বাংলাদেশে টেস্ট খেলার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সব ক্রিকেটার নিয়ে খেলতে এসে রেকর্ড গড়া জয়ে স্বাগতিকদের হোয়াইটওয়াশ করল দক্ষিণ আফ্রিকা।
Published : 31 Oct 2024, 06:09 PM
কেশাভ মহারাজের বলে স্লগ করে লেগ সাইডে থাকা একমাত্র ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ তুলে দিলেন মুমিনুল হক। চোখ বড় বড় করে মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বোলার, তিনি নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এরপর হাসি থামেই না তার! চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাটিংয়ের প্রতীকী চিত্র বলা যায় এটিকে। বাজে, হতাশাজনক, জঘন্য, এসব তো আছেই। তবে বিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য, এসব ব্যবহার করাই যেন উপযুক্ত
জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামের ব্যাটিং স্বর্গে দুই ইনিংস মিলিয়েও ৯০ ওভার ব্যাটিং করতে পারেনি বাংলাদেশ। ম্যাচে ত্রিশ ছুঁতে পেরেছেন চার জন। এদের দুজনের মূল কাজ আসলে বোলিং। দুই ইনিংসেই সর্বোচ্চ জুটি নবম উইকেটে।
এতেই অনুমেয় ম্যাচের ফল। ব্যাখ্যাতীত ব্যাটিংয়ে ইনিংস ও ২৭৩ রানে পরাজয়ে সিরিজ শেষ করেছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের ব্যাটিং উইকেটে ম্যাচ শেষ তিন দিনেই।
তিন সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ৫৭৫ রানের জবাবে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ১৫৯ রানে। ফলো-অনে পড়ে দ্বিতীয়বার তারা অলআউট হয় ১৪৩ রানে।
প্রোটিয়াদের একমাত্র ইনিংসে ক্যারিয়ার সেরা ১৭৭ রান করেন ডি জর্জি। কোনো ইনিংসেই তার রান টপকাতে পারেনি বাংলাদেশ।
ফেবারিট হিসেবে সিরিজ শুরু করলেও ব্যর্থতার নতুন মাত্রা যোগ করে চট্টগ্রামের মাঠে এক ম্যাচে নিজেদের সর্বনিম্ন রানের নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। দুই ইনিংস মিলিয়ে তাদের সংগ্রহ মোটে ৩০২ রান। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তারা করেছিল ৩৬৬ রান।
বাংলাদেশকে বিব্রতকর পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবিয়ে নিজেদের সবচেয়ে বড় জয়ের রেকর্ড গড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্লুমফন্টেইনে ২০১৭ সালে বাংলাদেশকেই ইনিংস ও ২৫৪ রানে হারিয়েছিল তারা।
এই জয়ে প্রায় দশ বছরের অপেক্ষা ঘোচাল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০১৪ সালের অগাস্টের পর এই প্রথম এশিয়ায় সিরিজ জিতল তারা।
ব্যাটিং ব্যর্থতার নতুন গল্প লিখে বৃহস্পতিবার ১৬টি উইকেট হারায় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে দশে নেমে ৩০ রান করেন তাইজুল ইসলাম, দলের যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস। পরের ইনিংস দশে নেমে হাসান মাহমুদ করেন ৩৮, দলের সেটি সর্বোচ্চ ইনিংস।
প্রথম ইনিংসে মুমিনুল হকের ব্যাট থেকে আসে দলের পক্ষে ম্যাচের সর্বোচ্চ ৮২ রানের ইনিংস। দ্বিতীয়বার নাজমুল হোসেন শান্ত করেন ৩৬ রান। আর কেউই বলার মতো কিছু করতে পারেননি।
আগের দিন শেষ বিকেলে ৪ উইকেট হারিয়েই চাপে ছিল বাংলাদেশ। তৃতীয় দিনের শুরুতেই ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন একে একে শান্ত, মুশফিকুর রহিম, মাহিদুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান মিরাজ। রানের খাতা খুলতে ব্যর্থ হন মুশফিক ও অভিষিক্ত মাহিদুল।
পঞ্চাশের আগে ৮ উইকেট হারানো দলকে বেশ কিছু বিব্রতকর রেকর্ডের হাত থেকে বাঁচান মুমিনুল ও তাইজুল। দুজন মিলে গড়ে তোলেন ১০৩ রানের জুটি। টেস্ট ইতিহাসে পঞ্চাশের আগে ৮ উইকেট হারানোর পর এটিই সর্বোচ্চ জুটি।
লাঞ্চের পর সেনুরান মুথুসামির বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন মুমিনুল। তাইজুলকে আউট করে ইনিংস মুড়িয়ে দেন মহারাজ।
মিরপুরের পর এখানেও ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেন কাগিসো রাবাদা।
প্রথম ইনিংসে ৪১৬ রানে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে আবার ব্যাটিংয়ে নামান দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। চা বিরতির আগেই তারা নেয় ৪ উইকেট।
ফের হতাশ করেন দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম ও মাহমুদুল হাসান জয়। টিকতে পারেননি জাকির হাসানও।
প্রথম ইনিংসে ৮২ রান করা মুমিনুল এবার ফেরেন খালি হাতে। বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ শূন্যের (১৬) রেকর্ডে মোহাম্মদ আশরাফুলকে স্পর্শ করেন তিনি।
শেষ সেশনে ফুল লেংথ বলে সুইপ খেলার চেষ্টায় ব্যর্থতার ধারা দীর্ঘায়িত করে এলবিডব্লিউ হন মুশফিক। পাকিস্তান সফরে ১৯১ রানের ইনিংস খেলার পর ১০ ইনিংসে একবারও চল্লিশ ছুঁতে পারেননি অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। এই সময়ে তার সংগ্রহ সাকুল্যে ১৪০ রান।
আশা জাগানিয়া শুরু করেও ইনিংস বড় করতে পারেননি শান্ত। ৪ চার ও ১ ছক্কায় ৫৫ বলে ৩৬ রানে থামে তার ইনিংস। চলতি বছর ৮ টেস্টের ১৫ ইনিংসে মাত্র এক ফিফটিতে তার সংগ্রহ ৩১৭ রান।
এরপর মিরাজও অল্প রানে ফিরলে একশর আগে গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়ে যায় বাংলাদেশ।
নবম উইকেটে হাসানকে নিয়ে ৩৭ রানের জুটি গড়েন মাহিদুল। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, দিন পার করে দেবেন তারা। খেলা শেষ হওয়ার আগে আউট হন ১ চারের সঙ্গে ২ ছক্কায় ২৯ রান করা মাহিদুল।
পরে নাহিদ রানাকে ফিরিয়ে ৫ উইকেট পূর্ণ করেন মহারাজ।
ক্যারিয়ার সেরা ব্যাটিংয়ে ১ চার ও ৪ ছক্কায় ৩০ বলে ৩৮ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন হাসান। মূল ব্যাটসম্যানদের তখন মুখ লুকানোর জায়গাও নেই।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ৫৭৫/৬ (ইনিংস ঘোষণা)
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: (আগের দিন ৩৮/৪) ৪৫.২ ওভারে ১৫৯ (মুমিনুল ৮২, শান্ত ৯, মুশফিক ০, মিরাজ ১, মাহিদুল ০, তাইজুল ৩০, নাহিদ ০*; রাবাদা ৯-১-৩৭-৫, প্যাটারসন ১০-১-৩১-২, মহারাজ ১৬.২-৪-৫৭-২, মার্করাম ৫-১-৭-০, মুল্ডার ২-১-৫-০, মুথুসামি ৩-১-১০-১)
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: (ফলো-অনের পর) ৪৩.৪ ওভারে ১৪৩ (জয় ১১, সাদমান ৬, জাকির ৭, মুমিনুল ০, শান্ত ৩৬, মুশফিক ২, মিরাজ ৬, মাহিদুল ২৯, তাইজুল ১, হাসান ৩৮*, নাহিদ ০; রাবাদা ৭-১-১৭-০, মুল্ডার ২-০-৫-০, প্যাটারসন ৩-০-৬-১, মুথুসামি ১৩-৩-৪৫-৪, মহারাজ ১৬.৪-০-৫৯-৫, মার্করাম ২-০-৭-০)।
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংস ও ২৭৩ রানে জয়ী
সিরিজ: দক্ষিণ আফ্রিকা ২-০তে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: টনি ডি জর্জি।
ম্যান অব দা সিরিজ: কাগিসো রাবাদা।