বাবরের সামনে ইমরানের ছবি, বাটলারের সামনে মর্গ্যান

বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দিয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে অমরত্বের হাতছানি বাবর আজম আর জস বাটলারের সামনে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিমেলবোর্ন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2022, 07:12 AM
Updated : 12 Nov 2022, 07:12 AM

“বাবর আজম থেকে একদিন পরই আপনি হয়ে উঠতে পারেন ফতেহ আজম…”, সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নটি হতেই মৃদু হাসির রোল উঠল সংবাদ সম্মেলনে। বাবরের ঠোঁটের কোণেও খেলে গেল এক চিলতে হাসি। পরে পাকিস্তানি এক সংবাদকর্মীর কাছ থেকে জানা গেল ‘ফতেহ আজম’ মানে ‘জয়ী নেতা।’ পাকিস্তান ক্রিকেটে ‘ফতেহ আজম’ নামে পরিচিত একজনই। ১৯৯২ সালে যে মঞ্চে বিশ্বকাপ জিতিয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটে অমর হয়ে গেছেন ইমরান খান, সেই মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠেই এবার বাবরের সামনে সুযোগ, ইতিহাসে নিজের নাম খোদাই করে রাখার। 

একই হাতছানি জস বাটলারের সামনেও। আইরিশ হয়েও ওয়েন মর্গ্যান ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধ ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছেন ইংলিশদের বহু আরাধ্য ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতিয়ে। ইতিহাসে জায়গা পাকা করার সুযোগ এখন বাটলারেরও। 

ট্রফি জিতলেই অবশ্য ইমরান কিংবা মর্গ্যানের উচ্চতা স্পর্শ করার সুযোগ নেই দুজনের জন্য। ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের গুরুত্ব, ওজন ও প্রভাব অনেক বেশি। তবে শুধু এটুকুই নয়। নিজ নিজ দেশের ক্রিকেটে ইমরান ও মর্গ্যানের শ্রেষ্ঠত্ব স্রেফ বিশ্বকাপ জয় দিয়েই হয়নি। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার নায়ক দুজন। দিনের পর দিন নিজেদের নেতৃত্ব দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন তারা, নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন, অধিনায়ক ছাপিয়ে নেতা হয়ে উঠেছেন এবং সবকিছুর পূর্ণতা পেয়েছে বিশ্বকাপ দিয়ে। 

বাবর ও বাটলারকে সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ। তবে তাদেরকে সেই পথে নিশ্চিতভাবেই অনেকটা এগিয়ে দেবে এই শিরোপা জয়। এই বিশ্বকাপের বিশালত্ব হয়তো ওয়ানডের মতো নয়, তবে টি-টোয়েন্টির জগৎ তো আরও বড়, এই সংস্করণের আবেদনও ক্রমেই বাড়ছে। 

দুই দেশই যদিও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শিরোপার স্বাদ পেয়েছে। ২০০৯ সালে ইউনুস খানের নেতৃত্বে জিতেছে পাকিস্তান, পরের বছরই পল কলিংউডের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড। ১২ বছর আগের তুলনায় টি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তা ও গুরুত্বও অনেক গুণ বেশি এখন।

সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বকাপ মানে তো বিশ্বকাপই। বিশ্বের সেরা হওয়ার সুযোগ। কত কিংবদন্তি অধিনায়কের সামনে এই সুযোগ আসেনি। কত গ্রেট অধিনায়ক এই স্বাদ পাননি! বাটলার ও বাবর এই সুযোগ ক্যারিয়ারে আর পাবেন কিনা, কে জানে! 

দুজনই হয়তো বিশ্বকাপ শেষে আরও অনেক দিন নেতৃত্ব দেবেন দলকে। তবে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার সুযোগ তো সবসময় আসে না। নিজেদের পারফরম্যান্স, প্রতিপক্ষ, কত সমীকরণ, কত কিছু পক্ষে এলে তবেই না ফাইনালের মঞ্চে পা রাখার সুযোগ। বাটলার ও বাবর সেই সুযোগটা পেয়েছেন। 

সংবাদ সম্মেলনে, নানা আলোচনা আর বিশ্লেষণে তাই ঘুরেফিরেই আসছে ইমরান ও মর্গ্যানের নাম এবং তাদের পাশে নাম লেখানোর হাতছানির কথা। 

বাবর জিতলেই অবশ্য ইমরান হবেন না। ইমরান শুধু পাকিস্তানের নয়, ক্রিকেটে ইতিহাসেরই সেরাদের একজন। পাকিস্তান ক্রিকেটের ভাগ্য বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বগুণের অনেক গল্প কিংবদন্তি হয়ে আছে ক্রিকেটে। তবে বাবর অন্তত নিজের ছাপ পাকা করে ফেলতে পারেন শিরোপা জিতে। 

তার নেতৃত্বে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে হেরে যায় পাকিস্তান। সম্প্রতি তার নেতৃত্বে দল হেরেছে এশিয়া কাপের ফাইনালে। যে যত ভালো অধিনায়কই হোন না কেন, চ্যাম্পিয়ন আর রানার্সআপের পার্থক্যটা যে স্রেফ এক ম্যাচের নয়, এক জীবনের, তা প্রমাণিতই। 

বাবরও সেটা জানেন। ‘ফতেহ আজম’ হওয়ার সুযোগের কথা শুনে নিজের চাওয়াটা একটুও লুকালেন না তিনি। ১৯৯২ বিশ্বকাপে খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়ে ইমরানের ‘কর্নার্ড টাইগার্স’ ঘুরে দাঁড়িয়ে শিরোপা জয় করেছিল। এবারও প্রথম দুই ম্যাচ হেরে বাদ পড়ার শঙ্কায় থাকা দল ফাইনালে উঠে গেছে। সেই একই মাঠে এবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আশায় বাবর। 

“অবশ্যই (ছুঁতে চাই ১৯৯২ সালের সাফল্যকে) …! আমাদের শুরুটা ভালো ছিল না। এরপর যেভাবে দল ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বাঘের মতোই খেলেছে সবাই। আশা করি এটা ধরে রাখব আমরা এবং যে মোমেন্টাম আমাদের আছে, তা ফাইনালেও কাজে লাগাব। গত চার ম্যাচে দল হিসেবে যেমন, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও ছিল দারুণ কিছু।”

“আগেও আমরা বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে খেলেছি, এশিয়া কাপে ফাইনাল খেলেছি। এই ধারাবাহিকতা তাই বেশ কিছু সময় ধরেই চলছে। তবে আমাদের স্বপ্ন ট্রফি জয়ের। আমাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস আছে, পরস্পরের প্রতি আস্থা আছে যে আমরা পারব। ফাইনালে উঠেছি, চেষ্টা থাকবে ভালো করার।” 

ইমরানের চেয়ে মর্গ্যানের সময় ও বাস্তবতা ভিন্ন। তবে দুজনকে এক বিন্দুতে মেলানো যায় নানা ভাবেই। 

সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের ইতিহাস নতুন করে লেখানো, সবচেয়ে বড় মোড় নেওয়া, অতি ঐতিহ্যপ্রিয়তা আর সনাতনী মানসিকতার আশ্রয়ে ধুঁকতে থাকা দলকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে দেওয়ার নায়ক মর্গ্যান। তার সেই চার বছরের রোমাঞ্চকর অভিযান সাফল্যময় পূর্ণতায় পৌঁছে যায় ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ে। 

ইমরান-বাবরের তুলনায় মর্গ্যান-বাটলারের তুলনা কিংবা পাশে বসার ব্যাপারটি আরও বেশি মানানসই আরও অনেক দিক থেকে। মর্গ্যানের সাফল্য এখনও তরতাজা, এই তো ২০১৯ সালের কথা! তার ছায়া তাই এখনও রয়ে গেছে অনেক। এই দলে ও এই ঘরানার ক্রিকেটে তার প্রভাবও আছে। 

ইংল্যান্ড ও মর্গ্যানের সেই সাফল্যে সহ-অধিনায়ক হিসেবে যেমন, তেমনি পারফরম্যান্সেও বাটলারের ভূমিকা ছিল অনেক। তবে অধিনায়ক হিসেবে করতে পারা মানে তো পুরো ভিন্ন কিছু। 

মর্গ্যানের সঙ্গে বাটলারের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও একটা ব্যাপার। সেখানে নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করা বড় চ্যালেঞ্জ বাটলারের জন্য। ওই দলটা যেমন ‘মর্গ্যানের দল’ বলে চেনে সবাই, তেমনি ‘বাটলারের দল’ পরিচিতি গড়তেও জরুরি বিশ্বকাপ শিরোপা। 

সেমি-ফাইনালের আগের দিন বাটলারও বলেছিলেন, তার ভাবনাও অনেকটা একইরকম। 

“ওয়েনের (মর্গ্যান) সঙ্গে অনেক কথা হয় আমার। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন সে, সবসময়ই তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং সে এমন একজন, কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলেই যার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি। তবে নেতৃত্বের ব্যাপারটি হলো, সবকিছু নিজের মতো করে করাও। ওয়েন আর এখন অধিনায়ক নেই, দায়িত্বটি এখন আমার এবং আমাকে নিজের পথেই এগোতে হবে, নিজের মতো করেই নেতৃত্ব দিতে হবে।” 

“আমি সামনে তাকিয়ে আছি অনেক রোমাঞ্চ নিয়ে এবং এই ছেলেদের ওপর আমার বিশ্বাস প্রবল। কোচরা যারা আমাদের নিয়ে কাজ করছেন, তাদের ওপরও ভরসা অনেক। ওয়েন অবশ্যই খুব ভালো বন্ধু এবং আমি যদি কারও মতামত নিতে চাই, তার জ্ঞানের সেই গভীরতা আছে। তবে আমি আমার মতো করেই করতে চাই।” 

শুধু ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়াই নয়, নিজের শৈশবের স্বপ্ন, ক্রিকেটার ও অধিনায়ক হিসেবে নিজের তৃপ্তির তাড়নাও তো একটা ব্যাপার। বাটলার ফাইনালের আগের দিন শোনালেন সেই গল্পও। 

“অবশ্যই এই ধরনের কিছু করা নিয়ে স্বপ্ন ছিল আমার। ছেলেবেলায় বেড়ে ওঠার সময়, ভাই-বোনদের সঙ্গে বাড়ির আঙিনায় খেলার সময়টায় যখন আমরা ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অভিনয় করতাম, সেই সময়টায় ফিরে যাচ্ছি এখন। এখন বাস্তবেই সেটি করার সুযোগ এসেছে, অবিশ্বাস্যরকমের স্পেশাল এটি।” 

স্পেশাল বলেই আগ্রহ, রোমাঞ্চ ও কৌতূহল অনেক বেশি। অপেক্ষা স্রেফ এখন আরেকটি ধাপ এগোনোর।