একইরকম ভুলের পুনরাবৃত্তির চক্রে পড়ে স্টাইলিশ এই ব্যাটসম্যান কেবল হতাশ করেই চলেছেন, ভুল থেকে শেখার তেমন কোনো প্রমাণ নেই তার ব্যাটিংয়ে।
Published : 12 Nov 2023, 08:57 AM
দৃশ্যটি খুব চেনা। আউট হয়ে নিজের ওপরই বিরক্ত লিটন কুমার দাস। কখনও হতাশায় উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকেন, মাথা নিচু করে থাকেন, কখনও ব্যাটের দিকে তাকান, মাথা নাড়াতে নাড়াতে ফেরেন। তার ক্যারিয়ারে অনেক অনেকবার দেখা গেছে এই দৃশ্য। এই বিশ্বকাপেও দেখা গেছে নিয়মিত। বাংলাদেশের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ছিল সেই দৃশ্যের মঞ্চায়ন।
ভবিষ্যতেও এই দৃশ্য দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে কোনো বাজির কোনো দরই হবে না। নিশ্চিত ব্যাপার নিয়ে তো আর বাজি হয় না!
আউট হয়ে নিজের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করা মানে এমনিতে দুটি ব্যাপার বোঝা যায়। প্রথমত, তিনি উইকেট বিলিয়ে দিচ্ছেন বা আলগা শট খেলছেন। দ্বিতীয়ত, নিজের ভুলের জায়গাটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
লিটনের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঠিক আছে। বারবারই প্রতিপক্ষকে উইকেট উপহার দিয়ে ফিরছেন। তবে পরেরটি ব্যতিক্রম। ভুল বুঝতে পারার কোনো প্রমাণ তার ব্যাটিংয়ে নেই। এই বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ৬ বার তিনি আউট হওয়ার পর নিজের ওপর হতাশা প্রকাশ করেছেন।
মানে, বারবারই ভুল করছেন। কিন্তু ভুল থেকে শিখছেন কোথায়!
লিটন কতটা প্রতিভাবান, তার ব্যাটিং কতটা দৃষ্টিসুখকর, ছন্দে থাকলে তিনি বোলারদের কতটা অসহায় করে তুলতে পারেন, এসব আলোচনা কম হয়নি। ক্যারিয়ারের এতগুলো বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর এখন সেসবের মূল্য খুব একটা নেই। সময় এখন সামর্থ্যের সবটুকু মেলে ধরার। বেশ আগেই আসলে সেই সময়টা হয়ে গেছে। লিটন কখনও পেরেছেন, বেশির ভাগ সময়ই হতাশ করেছেন। এই বিশ্বকাপেও যেমন। আরও একবার তিনি ব্যর্থ প্রত্যাশা পূরণ করতে।
৯ ইনিংস খেলে এই বিশ্বকাপে তার রান ২৮৪, ব্যাটিং গড় ৩১.৫৫। একজন ওপেনার কিংবা বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের জন্য বেশ মলিন পরিসংখ্যান।
এমন যদি হতো, দ্রুত রান তুলতে গিয়ে বা দলের প্রয়োজনে উড়ন্ত শুরু এনে দেওয়ার চেষ্টায় তিনি আউট হয়েছেন বারবার, তাহলে হয়তো এই রান বা গড়কে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তার ৮০.২২ স্ট্রাইক রেট বলছে, খুব আগ্রাসী তিনি ছিলেন না।
এই পারফরম্যান্স দিয়েই অবশ্য একটি জায়গায় বাংলাদেশের ইতিহাস সেরা হয়ে গেছেন তিনি। বিশ্বকাপের এক আসরে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করা ওপেনার তিনিই! আগের সর্বোচ্চ ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপে তামিম ইকবালের করা ৮ ইনিংসে ২৩৫।
বাংলাদেশের আর কোনো ওপেনার এক বিশ্বকাপে ২০০ রানও করতে পারেনি। বিশ্ব আসরে দলের টপ অর্ডারে করুণ চিত্রই ফুটে ওঠে এতে।
তবে এটা তো আর লিটনের ব্যর্থতার ঢাল হতে পারে না! তার কাছে এবার প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বি। তার মাঝে বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানের প্রতিচ্ছবি দেখে দল। এবারের বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রান করা ৫ ব্যাটসম্যানই টপ অর্ডার। সব দলেরই টপ অর্ডার কম-বেশি ভালো করেছে। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।
শুধু বৈশ্বিক ভাবনা থেকেই নয়, হতাশ করেছেন তিনি বাংলাদেশ দলের বাস্তবতায়ও। দলের মূল ওপেনার তিনি, মূল ব্যাটসম্যানও। সম্ভবত দলের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারি ব্যাটসম্যানও। তিনি ভালো শুরু এনে দিলে ড্রেসিং রুম সাহসী হয়ে ওঠে, তিনি বড় ইনিংস খেলতে পারলে দলের ভালো করার সুযোগ বেড়ে যায় অনেক। ব্যাটিং লাইন আপে মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকদের ভূমিকা এখন আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাকিবও ব্যাট হাতে সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। লিটন ও নাজমুল হোসেন শান্তর দিকেই বেশি তাকিয়ে ছিল দল। ওপেনার হিসেবে ও অভিজ্ঞতা বেশি বলেও লিটনের দায়িত্ব ছিল বেশি। এখানেই লিটন পারেননি প্রত্যাশা পূরণ করতে।
তবে রান পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি হতাশার আসলে তার আউট হওয়ার ধরন। তাকে নিয়ে আক্ষেপ ও শঙ্কাও এখানেই বেশি। ভুল থেকে শেখা, নিজেকে গোছানো, নিজের উইকেটের মূল্য বোঝার ছাপ খুব একটা নেই। নিজেকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার তাড়না সেখানে নেই।
তার ক্যারিয়ারের নানা ইনিংস পর্যালোচনা করলে তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে। স্রেফ এই বিশ্বকাপের আউটগুলোয় পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, স্রেফ দুটি ম্যাচে তিনি ভালো বলে আউট হয়েছেন- দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কাগিসো রাবাদার ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দিলশান মাদুশাঙ্কার দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে।
এই দুটি ডেলিভারিও আসলে ‘আনপ্লেয়েবল’ ছিল না। রাবাদার ডেলিভারিতেই যেমন লিটন ফ্লিক করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হয়েছেন। সোজা ব্যাটে খেললে আউট হওয়ার সুযোগ কমই থাকত। মাদুশাঙ্কার ইয়র্কারে বলের গতি খুব বেশি ছিল না। লিটন মূলত চমকে গিয়েই সময়মতো ব্যাট নামাতে ব্যর্থ হন। তারপরও এই দুটি আউটে বোলারের কৃতিত্ব আছে। বাকিগুলোর দায় শুধুই লিটনের।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শনিবারের ম্যাচেই যেমন। খুব সাবধানী শুরু করেছিলেন। এরপর থিতু হয়ে শট খেলতে শুরু করেন। দারুণ নিয়ন্ত্রিত ব্যাটিং করছিলেন। কোনো বোলারই তাকে খুব অস্বস্তিতে ফেলতে পারেননি। অ্যাডাম জ্যাম্পা বোলিংয়ে আসার পর একটু মনোযোগ হারিয়ে একটি ক্যাচের মতো দিলেন, অল্পের জন্য তা হাতে জমাতে পারলেন না প্যাট কামিন্স। এরপর আরেকটু সতর্ক হওয়ার কথা লিটনের। বিশেষ করে জ্যাম্পাকে খেলার ক্ষেত্রে।
কিন্তু তিনি তো লিটন, ভুলগুলো ভুলে যান! একটু পরই জ্যাম্পাকে তুলে মারলেন। সেই শটে না থাকল ছক্কা হওয়ার মতো জোর, না থাকল বল ফিল্ডারের কাছে না যাওয়ার মতো কম জোর। বরং মনে হলো, তিনি যেন অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং কোচ, ‘লং ক্যাচ’ ক্যাচিং অনুশীলন করাচ্ছেন মার্নাস লাবুশেনকে।
এবার একটু পেছনে ফিরে যান পুনেতেই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে। সেদিন লিটন দুর্দান্ত খেলছিলেন, একদম নিজের সেরা চেহারায়। এরপর হুট করেই রবীন্দ্র জাদেজাকে ইনসাইড আউট খেলার চেষ্টা করেন। সেখানেও মারে যথেষ্ট জোর নেই, স্রেফ আলতো করে তুলে মারার মতো। খেসারত দিতে হয় উইকেট হারিয়ে।
সেদিনও শটটি খেলে নিজের ওপর বিরক্তি দেখিয়েছিলেন লিটন। দেখালেন এ দিনও। কিন্তু শিখলেন কোথায়?
দুটি শটেই ‘ম্যাচ অ্যাওয়ারনেস’ বা ‘ম্যাচ সচেতনতার’ ঘাটতির প্রমাণ প্রবল। জ্যাম্পা একজন লেগ স্পিনার এবং অস্ট্রেলিয়ার মূল স্পিনার। ওই সময়টায় যদি বড় শট খেলতেও হয়, তাহলে জ্যাম্পার বলে খেলার কোনো দরকারই ছিল না। আরেকপাশে বল করছিলেন খন্ডকালীন অফ স্পিনার ট্রাভিস হেড। অনায়াসেই তাকে ‘টার্গেট’ করতে পারতেন লিটন।
ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিতে যেমন, জাদেজাকে সেসময় বোলিংয়ে রাখাই হয়েছিল উইকেট নেওয়ার জন্য। জোরের ওপর বল করা একজন বাঁহাতি স্পিনার, যাকে ডাউন দা উইকেটে খেলা কঠিন, তার বলে ‘চান্স’ নেওয়া জরুরি ছিল না। অনায়াসেই তাকে পার করে দেওয়া যেত।
এবার বিশ্বকাপের শুরু থেকে এভাবেই তিনি প্রতিপক্ষের জন্য সহায়তার ‘ব্যাট’ বাড়িয়ে ধরেছেন। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে রান তাড়ায় কোনো চাপ তার ছিল না। ফাজালহাক ফারুকির বলে সেদিন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে শরীর থেকে দূরে ব্যাট পেতে দিয়ে বল টেনে আনেন স্টাম্পে। ঠিক পরের ম্যাচেই অনেকটা এর পুনরাবৃত্তি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন খেলছিলেন দারুণ। কিন্তু হুট করে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে কিছুটা হাঁটার মতো ভঙ্গিতে বাইরের বলে ব্যাট বাড়িয়ে দেন। যেটিকে বলা যায় আসলে ‘নাথিং শট।’
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে চেন্নাইয়ে ট্রেন্ট বোল্টের মতো নতুন বলের কার্যকর এক বোলারকে যেভাবে ম্যাচের প্রথম বলেই তুলে মারতে গিয়ে আউট হন, এটা নিয়ে তখন আলোচনা-সমালোচনা হয় প্রচুর। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৩৮৩ রান তাড়ায় ২২ রান করেন তিনি ৫০ স্ট্রাইক রেটে।
তবে সেসব ম্যাচের বিস্ময়কেও ছাড়িয়ে যান নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। মাঝারি রান তাড়ায় কোনো চাপ ছিল না, পরিস্থিতির দাবি ছিল না তেমন কিছু, কিন্তু তিনি আচমকাই রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে উইকেট হারান। দলের পতনের শুরু হয় তার হঠকারী শট থেকেই।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ইফতিখার আহমেদের অতি নিরীহ এক ডেলিভারিতে আলতো ক্যাচ তুলে দিয়ে তিনি ক্রিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ।
সবমিলিয়ে ভুলের পর ভুল। এরপর আবার একইরকম ভুল। সেই কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু খুঁজে পাননি মলম, নিজেকেও বিরত রাখতে পারেননি পরেরবার আবার কাঁটায় পা ফেলতে।
এই চক্রে পড়েই তার ওয়ানডে গড় এখনও মোটে ৩২.৪৮। এই ব্যাটিং স্বর্গ উইকেট আর রান জোয়ারের বিশ্বকাপেও তার ব্যাট ম্রিয়মান।
বয়স পেরিয়ে গেছে ২৯। ক্রিকেটের হিসেবে এখন তার সেরা সময় থাকার কথা। কিন্তু পারফরম্যান্সে সেসবের প্রতিফলন কোথায়!
বিশ্বকাপ শুরুর আগে টি-স্পোর্টসে সেই তুমুল আলোচিত সাক্ষাৎকারে সাকিব আর হাসান বলেছিলেন, এবারের বিশ্বকাপে লিটন এমন কিছু করবেন যে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে। অধিনায়কের এই ভরসা এখন শোনাচ্ছে পরিহাসের মতো!