বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে এখন আর কথা বলতে চান না সাবেক কোচ, তবে বাকি ম্যাচগুলির জন্য দলকে শুভ কামনা জানিয়েছেন তিনি।
Published : 04 Nov 2023, 08:58 AM
রাসেল ডমিঙ্গোর প্রিয় শখ মাছ ধরা। সময় পেলেই আয়োজন করে ইয়ট নিয়ে মাছ ধরতে ছুটে যান তিনি। তার হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইল ছবিতেও সেটির প্রমাণ। নীল সাগরে পা ভিজিয়ে তাকিয়ে আছেন বিশাল এক মাছ হাতে ধরে। অথচ সব ঠিকঠাক থাকলে এখন মাছ শিকার নয়, তার ব্যস্ত সময় কাটার কথা ছিল বিশ্বকাপের মঞ্চে, বাংলাদেশের কোচ হিসেবে প্রতিপক্ষকে শিকার করার ছক কষতে!
তবে বিশ্বকাপে তিনি না থেকেও আছেন। অন্তত বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন বারবারই উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম। যদিও এদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে আরও ১০ মাসেরও বেশি আগে। তার নাম, তার স্মৃতিতে পলি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবিই আবার জাগিয়ে তুলেছে তাকে। ডমিঙ্গো কোচ রয়ে গেলে কি বাংলাদেশের বিশ্বকাপ এতটা বিপর্যস্ত আর বিষাদমাখা হতো?
উত্তরটা তিনি নিজেও তো দিতে পারেন! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স দেখে তার মনেও খেলে যেতে পারে কত ভাবনার দোলাচল। তার কথা শুনতে, তার ভাবনা জানতে ইচ্ছে হলো বলেই অনেক দিন ধরে ভুলে থাকা ফোন নম্বরটি আবার বিশেষ যত্ন পেল। তার দুয়ারে আবার কড়া নাড়া হলো।
ওপার থেকে তিনি সাড়া দিলেন আন্তরিকভাবেই। কিন্তু দুয়ার খুললেন না!
বাংলাদেশ দল, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে তিনি কিছুই বলতে চান না। সুখের স্মৃতি হোক বা দুঃখের, হয়তো সযতনে চেপে রাখা অধ্যায়কে তরতাজা করতে চান না।
তবু চেষ্টা করে যেতেই হয়। কিন্তু নানাভাবে বুঝিয়ে, সবিনয় অনুরোধেও কাজ হলো না। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তার একটিই কথা, “বাংলাদেশ দল নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই… অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে….।”
তা সত্যি বটে। সময়ের স্রোতে বয়ে গেছে অনেকগুলো দিন-মাস। ডমিঙ্গো যেমন বাংলাদেশ অধ্যায় পেছনে ফেলে কোচিং ক্যারিয়ারের নতুন গল্প রচনা করছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া দল লায়ন্সের হয়ে, তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেটেও বেশ পালাবদল হয়ে গেছে কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে গোটা টিম ম্যানেজমেন্টে। কোনো পক্ষেরই আর পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ নেই।
কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুসারী অনেকেই এখন ফিরে তাকাচ্ছেন ডমিঙ্গোর সময়টাতে। অনেকেই এখন আক্ষেপ করে বলছেন, ওই সময়টায় কত গোছানো একটি দল ছিল!
২০১৯ সালের অগাস্টে কোচের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে পা রাখেন ডমিঙ্গো। এরপর নানা আলোচনা-সমালোচনা, প্রশ্ন-সংশয়, সাফল্য-ব্যর্থতা আর প্রত্যাশা, সবকিছুকে সঙ্গী করেই তিনি এগিয়ে যান। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগেই বোর্ড তার চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় বলে খবর প্রকাশ করে দেশের কিছু সংবাদমাধ্যম, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তখন তা জানানো হয়নি। পরে জানানো হয়, ২০২৩ বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকছেন তিনি।
তবে তিনি থাকতে পারেননি। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের বাজে পারফরম্যান্সের পর থেকে মূলত সমালোচনার তীর ছুটতে থাকে তার দিকে। মাঝেমধ্যে বর্ম হয়ে তাকে রক্ষা করে অভাবনীয় কিছু জয়। তবে একটা সময় লড়াইয়ের ময়দান তিনি ছেড়ে যান। গত ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব থেকে।
আদতেই তিনি নিজ থেকে দায়িত্ব ছেড়েছেন নাকি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, কিংবা ছাড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, সেসব নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছে তখন। সময়ের স্রোতে তা ভেসেও গেছে। কিন্তু এই বিশ্বকাপে এসে আবার ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন সেই ডমিঙ্গোই। বাংলাদেশ দলে যখন দুঃসময়ের আঁধার, তখন সুসময়ের আলো ঝলমলে সময়টুকুর কথা তো মনে পড়বেই। যে কোচের সময়ে ৩০ ওয়ানডের ২১টিতেই জিতেছিল দল, এই জয়খরার দিনে তাকে নিয়ে তো এখন আক্ষেপের প্রবল বর্ষণ হবেই!
জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজগুলোয় প্রত্যাশিত সাফল্য তো ছিলই, ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। এই তো, গত বছরই! এমনকি পদত্যাগের আগে যেটি শেষ সিরিজ, সেখানেও সিরিজে দারুণ সাফল্য এসেছিল ভারতের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে।
এমন একটি সিরিজ জয়ের পর, বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়েই তিন বছর ধরে নানা প্রক্রিয়া আর পরিকল্পনার পথ ধরে হাঁটার পর তিনি পদত্যাগ করেছেন নিজ থেকেই, এমনটি বিশ্বাস করার লোক খুব কমই ছিল। বরং চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে আবার কোচ করে আনার মরিয়া নেশায় পেয়ে বসা বিসিবি কর্তারা ডমিঙ্গোকে পদত্যাগের পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছেন, এটিই একরকম প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
আজ সেই হাথুরুসিংহের কোচিংয়ে যখন বিশ্বকাপ ধুঁকছে দল, একজন ডমিঙ্গোকে মনে পড়া অস্বাভাবিক নয়।
কোচ হিসেবে ডমিঙ্গোর সীমাবদ্ধতা, ঘাটতির জায়গা অবশ্যই ছিল। দলে টানাপোড়েনের নানা গল্প তখনও শোনা গেছে। তিনি যথেষ্ট যোগ্য কি না, সেই সংশয় কখনও কখনও জেগেছে বটে। তবে পরিসংখ্যানেই পরিষ্কার এবং পারফরম্যান্সগুলো স্বাক্ষী, ওয়ানডে জয়ের একটি কার্যকর রেসিপি তার জানা ছিল। বাংলাদেশ ওয়ানডে দল অবশ্য স্থিতিশীল ছিল আগে থেকেই। বড় দল না হলেও এই সংস্করণে একটা সমীহ জাগানিয়া শক্তি হয়ে উঠেছিল হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদ ও পরে স্টিভ রোডসদের কোচিংয়ের সময় থেকেই। ডমিঙ্গো দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিও তা এগিয়ে নেন।
ডমিঙ্গোর কোচিংয়ের নানা কিছু নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এটা পরিষ্কার ছিল যে, সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা তার আছে এবং সেসব বাস্তবায়ন করার জন্য প্রক্রিয়াটাও তার জানা আছে। সেই প্রক্রিয়ার পথ ধরে ছুটে গিয়ে কখনও পিছলে পড়তে হয়েছে বটে, তবে বেশির ভাগ সময়ই বিজয়ের ঠিকানা মিলেছে।
বিশ্বকাপ পর্যন্তও তিনি কোচ থাকলে ভিন্ন ফল হতো কি না, সেই প্রশ্ন ওঠা কিংবা আক্ষেপ উঁকি দেওয়া তাই অমূলক নয়।
তিনি চলে যাওয়ার পর শুধু কোচ বদল নয়, দলের খেলার ধরন থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই বদল এসেছে। তবে দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটারের ও এই দলটার মৌলিক চরিত্র তো ডমিঙ্গোর জানা। দল থেকে দূরে থাকলেও খেলা দেখে তার বুঝে যাওয়ার কথা ভেতরের অনেক কিছু। তাছাড়া, যে সাজানো বাগান তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সেটিকে এমন তছনছ হতে দেখে তার মনের গহীনে দুঃখের বিউগলও বেজে উঠতে পারে!
কিন্তু ডমিঙ্গো অবাক করলেন দুই লাইনের আরেকটি ছোট্ট উত্তরে, “তাদের (বাংলাদেশের) খেলা আমি দেখিনি… বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলির জন্য তাদেরকে শুভ কামনা…।”
আসলেই তিনি বাংলাদেশের কোনো খেলা দেখেননি? বিশ্বাস করা কঠিন বটে। বাংলাদেশ তার সাবেক কর্মক্ষেত্র বলেই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের এমন পরিচিত একজন কোচ বিশ্বকাপে একটি দলের কোনো ম্যাচই দেখেনি, এটাই তো বিস্ময়কর।
তা তিনি বাংলাদেশের খেলা দেখুন বা সত্যিই না দেখুন, এখন আর খুব বেশি কিছু যায়-আসে না। তবে তার ছোট্ট দুটি উত্তর থেকেও চাইলে অনেক কিছু খুঁজে নেওয়া যায়। পেশাদারিত্বের এই জগতে যে কোনো কিছুই হতে পারে, সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। তার পরও, পেশাদারিত্বের মধ্যেও তো আবেগ থাকে, অনুভব থাকে। ডমিঙ্গো বাংলাদেশ দলকে গড়ে তুলছিলেন বিশ্বকাপের জন্য। পেশাদারিত্বের সঙ্গে সেখানে মানসিক সম্পৃক্ততাও তো অনেকটাই থাকার কথা।
ভাবনার খোরাকটা এখানেই। ‘বাংলাদেশ দল নিয়ে আমার মন্তব্য নেই’ কিংবা ‘তাদের খেলা আমি দেখিনি’—এসব কি স্রেফ কিছু শব্দ নাকি ডমিঙ্গোর অভিমানের রাগিনী?