রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে প্রোটিয়াদের হৃদয় ভেঙে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া

বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার, সেমি-ফাইনাল থেকে তারা বিদায় নিল পঞ্চমবারের মতো।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2023, 05:15 PM
Updated : 16 Nov 2023, 05:15 PM

মার্কো ইয়ানসেনের অফ স্টাম্পের বাইরের শর্ট বল পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠালেন প্যাট কামিন্স। আনন্দে মেতে উইকেটের সঙ্গীকে আলিঙ্গনে বাঁধলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার ডাগআউটে সবার মুখে চওড়া হাসি। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের চোখে-মুখে শূন্যতার ছাপ, আরও একবার! অল্প পুঁজি নিয়ে দুর্দান্ত বোলিংয়ে অবিশ্বাস্য এক জয়ের আশা জাগিয়েও ফিল্ডারদের ব্যর্থতায় প্রোটিয়াদের পুড়তে হলো বেদনার আগুনে। ফাইনালের চেনা মঞ্চে আরেকবার পা রাখল অস্ট্রেলিয়া।

বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস এক লড়াইয়ের সাক্ষী হলো কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স। যেখানে ৩ উইকেটের রোমাঞ্চকর জয়ে অষ্টমবারের মতো ফাইনালে উঠল রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা।

দক্ষিণ আফ্রিকার ফাইনালে খেলার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। এই নিয়ে পাঁচবার তারা বিদায় নিল সেমি-ফাইনাল থেকে। যার মধ্যে তিনবারই তাদের হৃদয় ভাঙল অস্ট্রেলিয়া।

খানিকটা মন্থর ও টার্নিং উইকেটে বৃহস্পতিবার ৪ উইকেটে ২৪ রানের নড়বড়ে অবস্থানে থেকে ডেভিড মিলারের দুর্দান্ত শতকে দক্ষিণ আফ্রিকা করে ২১২ রান। ট্রাভিস হেডের ঝড়ো ফিফটির পর রোমাঞ্চ-উত্তেজনার নানা ধাপ পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়া লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ১৬ বল হাতে রেখে।

আগামী রোববার আহমেদাবাদের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার অপেক্ষায় স্বাগতিক ভারত, যারা আগের দিন নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে উঠেছে শিরোপা লড়াইয়ের মঞ্চে।

অস্ট্রেলিয়ার জয়ের নায়ক এ দিন হেড। হাত ঘুরিয়ে ২ উইকেট নেওয়ার পর ওপেনিংয়ে ৪৮ বলে ৬২ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা তিনি।

দারুণ বোলিংয়ে ৩ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাটিংয়ে ৩৮ বলে অপরাজিত ১৬ রানের মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংসে দলের জয়ে বড় অবদান রাখেন মিচেল স্টার্ক।

চাপের মুখে নেমে মিলারের ১১৬ বলে ৫ ছক্কা ও ৮ চারে গড়া ১০১ রানের ইনিংস কাজে এলো না। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার কারও প্রথম শতক এটি, নকআউটে ছয় বা এর নিচে নেমে কারও প্রথম শতকও।

শেষের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচের শুরুটাও হয় হতাশায় মোড়ানো। এ দিন সকাল থেকেই কলকাতার আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামার পর দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসেও যেন নামে আঁধার!

প্রথম ওভারেই তারা হারায় অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাকে। সতর্ক শুরুর পর চাপ সরানোর চেষ্টায় বল আকাশে তুলে কুইন্টন ডি কক বিদায় নেন ষষ্ঠ ওভারে।

মিচেল স্টার্ক ও জশ হেইজেলউডের আঁটসাঁট বোলিংয়ে প্রথম পাওয়ার প্লের ১০ ওভারে দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলতে পারে মাত্র ১৮ রান, বাউন্ডারি স্রেফ একটি।

পরের দুই ওভারে এইডেন মার্করাম ও রাসি ফন ডার ডাসেনের বিদায়ে প্রোটিয়ারা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে, ২৪ রানে নেই ৪ উইকেট!

মিলারের লড়াই শুরু সেখান থেকেই। প্রথমে তাকে সঙ্গ দেন হাইনরিখ ক্লসেন। মাঝে শঙ্কা সত্যি করে বৃষ্টি নামে মাঠে। পৌনে এক ঘন্টা পর আবার খেলা শুরু হলে দুই ব্যাটসম্যান একশ পার করান দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

জুটি ভাঙতে হেডকে আক্রমণে আনেন কামিন্স। কাজে লাগে তার সেই কৌশল। হেড পরপর দুই বলে ফিরিয়ে দেন ক্লসেন (৪৮ বলে ৪৭) ও ইয়ানসেনকে।

ক্লসেনের সঙ্গে ৯৫ রানের জুটির পর মিলার আরেকটি পঞ্চাশোর্ধ (৫৩) জুটি গড়েন জেরল্ড কুটসিয়ার সঙ্গে। এরপর প্রায় একাই দলের স্কোর দুইশ পার করেন মিলার। ৭০ বলে পঞ্চাশ ছোঁয়া বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ছক্কায় শতকে পা রাখেন ১১৫ বলে। এরপরই থামেন তিনি কামিন্সের বলে।

ছোট লক্ষ্য তাড়ায় হেড ও ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাটে উড়ন্ত সূচনা পায় অস্ট্রেলিয়া। দুজনে প্রথম ৬ ওভারেই তুলে ফেলেন ৬০ রান। এরপর প্রথম আক্রমণে এসে ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে বিস্ফোরক জুটি ভাঙেন মার্করাম।

পরের ওভারে ফন ডাসেনের দুর্দান্ত ক্যাচে শূন্য রানে বিদায় নেন মিচেল মার্শ। খানিক পর ফেরানোর সুযোগ আসে হেডকেও, ক্যাচ নিতে পারেননি রিজা হেনড্রিকস, অবশ্য কঠিন ছিল সেটি।

জীবন পেয়ে টানা তিন বাউন্ডারিতে হেড ফিফটি করেন ৪০ বলে। ৫৭ রানে আরেকবার জীবন পাওয়ার পর অবশ্য বেশিদূর যেতে পারেননি তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিংয়ের দুর্দশা তবু শেষ হয়নি। এবার ১০ রানে স্টিভেন স্মিথের ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হন কিপার ডি কক।

৩৭ রানের জুটিতে স্মিথ ও মার্নাস লাবুশেন এগিয়ে নেন দলকে। এরপর আবার জোড়া ধাক্কা। তাবরেজ শামসিকে রিভার্স সুইপের চেষ্টায় উইকেট বিলিয়ে দেন লাবুশেন। প্রোটিয়া রিস্ট স্পিনারের পরের ওভারে বাজে শটে বলের লাইন মিস করে বোল্ড হন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।

১৩৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে তখন বিপদে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে বেশ ভালোভাবেই।

অস্ট্রেলিয়ার হাল ধরেন এরপর স্মিথ ও জশ ইংলিস। দুজন জুটিতে তুলে ফেলেন ৩৭ রান। কিন্তু পাগলাটে এক শটে বল আকাশে তুলে বিদায় নেন স্মিথ।

তখনও অস্ট্রেলিয়ার দরকার ৩৯ রান। ইংলিস দলকে টানেন আরও কিছুটা, কিন্তু কাজ শেষ করে আসতে পারেননি। দারুণ ইয়র্কারে ইংলিসকে (৪৯ বলে ২৮) যখন বিদায় করে দেন জেরল্ড কুটসিয়া, জয় থেকে তখনও ২০ রান দূরে অস্ট্রেলিয়া, রোমাঞ্চকর এক শেষের অপেক্ষা।

স্টার্ক ও কামিন্সের জুটি অবশ্য আর ভাঙতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা, ৯ রান বাকি থাকতে একটি সুযোগ যদি আসে, কিন্তু কামিন্সের ক্যাচ নিতে পারেননি ডি কক। আসরে ব্যাট হাতে চার সেঞ্চুরিতে ৫৯৪ রান করলেও এই কিপার ব্যাটসম্যানের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষটা হলো তাই হতাশায়।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

দক্ষিণ আফ্রিকা: ৪৯.৪ ওভারে ২১২ (ডি কক ৩, বাভুমা ৪, ফন ডার ডাসেন ৬, মার্করাম ১০, ক্লসেন ৪৭, মিলার ১০১, ইয়ানসেন ০, কুটসিয়া ১৯, মহারাজ ৪, রাবাদা ১০, শামসি ১*; স্টার্ক ১০-১-৩৪-৩, হেইজেলউড ৮-৩-১২-২, কামিন্স ৯.৪-০-৫১-৩, জ‍্যাম্পা ৭-০-৫৫-০, ম‍্যাক্সওয়েল ১০-০-৩৫-০, হেড ৫-০-২১-২)

অস্ট্রেলিয়া: ৪৭.২ ওভারে ২১৫/৭ (হেড ৬২, ওয়ার্নার ২৯, মার্শ ০, স্মিথ ৩০, লাবুশেন ১৮, ম্যাক্সওয়েল ১, ইংলিস ২৮, স্টার্ক ১৬*, কামিন্স ১৪*; ইয়ানসেন ৪.২-০-৩৫-০, রাবাদা ৬-০-৪১-১, মার্করাম ৮-১-২৩-১, কুটসিয়া ৯-০-৪৭-২, শামসি ১০-০-৪২-২, মহারাজ ১০-০-২৪-১)

ফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: ট্রাভিস হেড