ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস। ক্রিকেটের বহুল প্রচলিত কথাটাই আবার মনে করিয়ে দিল আফগানিস্তান। মুজিব উর রহমান সহজ ক্যাচ ফেলে দিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের। অল্প রানে জীবন পেয়ে, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে, চোটের আঘাত সয়ে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলির একটি খেললেন অস্ট্রেলিয়ান তারকা। অবিশ্বাস্য জয়ে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে উঠল অস্ট্রেলিয়া।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার জয় ৩ উইকেটে।
২৯২ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল অস্ট্রেলিয়া, স্মরণীয় জয়ের অপেক্ষায় তখন আফগানিস্তান। সেখান থেকে অষ্টম উইকেটে প্যাট কামিন্সের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ২০২ রানের জুটিতে ১৯ বল বাকি থাকতেই দলকে জিতিয়ে ফেরেন ম্যাক্সওয়েল।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্বিশতক করে তিনি অপরাজিত থাকেন ১২৮ বলে ২০১ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলে। যেখানে ১০টি ছক্কার পাশে চার ২১টি।
এই মাঠে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড এটি। ২০১৭ সালে ভারতের বিপক্ষে এখানে ২৮১ রানের লক্ষ্য তাড়ায় জিতেছিল নিউ জিল্যান্ড।
বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ডও এটিই। আগের রেকর্ডও ছিল ভারতের মাটিতে। ১৯৯৬ আসরের কোয়ার্টার-ফাইনালে চেন্নাইয়ে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৮৭ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ৬ উইকেটে জিতেছিল তারা।
জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার যখন ২৩ বলে ২১ রান, দ্বিশতকের জন্য ম্যাক্সওয়েলেরও প্রয়োজন ছিল ২১। মুজিবের টানা চার বলে ছক্কা-ছক্কা-চার-ছক্কায় দলকে কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি মাইলফলক স্পর্শ করেন ৩৫ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
ওয়ানডে ইতিহাসে রান তাড়ায় কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম দ্বিশতক এটি। পরে ব্যাট করে আগের সর্বোচ্চ ছিল ফাখার জামানের ১৯৩, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০২১ সালে।
ওয়ানডেতে ছয় নম্বরে বা এর নিচে নেমে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডও এখন ম্যাক্সওয়েলের। তিনি পেছনে ফেললেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ভারত অধিনায়ক কপিল দেবের অপরাজিত ১৭৫ রানকে।
ওয়ানডেতে দ্বিশতকের স্বাদ পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ব্যাটসম্যানও ম্যাক্সওয়েল। আগের সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল শেন ওয়াটসনের অপরাজিত ১৮৫, ২০১১ সালে মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে।
ম্যাক্সওয়েল ও কামিন্সের ২০১ রানের জুটিও ওয়ানডেতে অষ্টম উইকেটে রেকর্ড। ২০০৬ সালে কেপ টাউনে ভারতের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার জাস্টিন কেম্প ও অ্যান্ড্রু হলের ১৩৮ রানের জুটি ছিল আগের রেকর্ড।
জুটির ১৭৯ রানই করেন ম্যাক্সওয়েল! তাকে এক পাশে দারুণ সঙ্গী দিয়ে, ৬৮ বলে ১২ রানে অপরাজিত থাকেন অধিনায়ক কামিন্স।
অথচ প্রথম আফগান ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে ইব্রাহিম জাদরানের শতকের পর নতুন বলে পেসারদের দারুণ বোলিংয়ে জয়ের পথ তৈরি করে ফেলেছিল আফগানিস্তান।
ফাজালহাক ফারুকির জায়গায় সুযোগ পাওয়া নাভিন-উল-হাকের রাউন্ড দা উইকেটে অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাওয়া বলে খোঁচা দিয়ে দ্বিতীয় ওভারে বিদায় নেন ট্রাভিস হেড।
আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে শুরুর ধাক্কা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন মিচেল মার্শ। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তিনি (১১ বলে ২৪)। আরেকটি দারুণ ডেলিভারিতে তাকে এলবিডব্লিউ করে দেন নাভিন।
তিন ওভার পরই পরপর দুই বলে ডেভিড ওয়ার্নার ও জশ ইংলিসকে ফিরিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগান আজমাতউল্লাহ ওমারজাই। হ্যাটট্রিক বলে ম্যাক্সওয়েলের বিপক্ষে এলবিডব্লিউয়ের আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দিলে আফগানিস্তান নেয় রিভিউ। রিপ্লেতে দেখা যায়, প্যাড নয়, ব্যাট ছুঁয়েছিল বল।
খানিক পরই অবশ্য আবার উদযাপনের উপলক্ষ পায় আফগানিস্তান। মার্নাস লাবুশেন কাটা পড়েন রান আউটে। রাশিদ খানের পরপর দুই ওভারে মার্কাস স্টয়নিস ও মিচেল স্টার্কের আউটে অস্ট্রেলিয়ার দুর্দশা বাড়ে আরও।
১৯তম ওভারে ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়া আর কতদূর যেতে পারে, সেটি নিয়েই তখন যত আলোচনা।
দুই ওভার পরই ম্যাচ পুরোপুরি মুঠোয় নিতে পারত আফগানিস্তান। নুর আহমেদের ওই ওভারে প্রথমে আম্পায়ার এলবিডব্লিউ দেওয়ার পর রিভিউ নিয়ে বাঁচেন ম্যাক্সওয়েল। চার বল পর তিনি সুইপ খেলতে গিয়ে বল তুলে দেন আকাশে। ফাইন লেগে লোপ্পা ক্যাচ মুঠোয় জমাতে ব্যর্থ হন মুজিব।
৩৩ রানে জীবন পেয়ে আফগানদের আর পরিষ্কার কোনো সুযোগ দেননি ম্যাক্সওয়েল। এক প্রান্তে তিনি শুরু করেন আক্রমণ। রান আসতে থাকে বানের জলের মতো। ৭৬ বলে তিনি পূর্ণ করেন চতুর্থ ওয়ানডে শতক। যার তিনটিই এলো বিশ্বকাপে।
পিঠের ও হ্যামস্ট্রিংয়ের সমস্যায় ভুগতে হচ্ছিল ম্যাক্সওয়েলকে। ফিজিওর চিকিৎসা নিতে হয় কয়েক দফা। একেকটি সিঙ্গেল নিতে হচ্ছিল তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তবু দমে যাননি। বরং আরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন তিনি। তাতে গুঁড়িয়ে যায় আসরে আফগানিস্তানের টানা চতুর্থ জয়ের আশা।
এর আগে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা আফগানিস্তানের ইনিংসটা ছিল ইব্রাহিম-ময়। ইনিংস শুরু করে ১৪৩ বলে অপরাজিত ১২৯ রানের ইনিংস খেলেন তিনি ৮ চার ও ৩ ছক্কার সাহায্যে।
তাদের আর কেউ অবশ্য পঞ্চাশ ছুঁতে পারেননি। রাশিদ অপরাজিত থাকেন ১৮ বলে ৩৫ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলে। এরপর বোলিংয়ে তাদের অমন দারুণ শুরু, কিন্তু তাদের মুঠো থেকে জয় বের করে নিলেন ম্যাক্সওয়েল।
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার পর তৃতীয় দল হিসেবে সেমি-ফাইনালের টিকেট পেল অস্ট্রেলিয়া। বাকি একটি স্থানের লড়াইয়ে এখন নিউ জিল্যান্ড, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। তিন দলেরই সমান ৮ পয়েন্ট করে, ম্যাচ বাকি একটি করে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ২৯১/৫ (গুরবাজ ২১, ইব্রাহিম ১২৯*, রেহমাত ৩০, শাহিদি ২৬, ওমারজাই ২২, নাবি ১২, রাশিদ ৩৫*; স্টার্ক ৯-০-৭০-১, হেইজেলউড ৯-০-৩৯-২, ম্যাক্সওয়েল ১০-০-৫৫-১, কামিন্স ৮-০-৪৭-০, জ্যাম্পা ১০-০-৫৮ -১, হেড ৩-০-১৫-০, স্টয়নিস ১-০-২-০)
অস্ট্রেলিয়া: ৪৬.৫ ওভারে ২৯৩/৭ (ওয়ার্নার ১৮, হেড ০, মার্শ ২৪, লাবুশেন ১৪, ইংলিস ০, ম্যাক্সওয়েল ২০১*, স্টয়নিস ৬, স্টার্ক ৩, কামিন্স ১২*; মুজিব ৮.৫-১-৭২-০, নাভিন ৯-০-৪৭-২, ওমারজাই ৭-১-৫২-২, রাশিদ ১০-০-৪৪-২, নুর ১০-১-৫৩-০, নাবি ২-০-২০-০)
ফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: গ্লেন ম্যাক্সওয়েল