‘সাকিব তার ব্যাটিং ফর্মের চূড়ায় আছে’

সাকিবের মেন্টর ও বরিশালের কোচ নাজমুল আবেদীনের মতে, ২০১৯ বিশ্বকাপের চেয়েও ভালো ব্যাটিং করছেন এই অলরাউন্ডার।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2023, 06:49 AM
Updated : 21 Jan 2023, 06:49 AM

২০১৯ বিশ্বকাপের চেয়ে ভালো ব্যাটিং সাকিব আল হাসান কখনও করেছেন, এমন কিছু ভাবা কঠিন। তবে এবারের বিপিএলে তিনি ব্যাটসম্যানশিপে ছাড়িয়ে গেছেন স্মরণীয় ওই বিশ্বকাপকেও। শুনে ভ্রু কুঁচকে যেতে পারে অনেকের। তবে কথাটি যখন বলেন নাজমুল আবেদীন, তখন তা বাড়তি গুরুত্বের দাবি রাখেই! সাকিবের মেন্টর ও ফরচুন বরিশালের কোচের মতে, ২০১৯ বিশ্বকাপকেও ছাড়িয়ে এই অলরাউন্ডার এখন নিজের ব্যাটিংয়ের সর্বোচ্চ উচ্চতায় আছেন। 

এবারের বিপিএলে সাকিব অসাধারণ ব্যাটিং করে চলেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাড়ে ১৬ বছর ধরে পারফর্ম করার পর বিপিএলের মতো একটি আসরে তার কাছ থেকে নতুন কোনো বিস্ময় উপহার পাওয়া কঠিন। কিন্তু এবারের আসরে ব্যাটিং দিয়ে তিনি চমকে দিতে পেরেছেন। একইসঙ্গে তিনি আগ্রাসী, বিধ্বংসী ও ধারাবাহিক। এই ৩৬ ছুঁইছুঁই বয়সেও তিনি নিজের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংকে নতুন উচ্চতায় নিতে পেরেছেন, নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। 

সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ৩২ বলে ৬৭ রানের ইনিংস দিয়ে তার আসর শুরু। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে ভালো না করলেও পরের ম্যাচে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে তিনি খেলেন ৪৫ বলে ৮১ রানের অপরাজিত ইনিংস। সেটিকে ছাড়িয়ে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে করেন ৪৩ বলে অপরাজিত ৮৯। তার সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে এই সংস্করণে যা সর্বোচ্চ ইনিংস। সবশেষ ঢাকা ডমিনেটর্সের বিপক্ষে শুক্রবার করেন ১৭ বলে ৩০। 

সব মিলিয়ে ৫ ইনিংসে তার রান ২৭৫, টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত যা সর্বোচ্চ। ব্যাটিং গড় ৯১.৬৬, স্ট্রাইক রেট ১৯৬.৪২। ছক্কা মেরেছেন ১৫টি। দেশের কোনো ব্যাটসম্যানের বিপিএলে এই ধরনের ব্যাটিং আগে দেখা যায়নি। 

সাকিবের ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয় যেটি, প্রবল চাপের মুহূর্তেও গুটিয়ে না গিয়ে পাল্টা আক্রমণ করছেন এবং সফল হচ্ছেন ধারাবাহিকভাবে। বৃহস্পতিবারের ম্যাচে ৪৬ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর ইফতিখার আহমেদের সঙ্গে তিনি গড়েন ৮৬ বলে ১৯২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি, পঞ্চম উইকেটে যা বিশ্বরেকর্ড। শুক্রবারও ৩ উইকেট পড়ার পর ক্রিজে গিয়ে গিয়ে তিনি প্রতি-আক্রমণে পিছপা হননি। 

চট্টগ্রামে এ দিনের ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সেটিই তুলে ধরেন বরিশালের কোচ নাজমুল আবেদীন। 

“সাকিব খুব ভালো খেলছে। আমরা যদি ইফতিখারের খেলাটা লক্ষ্য করি, সে কিন্তু ওই জায়গাটায় এসে ধীরগতিতে খেলে, নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সাকিবকে মনে হয়, এসেই সেট হয়ে গেছে। ভালো রান রেট ধরে রাখতে পারে। সেটা আমাদের দলকে চাপমুক্ত রাখে সবসময়। গত কয়েক ম্যাচে সেটিই হয়েছে।”

টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ে উন্নতির ছাপটা গত বিপিএলেও কিছুটা রেখেছিলেন সাকিব। যদিও ১১ ইনিংসে রান করেছিলেন ২৮৪। এবার যা এখনই ছাড়িয়ে গেছেন। তবে স্ট্রাইক রেট গতবারও ছিল ১৪৪.১৬, তার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেটের চেয়ে যা অনেক বেশি। 

গত আসরে নাজমুল আবেদীন ফরচুন বরিশালে কাজ করেছেন মেন্টর হিসেবে। কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় তিনি তুলে ধরলেন সেই আসর থেকে সাকিবের এই আসরের ব্যাটিংয়ের নানা দিক। 

“গত বিপিএলে ও খুব ভালো খেলেছিল। বিপিএলের পর একটা যখন গ্যাপ হয়েছে, ওর নিজস্ব যে খেলার ধরন, যে স্টাইল বা টেকনিক অনুসরণ করে, একটা গ্যাপের পর আবার সেই জায়গাটিতে বোধহয় চলে গিয়েছিল। এবারও বিপিএলে আসার আগে নিজেকে যেভাবে অ্যাডজাস্ট করেছে, সেটা দারুণ।” 

“ও এত স্মার্ট এবং এত অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে, সেটা অবাক করার মতো। ও যখন বুঝতে পেরেছে, এই অ্যাডজাস্টমেন্টগুলো এই বাড়তি সুবিধা ওকে দিচ্ছে… ও যে এখন নির্দিষ্ট কিছু শট খেলছে, তা নয়, সারা মাঠ ঘিরে শট খেলছে এবং নিচে খেলছে। ওর শরীরী ভাষার মধ্যে যে কমফোর্ট আছে, ওকে কখনও মনে হয় না চাপে আছে। ও যখন থাকে, রান কখনও থেমে থাকে না। 

নিজের ব্যাটিংয়ের সীমা এবং শটের পরিধি বেড়েছে বলেই সাকিব নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিতে পারছেন বলে মনে করেন অভিজ্ঞ এই কোচ। 

“আরেকটা ব্যাপার হয়েছে, ও এখন জানে যে, দু-তিনটি ডট বল হলেও, হঠাৎ করে চার বা ছয় দরকার হলে তা মেরে দিতে পারে। এটা যে কোনো ব্যাটসম্যানকে স্বস্তি দেয়। এটা থাকলে যে কোনো ব্যাটসম্যান বড় ইনিংস খেলার চিন্তা করতে পারে। আগে কয়েকটি ডট বল খেললে পরে বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে যেত। এখন সেটা হচ্ছে না। কাজেই চাপটা অনুভব করে না। ওর শরীরী ভাষা দেখেই মনে হয়, খুব স্বস্তিতে খেলছে। নিজের ওপর বিশ্বাসটা অনেক বেশি।” 

প্রসঙ্গ যখন সাকিবের ব্যাটিংয়ের উন্নতি, ২০১৯ বিশ্বকাপ তখন আলোচনায় আসতে বাধ্য। ইংল্যান্ডে ওই বিশ্বকাপে ৮ ইনিংসে ২ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটিতে ৬০৬ রান করেছিলেন সাকিব। তার গড় ছিল ৮৬.৫৭।  বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যান ওয়ানডে বিশ্বকাপে এক আসরে চারশ রানও করতে পারেননি। আর কারও গড় ছুঁতে পারেনি ৭৫। 

নিজ থেকেই সেই বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ তুলে নাজমুল আবেদীন বললেন, এই বিপিএলের সাকিব ব্যাটসম্যানশিপে আরও ওপরে নিয়ে গেছেন নিজেকে। 

“সাকিব খুবই স্মার্ট। ও সবসময়ই খুঁজতে থাকে, কোথায় গেলে আরেকটু ভালো হওয়া যায়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমি ওর ব্যাটিং যতদিন দেখছি, ও বোধহয় নিজের ব্যাটিংয়ের চূড়ায় আছে। (২০১৯) বিশ্বকাপের কথা স্মরণ রেখেই আমি বলছি। ও এত সহজে ব্যাটিং করছে, সেটা ভাবাই যায় না।” 

প্রসঙ্গক্রমে এলো দলের অনুশীলনে সাকিবের খুব সক্রিয় না থাকার বিষয়টিও। নাজমুলের মতে, এরকম ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানের জন্য অনেক সময় অনুশীলন যেমন বাহুল্য, তেমনি ছন্দপতনের কারণও হতে পারে।

“টুর্নামেন্ট শুরুর আগে একরকম ছিল। কিন্তু শুরুর পর যখন একজন ক্রিকেটার এরকম পারফর্ম করতে থাকে, এটাই তার অনুশীলন। আজকেই ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম এটা নিয়ে। খুব ইন্টেনসিটি নিয়ে যখন ৮০ রানের ইনিংস খেলে, তার পর হঠাৎ করে গিয়ে অনুশীলন করার চেয়ে না বোধহয় করাই ভালো। অনুশীলনের ইন্টেনসিটি কিন্তু মোটেই এরকম থাকবে না। এটা শুধু একটা টুর্নামেন্টই নয়, অনুশীলনও কিন্তু! নেটে ওই ইন্টেনসিটি থাকবে না। সবসময় তাই এটা জরুরি নয়।”

ক্যারিয়ারে অনেকবারই নানা সমস্যায় কিংবা ব্যাটিং-বোলিংয়ের নানা কিছু শাণিত করতে সাকিব সহায়তা নিয়েছেন নাজমুল আবেদীনের, কাজ করেছেন নিবিড়ভাবে। সাকিবের ভেতর-বাহির তিনি জানেন ভালো করেই। দীর্ঘদিনের দেখা থেকে তার পর্যবেক্ষণ, নিজের খেলাটা যেমন খুব ভালো বোঝেন সাকিব, তেমনি খেলাটা নিয়ে তার সার্বিক বোধও তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে। 

“একজন ক্রিকেটার যখন ১৫ বছর ধরে খেলে আসছে, খেলাটা তার মুখস্থ। আজকে ওয়ার্ম আপের সময় একটা বল করেছে ও, স্রেফ একটা বল। এতেই বুঝে গেছে যে, সব ঠিক আছে। প্রাণশক্তি তাই সংরক্ষণ করে রাখে ও (ম্যাচের জন্য)। ওর সচেতনতা দুর্দান্ত, খুব লক্ষ্য করে সবকিছু।” 

“আমরা অনেক সময় মনে করি, ও বোধহয় এই-সেই করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ওর বোলিং পরিবর্তন, ওর ফিল্ডিং পরিবর্তন, কোন ব্যাটসম্যান কখন যাবে, এসব স্পট-অন। এটা এমনি-এমনি হয় না। সবার শক্তির জায়গা কোথায়, বিপক্ষে দলে কে খেলছে, ডানহাতি-বাঁহাতি, কে ভালো ফর্মে আছে, সব ওর মুখস্থ। এসব কারণেই ও ব্যতিক্রমী একজন ক্রিকেটার। স্কিল তো অনেকেরই আছে। কিন্তু এই যে মানসিকতাগুলো আছে, এটাই বোধহয় ওকে তৈরি করেছে, আজকে যে অবস্থানে আছে।” 

দেশের ক্রিকেটে দারুণ সম্মাণীয় এই কোচের বিশ্বাস, নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা এই সাকিবের কাছ থেকে বাংলাদেশ জাতীয় দলেরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে সামনে। 

“ও এখন চূড়ায় আছে। খেলাটা উপভোগ করছে, খুবই উপভোগ করছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এভাবে খেলুক। সামনে আমাদের বড় বড় টুর্নামেন্ট আছে, বিশ্বকাপ আছে। আমাদের তাকে প্রয়োজন।”