ইংল্যান্ডের জীবন ও পড়াশোনা ছেড়ে জিম্বাবুয়েকে বেছে নেওয়া দেশপ্রেমিক ক্রিকেটারের গল্প

বিপিএল খেলতে আসা অলরাউন্ডার রায়ান বার্ল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কথা বললেন ইংল্যান্ডের নিশ্চিত জীবন ছেড়ে পরিবারের অমতে দেশে ফেরা, তার জীবন, ক্যারিয়ার, স্বপ্ন, দর্শন, বিপিএলসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2023, 09:22 AM
Updated : 5 Feb 2023, 09:22 AM

রায়ান বার্ল ক্রিকেটবিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন ছেঁড়া কেডসের ছবি টুইট করে সহায়তা চেয়ে। সেই তিনি গত সেপ্টেম্বরে তোলপাড় ফেলে দেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৩ ওভারে ৫ উইকেট নিয়ে। তার মূল কাজ যদিও ব্যাটিং। সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে এবার বিপিএল খেলতে এসে প্রথম দুই ম্যাচেই ঝড়ো ব্যাটিংয়ে অবদান রাখেন দলের জয়ে। এক সময় তিনি স্কলারশিপ পেয়ে চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। ক্যারিয়ার গড়ার হাতছানি ছিল ইংলিশ ক্রিকেটেও। কিন্তু তিনি ফিরে যান জিম্বাবুয়ের অনিশ্চিত জীবনে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই অলরাউন্ডার শোনালেন সেই সময়টার গল্প। পাশাপাশি তিনি কথা বললেন তার জীবন, ক্যারিয়ার, দর্শন, বিপিএল, বাংলাদেশসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে।

আপনার কেডসের ঘটনা দিয়েই শুরু করতে হবে! এখন কয় জোড়া আছে কেডস?

রায়ান বার্ল: একদম সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন, কয় জোড়া আছে। তবে এখন কোনো ঘাটতি বা সমস্যা নেই। অবশ্যই আমি খুবই কৃতজ্ঞ ও খুশি যে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এগিয়ে এসেছে এবং আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। ওই টুইটে আমি পিউমাকে ট্যাগও করিনি, অন্য একটি ব্র্যান্ডকে করেছিলাম। কিন্তু তারাই সহায়তা করেছে।

আমাদের মতো দেশে উঠতি একজন ক্রিকেটারের জন্য একের পর এক মানসম্পন্ন কেডস বা অন্যান্য ক্রিকেট উপকরণ কেনা খুব কঠিন। তাই পিউমা যখন আমার সহায়তায় এগিয়ে এলো, এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারত না। শুধু তখন বা এখনই নয়, যতদিন ক্রিকেট খেলব, ততদিনই পিউমা থাকবে আমার পাশে।

ওই টুইট দিয়েই আপনি ক্রিকেট বিশ্বে প্রবল পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন!

বার্ল: আমি আসলে অতকিছু ভেবে টুইট করিনি। ওই সময়টায় অনেকটা হতাশা আর অসহায়ত্ব থেকেই করেছিলাম। এরপর যা হলো, তা তো অভাবনীয়। পিউমাকে পাশে পাওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরেকটি টুইটও করেছিলাম। আশা করি, সামনে ক্রিকেটের পারফরম্যান্সেই আরও পরিচিতি বাড়বে!

বিপিএলে অবশ্যই আপনাকে ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের কারণেই আনা হয়েছে! এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা কেমন?

বার্ল: খুবই ভালো। যদিও খুব বেশি দিন এখনও হয়নি যে এসেছি, তারপরও সবাই খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। দ্রুতই সবাইকে খুব আপন মনে হয়েছে। পারফরম্যান্স দিয়ে দলে কিছুটা প্রভাব রাখতে পেরেছি, এতেও আসলে দলের অংশ হয়ে ওঠা সহজ হয়েছে।

তবে এখন টুর্নামেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে চলে এসেছি। এখনকার পারফরম্যান্সই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, আরও কয়েকটি ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স করতে পারব এবং আমরা ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারব।

২০১৯ বিপিএলে চারটি ম্যাচ খেলেছিলেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে। খুব ভালো করতে পারেননি। এবার শুরুটাই দারুণ হলো। পরিবর্তনটা কোথায় হয়েছে বলে মনে করেন?

বার্ল: এখন বয়স একটু বেড়েছে, অভিজ্ঞতাও। আগের চেয়ে আরও পরিণত। আন্তর্জাতিক ম্যাচ আরও বেশি খেলেছি। আত্মবিশ্বাসও এখন বেশি। সব মিলিয়েই হয়েছে। বাংলাদেশে বেশ কিছু ম্যাচও খেলেছি। এখন আরও বেশি ধারণা আছে এখানকার কন্ডিশন ও উইকেট সম্পর্কে।

এবার অনেক ইতিবাচক মানসিকতা নিয়েও এসেছি। আগেরবার যেটা হয়েছিল, মনের ভেতর সংশয় ছিল যে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, একটু সতর্ক থেকে, সাবধানী ব্যাটিং করে রান-টান করে দেখাতে হবে যে আমি যোগ্য এখানে খেলার… অনেক ভাবনা ছিল। এখন নিজের খেলা আরও ভালো করে জানি। কোথায় কীভাবে রান করতে পারি, তা জানা আমার।

এখনও অনেক বড় কিছু করে ফেলিনি। আরও করতে হবে। আরও শিখতে হবে। ক্রিকেটে শেখার শেষ নেই। বোলাররা সবসময়ই নতুন পথ খুঁজছে ব্যাটসম্যানদের আউট করার। ব্যাটসম্যান হিসেবে আমাদেরও সময়ের সঙ্গে নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে।

সিলেট স্ট্রাইকার্সে আসার পর আপনার প্রতি কোচ, অধিনায়ক ও অন্যদের বার্তা কি ছিল?

বার্ল: খুবই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। প্রথমত, ম্যাশ (সিলেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা) আমাকে দারুণভাবে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। আপনি যত অভিজ্ঞ বা বিখ্যাত ক্রিকেটারই হন না কেন, বিদেশের একটা লিগে, নতুন একটা দলে যাওয়ার পর কিছুটা সংশয় কাজ করবেই। কিন্তু ম্যাশ শুরুতেই আমাকে বলে দিয়েছে, কোনো কিছু না ভেবে যেন নিজের খেলাটা খেলি, যেভাবে ইচ্ছে নিজেকে যেন মেলে ধরি। এই বার্তাটা পাওয়া জরুরি ছিল।

প্রথম দিন ব্যাটিংয়ে নামার সময় আমাদের ওভারপ্রতি ৯-১০ রান দরকার ছিল। ম্যাশ শান্তভাবে বলল, ‘এই ম্যাচ এখন তোমার। তুমি নরম্যাল যে খেলাটা খেলো, যা পারো, সেটাই করো।’ তার মতো প্রভাববিস্তারী একজন অধিনায়ক যখন এরকম স্থির হয়ে কাঁধে ভরসার হাত রাখেন, এতটা বিশ্বাস রাখেন, তখন সাহস বেড়েই যায়। সেরাটা উজাড় করে দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। কোচরাও খুব পরিষ্কার করে আমার ভূমিকাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

জিম্বাবুয়ের অনেক ক্রিকেটার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন। হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, ব্রেন্ডন টেইলর, শন উইলিয়ামস, সিকান্দার রাজা…

বার্ল: (প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই) এই টুর্নামেন্ট নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা শুনেছি আমি। আপনি যাদের কথা বললেন, তাদের কাছ থেকেই শুনেছি, অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। আমারও ইচ্ছে আছে খেলার। যদি প্রস্তাব পাই, সময়টা মিলে যায়, আগ্রহ নিয়েই আসব। যারা খেলেছে এখানে, ওরা বলেছে যে এখানে খেলে অনেক কিছু শেখা যায়। স্পিন খেলায় উন্নতি হয়। টি-টোয়েন্টিতে ব্যাপারটা একরকম, ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ভিন্ন। ওখানে আরও বেশি কাজ করার, শেখার সুযোগ থাকে। নিজের খেলার সার্বিক উন্নতি হয়।

বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও অনেক মানসম্পন্ন স্পিনার আছে। নিজের স্পিন বোলিংয়ে যেমন উন্নতি করা সম্ভব, তেমনি নিজের ব্যাটিংয়ে অনেক উন্নতি করা সম্ভব। আশা করি, কোনো একটি দল আমার প্রতি আগ্রহী হবে!

বাঁহাতি স্পিন তো এমনিতেই ভালো খেলেন! সাকিব আল হাসানের ওভারে ৩০ রান, নাসুম আহমেদের ওভারে ৩৪, সেদিন নিহাদউজ্জামানের ওভারে তিন ছক্কা, দুই চার…

বার্ল: দেখুন, সাকিব বিশ্বমানের বোলার। নাসুমও খুব ভালো বোলার। এরকম দু-একটা ওভার গ্রেট বোলারদের হতেই পারে। তার মানেই তারা খারাপ বা আমি অসাধারণ হয়ে যাইনি। বাঁহাতি অ্যাঙ্গেলটা অবশ্যই কাজে লাগে, এই তো। তবে আমার এখনও অনেক শেখার আছে।

আপনার ছেলেবেলার দিনগুলিতে ফেরা যাক। একসময় স্কোয়াশ-ক্রিকেট, দুটিই চুটিয়ে খেলতেন। পরে ক্রিকেট বেছে নিলেন কেন?

বার্ল: বেড়ে ওঠার সময়টায় আমি অনেক খেলাই খেলেছি। ক্রিকেট আর স্কোয়াশই নয়, হকি, টেনিস, আরও অনেক খেলা খেলেছি স্কুলে। জিম্বাবুয়েতে একটা ব্যাপার হলো, আমরা সৌভাগ্যবান যে স্কুলে এই সব খেলাই হয়। এমন নয় যে স্কুলে গিয়ে কোনো একটি খেলা বা কোনো একটি ক্লাব বেছে নিতে হয়। সবাই সবকিছু খেলতে বা করতে পারে। আমার সময়টা তখন দারুণ আনন্দে কেটেছে।

পরে একটা পর্যায়ে যখন পেশাদার ক্রীড়াবিদ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, একটিকে তখন বেছে নিতেই হতো। আমি ক্রিকেটেই বেশি ভালো ছিলাম, ক্রিকেটই বেশি পছন্দ ছিল। শেষ পর্যন্ত তাই সিদ্ধান্তটি আমার জন্য সহজই ছিল।

একটা পর্যায়ে তো পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন। তখনও কি ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন অটুট ছিল?

বার্ল: স্কুল শেষে ইংল্যান্ডে গেলাম পড়াশোনার জন্য। বয়স তখন আমার ১৮। সৌভাগ্যবশত সাউথ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে ক্রিকেট ছাড়িনি অবশ্যই। খেলার অনেক সুযোগ-সুবিধা সেখানে ছিল। খেলা ছাড়ার কথা কখনোই ভাবিনি। পরে জিম্বাবুয়ে থেকে ডাক পেলাম, মনে হলো, এমন কিছুর অপেক্ষায়ই ছিলাম।

একটা উপায় ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চার-পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে ক্রিকেট খেলা। কিন্তু ততদিনে কী হয়, পারিপার্শ্বিকতা কতটা বদলে যায়, কেউ তো বলতে পারত না। ক্রিকেট আমাকে প্রচণ্ড টানছিল। তাই বছর দেড়েক পরই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেশে ফিরে যাই।

কোনো একটা কাউন্টি দলেও আপনার খেলার কথা ছিল বলে শোনা যায়…

বার্ল: কারও সঙ্গে চুক্তি হয়নি। তবে হ্যাম্পশায়ারের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তারা খুবই আগ্রহী ছিল। তবে বিদেশি হিসেবে নয়, তারা চাইছিল আমি ব্রিটিশ পাসপোর্ট পাওয়ার পর তাদের হয়ে খেলি। কিন্তু সেটা আমার জন্য অনেক দূরের ব্যাপার ছিল। পেশাদার ক্রিকেট খেলার জন্য ২৫-২৬ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোনো মানে পাইনি আমি। দেশ থেকে ডাক পাওয়ার পর তাই ফিরে যেতে খুব একটা ভাবতে হয়নি।

আপনার প্যাশনের ব্যাপারটা বোধগম্যই। কিন্তু ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় পড়াশোনা আর নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেশে ফিরে ক্রিকেটের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে আপনার পরিবারের আপত্তি ছিল না?

বার্ল: আমার জন্য সহজ ছিল, পরিবারের জন্য নয়। সত্যি বলতে, তারা মানতে পারছিল না শুরুতে। বাবার সঙ্গে লম্বা তর্কও হয়েছে আমার। তার ভাবনাও ভুল ছিল না, সব বাবা চান, তার সন্তান যেন নিশ্চিত ও সুন্দর জীবন পায়। এমন নয় যে তিনি চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি সবসময়ই আমাকে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তবে এই সিদ্ধান্তে তিনি সম্পৃক্ত থাকতে চাচ্ছিলেন প্রবলভাবে, যেহেতু গোটা জীবনের ব্যাপার।

দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। ঝগড়াঝাঁটি নয় অবশ্যই, নিজেদের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছি আমরা। তিনি অবশ্যই খুব খুশি ছিলেন না আমার সিদ্ধান্তে। তবে একটা পর্যায়ে যখন দেখলেন, আমি মনেপ্রাণে এটাই চাই, তারপর আর আলোচনা খুব দীর্ঘ হয়নি। আমার ব্যাপারটি তিনি বুঝতে পেরেছেন। এরপর শুধু বলেছেন, ‘যেহেতু ক্রিকেট বেছে নিচ্ছো, এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তুমি শতভাগের বেশি ঢেলে দেবে এবং দারুণ একটি ক্যারিয়ার গড়বে, ব্যস।’

সেই সময় আমার পাশে থাকার জন্য বাবার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। বাবার জন্মদিন এপ্রিলের ৫ তারিখে, মানে এজন্যই জার্সি নম্বর বেছে নিয়েছি ৫৪। বাবাকে উৎসর্গ করে, বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ।

এখন আপনার বাবার অনুভূতি কেমন?

বার্ল: খুবই খুশি এবং আমাকে নিয়ে গর্বিত তিনি। হয়তো বলতে পারেন, আমি এমন কোনো বিখ্যাত ক্রিকেটার নই। কিন্তু আমি দেশের হয়ে খেলছি, মা-বাবার কাছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। প্রতিটি ম্যাচ শেষেই মা-বাবার সঙ্গে সেদিনের খেলা নিয়ে কথা হয় আমার। তারা টিভিতে সরাসরি খেলা দেখতে না পারলে ইন্টারনেটে লাইভ স্কোরে চোখ রাখেন। জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলি বা কোনো লিগে, আমার খেলার সব খোঁজখবর রাখেন।

মনের কোনো এক কোণে, কখনও কী এরকম ভাবনা কাজ করে যে তখন ইংল্যান্ডে থেকে গেলে আজ হয়তো ইংল্যান্ডের হয়েও খেলতে পারতেন!

বার্ল: একদমই না। আমি আক্ষেপ পুষে রাখার মানুষ নই। প্রবলভাবে বিশ্বাস করি যে, জীবন কাটাতে হবে আক্ষেপ ছাড়া। যখন যেটা ভালো লাগে, সেটা করাই বেঁচে থাকার সেরা উপায়। ওই সময় যে সিদ্ধান্ত আমার সঠিক মনে হয়েছিল, আমি তা করেছি এবং তাতে আমি খুশি। আপনি বলছেন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সম্ভাবনার কথা। এমনও হতে পারত, ইংল্যান্ডে থেকে গেলে ক্রিকেটারই হতে পারতাম না। হয়তো আর বেশির ভাগ মানুষের মতো চাকরি-বাকরি করতাম, কে জানে! যা হয়েছে, ভালোর জন্যই হয়েছে।

আরেকটা ব্যাপার হলো, আমি দারুণ দেশপ্রেমিক একজন মানুষ। আমি জানি, আমরা সবাই দেশপ্রেমিক। তবে আমি আসলে দেশের প্রতি টান অনুভব করি প্রচণ্ড। বেড়ে ওঠার সময় থেকেই। সেই দেশপ্রেম থেকেই দেশের হয়ে খেলার ইচ্ছা জাগত। বিশ্বাস করুন, এখনও আমার মনে হয়, জিম্বাবুয়ে ছাড়া অন্য কোথাও আমি থাকতে পারতাম না। একদম মনের ভেতর থেকে বলছি। আপনি অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে আমার দেশই আমার জীবন। প্রচণ্ড ভালোবাসি দেশকে, দেশের হয়ে খেলতে।

জীবন নিয়ে তো আপনি খুশি। ক্যারিয়ার নিয়ে?

বার্ল: খুশি… ক্যারিয়ার নিয়েও খুশি। ক্যারিয়ারের শুরুতে যদিও আরও ওপরে ব্যাট করতাম। কিন্তু জিম্বাবুয়ে দলে, ওখানে জায়গা ফাঁকা ছিল না। ব্রেন্ডন টেইলর, ক্রেইগ আরভিন, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, শন উইলিয়ামস, সিকান্দার রাজা… তাদের ভীড়ে জায়গা করে নেওয়া কঠিন ছিল। আমাকে তাই ভিন্ন পথ খুঁজতেই হতো এবং সেটাই চেষ্টা করেছি।

আমার পরিসংখ্যান দেখে হয়তো ভালো কিছু মনে হয় না। কিন্তু আমার জায়গায় কাজটা কঠিনও। এখন আবার ক্যারিয়ার শুরু করলে হয়তো ওপেনার হতে চাইতাম বা তিনে খেলতাম, যাতে লম্বা সময় উইকেটে থাকা বা হাজার হাজার রানের সুযোগ থাকত। তবে আগেই বলেছি, আক্ষেপ রাখি না আমি।

শুরুতে অবশ্য খুব ভালো লাগেনি ৬-৭ নম্বরে ব্যাট করতে। সবাই চায় বড় বড় রান করতে। কিন্তু জায়গা পেতে হলে ভিন্ন কিছু করতেই হতো। সময়ের সঙ্গে নিজের খেলাকে পরিবর্তন করেছি এবং ফিনিশারের যে ভূমিকা, সেটিকেই আপন করে নিয়েছি।

এজন্য নিজের খেলাকে ভাঙতে হয়েছে অনেক। সেই চ্যালেঞ্জ জিততে পারাও আনন্দের। ফিনিশার হয়েছি বলেই হয়তো জাতীয় দলে খেলতে পারছি। এখানে এই বিপিএলেও আমাকে সেজন্যই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

আরেকটা ব্যাপার, নিচের দিকে ব্যাটিংয়ের কারণেই বোলিং নিয়ে এত কাজ করেছি। ওপরে ব্যাট করলে হয়তো বোলিংয়ে এতটা জোর দিতাম না। কিন্তু নিচের দিকে ব্যাটিং করার কারণেই অলরাউন্ডার হওয়ার চেষ্টায় বোলিং নিয়ে অনেক খেটেছি। সবমিলিয়ে আমি খুশি। আমি বিশ্বাস করি, যা কিছুই হয়, কোনো না কোনো কারণে হয়। ক্রিকেট ও জীবন আমাকে যে পথে নিয়ে গেছে, আমি খুশি তাতে।

আপনি কি সবসময় লেগ স্পিনারই ছিলেন?

বার্ল: ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলাম পেস বোলার। স্কুলে থাকতে তো আমি টম কারানের (ইংল্যান্ডের পেসার) সঙ্গে বোলিং ওপেন করতাম! টম কারান, স্যাম কারান, বেন কারান, ওরা তিন ভাই আমাদের স্কুলেরই। ওদের সঙ্গে খেলেছি। ১৫-১৬ বছর বয়সে স্পিন শুরু করলাম।

লেগ স্পিনের ব্যাপারটা হলো, এটা ভেতরে থাকতে হয়। নইলে হয় না। আমি যখন ছেলেবেলায় বাড়ির আঙিনায় বা বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতাম, তখন লেগ স্পিন করলে অনেক টার্ন করত বল। পরে একটা সময় মনে হলো, ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি পেস বোলিং চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন। শরীরের ওপর ধকলও যায় অনেক। তার চেয়ে ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দেই, সঙ্গে লেগ স্পিনটা সিরিয়াসলি করি। হুট করেই শুরু করে দেই। এখনও চলছে।

সেই লেগ স্পিনেই আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কীর্তিটা গড়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ ওভারে ৫ উইকেট, বিশ্বরেকর্ড, অস্ট্রেলিয়ার মাঠে জিম্বাবুয়ের প্রথম জয়ের নায়ক…

বার্ল: এসব আসলে হয়ে যায়। ৩ ওভারে ৫ উইকেট তো একটা পাগলাটে ব্যাপার, এটা হয়ে যায়। করা যায় না। দিনটি আমার ছিল। সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে গেছে। ৩ ওভারে ৫ উইকেট মানে তো আসলে ভাবার সুযোগই থাকে না খুব একটা।

আমি বলব না যে আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় কীর্তি। অবশ্যই এটা ক্যারিয়ারের একটা হাইলাইট, বড় অর্জন। তবে আসলে অর্জনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন, ওটা একটু বেশি ভালো, এটা কম ভালো… আপনাকে যদি বলি, ‘জীবনের সেরা দিন কোনটি?’ আপনি হয়তো দ্বিধায় পড়ে যাবেন, এটার তো কোনো মানদণ্ড নেই! আমারও সব ভালো পারফরম্যান্সই হৃদয়ের কাছে থাকে। আমার কাছে দলকে জয়ের মতো জায়গায় নিতে পারাই সবচেয়ে বেশি তৃপ্তির। সেদিন সেই তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আশা করি, ক্যারিয়ারে আরও অনেকবার পাব।

একসময় জিম্বাবুয়ে দলে ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়, স্ট্রাং ভ্রাতৃদ্বয়, মারি গুডউইন, নিল জনসন, অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেল, হিথ স্ট্রিক… কত কত তারকা ছিলেন। দারুণ একটা দল ছিল। মনে হয় না, সেই সময়টায় খেলতে পারলে ভালো হতো!

বার্ল: খেলতে পারলে তো দারুণ হতোই। তবে তারা যেমন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের কিংবদন্তি, আমাদের সময়েও আমাদের একান্ত আপন ব্রেন্ডন টেইলর, সিকান্দার রাজা, হ্যামি মাসাকাদজা, শন উইলিয়ামসরা ছিলেন বা আছেন। তারাও আমাদের গ্রেট। তাদের সঙ্গে খেলতে পারা দারুণ। আমরা নিজেরা এবং আরও যারো উঠে আসছে, আমরাও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারি!

টেইলর প্রসঙ্গ যখন এলোই, তার নিষেধাজ্ঞার ঘটনা আপনার কাছে কতটা বিস্ময় বা ধাক্কা হয়ে এসেছিল?

বার্ল: কঠিন… খুবই কঠিন ছিল। সত্যি বলতে, মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। সে আমাদের দেশের কিংবদন্তি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই পরিস্থিতির মধ্যে ডুবে গেছে। তবে এখন আর ওসবের গভীরে যেতে চাই না। বিটি (টেইলর) এখন সব পেছনে ফেলে অনেকটাই নতুন ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। কয়েকটি ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছে। নিজের আলাদা কোচিং সেট আপ আছে তার। সে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তা দেখে ভালো লাগছে।

বেড়ে ওঠার সময়টায় নায়ক কে ছিল আপনার?

বার্ল: ল্যান্স ক্লুজনার। আমিও তার মতো বাঁহাতি ব্যাটসম্যান আর ডানহাতি সিমার ছিলাম। অনেক জোরে বলে হিট করতাম। ক্লুজনার ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার, কিন্তু একই সঙ্গে খ্যাপাটে। একসময় ভাবতাম, ঠিক তার মতোই হব!

ক্রিকেটের বাইরে সময়টা কিভাবে কাটে?

বার্ল: আমি ভীষণভাবে খেলাধুলায় আসক্ত। যখন নিজের খেলা থাকে না, খেলা দেখি প্রচুর। দেশে যখন ফাঁকা সময় থাকে, এখনও আপনি আমাকে খুঁজে পাবেন হকি মাঠে বা স্কোয়াশ কোর্টে কিংবা গলফ কোর্সে।