রুদ্ররূপের এই মুশফিককেই তো বাংলাদেশের প্রয়োজন

বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড তিনি গড়লেন তো বটেই, নতুন ভূমিকায় নিজের উপযোগিতাও বুঝিয়ে দিলেন এই সিরিজে।

ক্রীড়া প্রতিবেদকসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2023, 01:16 PM
Updated : 20 March 2023, 01:16 PM

গ্রাহাম হিউমের ডেলিভারিটি ছিল অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে। মুশফিকুর রহিম ব্যাট চালিয়ে দিলেন চাবুকের মতো। কাভার সীমানার ফিল্ডারের বাম পাশ দিয়ে গুলির গতিতে বাউন্ডারি। আয়ারল্যান্ড অধিনায়ক অ্যান্ড্রু বালবার্নি তখন সেই ফিল্ডারকে দাঁড় করালেন একটু বামে সরিয়েই। পরের বল আবার স্টাম্পের বাইরে। এবার মুশফিকের দুর্দান্ত শট সেই ফিল্ডারের ডান পাশ দিয়ে!

ইনিংসের শেষ দিকের ছোট্ট একটি নমুনা এটি। আইরিশ বোলিং ও ফিল্ডিং নিয়ে মুশফিক এরকম ছেলেখেলা করলেন ইনিংসজুড়েই। তার ব্যাট থেকে বল ছুটতে থাকল আর উড়ে বেড়াতে লাগল উইকেটের সামনে-পেছনে, মাঠের নানা প্রান্তে। চোখধাঁধানো সব শটের জোয়ারে তার রানের স্রোত সেঞ্চুরির মোহনায় মিশে গেল এতটা দ্রুততায়, যা পারেননি বাংলাদেশের আর কেউ।

প্রায় ১৪ বছর ধরে যে রেকর্ড সঙ্গী ছিল সাকিব আল হাসানের, সেটিই এখন হয়ে গেল মুশফিকের। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান এখন অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান।

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সিলেটে শনিবার স্রেফ ৬০ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস খেললেন মুশফিক। অতীত হয়ে গেল সাকিবের ৬৩ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড।

তার গোটা ইনিংস ছিল যেমন বিনোদনদায়ী, রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরির মুহূর্তটিও হলো তেমনি নাটকীয়। শেষ ওভার শুরুর সময় শতরান থেকে তার দূরত্ব ছিল ৯ রানের। কিন্তু স্ট্রাইকে ছিলেন ইয়াসির আলি। হিউমের করা ওভারে প্রথম বলে আউট হয়ে যান ইয়াসির। দ্বিতীয় বলে সিঙ্গেল নেন তাসকিন আহমেদ।

মুশফিকের সামনে তখন লক্ষ্য ৪ বলে ৯ রানের। ফ্লিক করে দুটি রান নেন তিনি, পরের বলে দারুণ এক রিভার্স স্কুপে থার্ড ম্যান দিয়ে বাউন্ডারি। ওভারের পঞ্চম বলে আবার ২ নিয়ে এগিয়ে যান সেঞ্চুরির দুয়ারে। শেষ বলে ফ্লিক করে মিড উইকেটে ঠেলে পৌঁছে যান কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তার আগের ৮ সেঞ্চুরির সবকটিই ছিল ৪ নম্বরে। ৬ নম্বরে প্রথম সেঞ্চুরিতেই গড়লেন ইতিহাস।

নতুন ভূমিকায় তাকে পরখ করা হচ্ছে এই সিরিজ থেকেই। ওয়ানডেতে সাড়ে ৬ বছর ও ৭৫ ইনিংস পর ৬ নম্বরে ব্যাট করতে নামেন তিনি এবারের সিরিজের প্রথম ম্যাচে। সেদিনও দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন। তবে কাজটা শেষ করতে পারেননি। আউট হয়ে যান ২৬ বলে ৪৪ করে।

এই ম্যাচে সময় ছিল আরেকটু বেশি। তার মানসিকতা ও আগ্রাসন ছিল একইরকমের। অল্প সময়ের মধ্যে সাকিব আল হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্ত বিদায় নিলেও মুশফিকের ব্যাটিংয়ে ছিল না একটু সময় নেওয়া বা ধরে খেলার কোনো ব্যাপার। অভিপ্রায় ও তাড়নার ছাপ রাখেন তিনি শুরু থেকেই।

প্রথম বলে ২ রান নিয়ে শুরু। একটু পর অভিষিক্ত বাঁহাতি স্পিনার ম্যাথু হামফ্রেজকে সুইপ করে দেখা পান প্রথম বাউন্ডারির। খানিক পর কার্টিস ক্যাম্পারের বলে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ইনসাইড আউট শটে যে ছক্কাটি মারলেন, সম্ভবত দিনের সেরা শট সেটি।

ইনিংসের শুরুতে যে ইঙ্গিত মিলল তার ব্যাটিংয়ে, সেটিই ক্রমে পেল পূর্ণতা। পুল, কাট, সুইপ, ফ্লিক, গ্ল্যান্স, দারুণ সব ড্রাইভ, স্কুপ আর রিভার্স স্কুপ মিলিয়ে ইনিংসের ওয়ানডে ব্যাটিংয়ের মাস্টারক্লাস মেলে ধরলেন যেন। আইরিশদের বোলিং শক্তি অবশ্য খুব গভীর নয়। মাঠে তাদের বোলিংও ছিল কিছুটা অগোছালো। তবে সেসবের উপযুক্ত প্রাপ্তি বুঝিয়ে দিতে মুশফিকের কৃতিত্ব কম নয় মোটেও।

তার ফিফটিতে পৌঁছানোর পথে যেমন দেখা গেল। মার্ক অ্যাডায়ারের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে কাট করে চার, পরের বলে নিচু হওয়া ফুল টস পেয়ে ড্রাইভে চার, পরের বলে আবার স্টাম্পের বাইরে শর্ট বল পেয়ে কাট করে ছক্কা। ৩৩ বলে ফিফটি।

ম্যাচের তখন ৪৩ ওভার হয়ে গেছে। সেঞ্চুরি তখনও দৃষ্টিসীমায় নেই। কিন্তু মুশফিক সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলেন যেন চোখের পলকে। বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ৭ হাজার ওয়ানডে রানেও পৌঁছে গেলেন এই পথচলায়।

আরেকপ্রান্তে তাওহিদ হৃদয়ও তাকে সঙ্গ দিচ্ছেলেন দারুণভাবে। পঞ্চম উইকেট দুজনের ১২৮ রানের জুটি আসে স্রেফ ৭৮ বলে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্রুততম শতরানের জুটি এটি।

ফিফটির পরের ওভারে কার্টিস ক্যাম্পারের বলে দুজন মিলে চার মারেন ৪টি। মুশফিকের ব্যাট থেকেই আসে ৩টি। একের পর এক বাউন্ডারি আসতে থাকে। হৃদয় ফিফটির দুয়ারে গিয়ে বিদায় নিলেও মুশফিক ছুটে যান শতরানের পথে।

তার প্রথম পঞ্চাশে ছিল ৫ চার ও ২ ছক্কা। পরের ফিফটিতে বল লাগে কেবল ২৭টি, বাউন্ডারি আসে আরও ৯টি। শেষ দিকে ইয়র্কার ও বাউন্সারের মিশেলে রানের গতিতে কিছুটা রাশ টানার চেষ্টা করে আয়ারল্যান্ড। তবে মুশফিককে শেষ পর্যন্ত আটকানো যায়নি।

১৬ ইনিংস পর আবার স্বাদ পান তিনি ওয়ানডে সেঞ্চুরির। সবশেষটি ছিল ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুরে।

ওয়ানডেতে ৬ নম্বরে নেমে বাংলাদেশের পঞ্চম সেঞ্চুরি এটি। এর আগে করেছেন অলক কাপালী, সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন ও মাহমুদউল্লাহ।

শেষ বলে সিঙ্গেলটি পূর্ণ হওয়ার আগেই দুহাত দুপাশে বাড়িয়ে ডানা মেলে দেন তিনি। রান পূর্ণ করে মুষ্টিবন্ধ হাত বাতাসে ছোড়েন, আবার দুহাত বাড়িয়ে ছোড়েন হুঙ্কার। যেমন দাপুটে ইনিংস, তেমন খ্যাপাটে উদযাপন।

মুশফিকের নিজের ক্যারিয়ার যেমন আরও সমৃদ্ধ হলো এই ইনিংসে, তেমনি দলের জন্যও দারুণ সুখবর এই দুই ম্যাচে তার ব্যাটিং। চার-পাঁচে তো তিনি ভালোভাবেই সামলাতে পারেন, ছয় নম্বরের জন্যও নিজের উপযোগিতা জানিয়ে রাখলেন। বিশ্বকাপ বেশি দূরে নেই, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যই দারুণ সুখবর মুশফিকের এমন রূপ!