, সময় ও দক্ষতা বিষয়ে। তবে বন্দর যেহেতু আমাদের জাতীয় সম্পদ, তাই প্রথম বিদেশি অপারেটরের কাজ দেখে পরেরগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ নিলে সবার জন্য ভালো হবে।”
পিসিটিতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পাশাপাশি বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও নিউমুরিং ওভারফ্লো কন্টেইনার ইয়ার্ড পরিচালনায় বিদেশি অপরাটের নিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, “এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি। ভবিষ্যতে জানতে পারবেন। বে টার্মিনালে দুবাই ও সিঙ্গাপুর আসবে। সেখানে কন্সট্রাকশন থেকে শুরু করে সবকিছু তারা করবে। সেই আলোচনা চলছে।”
বুধবার সকালে পিসিটির চুক্তি স্বাক্ষর শেষে দুপুরে বিশেষ বিমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসেন সৌদি আরবের বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ আব্দুল আজিজ আল-ফালি ও তার সঙ্গে থাকা ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
চট্টগ্রাম বন্দরের অন্য কোনো টার্মিনাল বা জেটি বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে কিনা জানতে চাইলে সালমান এফ রহমান বলেন, “জেটির বিষয়েও ভাবনা আছে। কথা চলছে।”
‘দ্বার উন্মোচন’
বুধবার চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “সৌদি আরবের এই বিনিয়োগের পর আমি মনে করি আরো অনেক বিনিয়োগ আসবে।”
আর সৌদি আরবের বিনিয়োগ মন্ত্রী খালিদ আব্দুল আজিজ আল-ফালি পিসিটি পরিদর্শনে এসে বলেন, “আগামী ২২ বছর রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। আমরা বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাস রেখেছি রাষ্ট্র হিসেবে এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে।
“বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বৈশ্বিক মানদণ্ডে দক্ষতার উন্নয়নও হয়েছে। বৃহৎ পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক লজিস্টিক হাব এ পরিণত হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সুযোগের অপেক্ষায় আছে।”
সৌদি মন্ত্রী বলেন, “আমাদের গ্লোবাল পোর্ট অপারেটর আরসিজিটিআই যে এই কাজটি পেয়েছে, তা সৌদি আরবের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একসাথে কাজ করতে আগ্রহী।
“স্পেশাল ইকোনমিক জোন চাই আমরা এখানে। বিষয়টি অনেকটা চূড়ান্ত পর্যায়ে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে সৌদি আরব বিনিয়োগ করতে চায়। অবকাঠামো, জ্বালানি, শিপিং, লজিস্টিকস, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে কাজের সুযোগ আছে। সৌদি আরবের প্রাইভেট সেক্টরের যারা এখানে এসেছেন, তারাও বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে সামিল হতে চায়।”
খালিদ আব্দুল আজিজ আল-ফালি বলেন, “এটা শুরু মাত্র। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ খুব সুন্দর ফ্যাসিলিটিজ তৈরি করেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই টার্মিনালটি ইকুইপমেন্টে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। কাছেই বিমানবন্দর। এখানে মাল্টিমোডাল কমিউনিকেশন ব্যবস্থা হয়েছে।”
এসময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, “এটা মাত্র শুরু। উনারা বলেছেন উনার বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগ করতে চান। শিগগিই আরো অনেক বড় বড় বিনিয়োগ আসবে। আজ সৌদি আরব-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের মিটিং হয়েছে। শুধু সৌদি আরব নয়, আরও অনেক দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।”
বন্দর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহায়েল টার্মিনালের কাজে সৌদি অপারেটরের যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে বলছেন ‘দ্বার উন্মোচন’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সৌদি আরব এখানে স্পেশাল ইকোনমিক জোন করতে আগ্রহী। অনেক সৌদি ব্যবসায়ী এখানে নানা খাতে বিনিয়োগ করবেন, তা সেদেশের বিনিয়োগ মন্ত্রী জানিয়েছেন। বন্দর সুবিধা তাদের আরো বেশি আকৃষ্ট করবে। সৌদি বিনিয়োগকারীদের দেখে অন্য দেশের বিনিয়োগকারীরাও আসবেন।”
পিসিটি চট্টগ্রাম বন্দরের প্রথম কোনো টার্মিনাল, যেটি বিদেশি অপরারেটরের হাতে গেল। বন্দরের এনসিটির চারটি জেটি পরিচালনা করে দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেক।
বন্দরের প্রস্তাবিত বে টার্মিনালের একটি অংশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানি এবং অন্য একটি অংশ সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানি পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে। বে-টার্মিনালের আরেকটি অংশ পরিচালনা করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।