টানা চার সেঞ্চুরির কীর্তি গড়ার পর এবার ৪৪ বলে ৮৮ রানের অপরাজিত ইনিংস, কারুন নায়ারের ব্যাটে রানের প্লাবন চলছেই।
Published : 18 Jan 2025, 09:44 AM
এবার আর সেঞ্চুরি হয়নি। ৩৫তম ওভারে ক্রিজে গিয়ে সেটা কতটাই বা সম্ভব! কিন্তু তারপরও যা করলেন কারুন নায়ার, সেটিই ফুটিয়ে তুলল তার অতিমানবীয় ফর্ম। টানা চার সেঞ্চুরির কীর্তি গড়ার পর এবার তার ব্যাট থেকে এলো ৪৪ বলে ৮৮ রানের বিধ্বংসী অপরাজিত ইনিংস। রানের প্লাবন বইয়ে দিয়ে হইচই ফেলে দেওয়া ব্যাটসম্যানের পারফরম্যান্সকে অসাধারণ বলছেন স্বয়ং ভারতের ক্রিকেট-ইশ্বর সাচিন টেন্ডুলকার।
লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে টানা আউট না হয়ে সবচেয়ে বেশি রানের বিশ্বরেকর্ড ও টানা চার ম্যাচের সেঞ্চুুরির কীর্তি আগেই গড়েছিলেন কারুন নায়ার। ভিজায় হাজারে ট্রফিতে বিদার্ভার হয়ে তার সেই অপ্রতিরোধ্য রান-রথ ছুটতে থাকে সেমি-ফাইনালেও।
মহারাষ্ট্রের বিপক্ষে বৃহস্পতিবার সেমি-ফাইনালে বিদার্ভার দুই ওপেনার ধ্রুব শোরে ও ইয়াশ রাথোড় সেঞ্চুরি করেন এবং জুটি গড়েন ২২৪ রানের। তিনে নামা কারুন ক্রিজে যান ৩৫তম ওভারের পঞ্চম বলে। টানা পাঁচ সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড যে তিনি ছুঁতে পারছেন না, তা অনেকটা নিশ্চিত তখনই।
তারপরও কারুন দেখিয়ে দেন তার ব্যাটের ধার। ফিফটি করেন ৩৫ বলে। শেষ ওভারটি শুরু করেন ৬৪ রান নিয়ে। শেষ ওভারে তিন চার ও দুই ছক্কায় তিনি তোলেন ২৪ রান। শেষ পর্যন্ত ৯ চার ও ৫ ছক্কায় ৪৪ বলে করেন ৮৮। সেঞ্চুরির ধারায় ছেদ পড়লেও অপরাজিত পথচলা ধরেই রাখেন তিনি।
তাতে ভিজায় হাজারে ট্রফিতে তার পরিসংখ্যান দাঁড়িয়েছে অবিশ্বাস্য। ৭ ম্যাচে ৫ সেঞ্চুরিতে তার রান ৭৫২। আউট হয়েছেন স্রেফ একবার। গড়ও তাই ৭৫২। স্ট্রাইক রেট তাই ১২৬।
Karun নামের বানানের সঙ্গে মিলিয়ে এখন তাকে বলা হচ্ছে ‘The KA-RUN Machine’.
তার পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় ভারতীয় ক্রিকেটে আলোড়ন চলছে বেশ কয়েক দিন ধরেই। এবার তা নজর কেড়েছে সাচিন টেন্ডুলকারের। সামাজিক মাধ্যমে তিনি উৎসাহ জোগান কারুনকে।
“৭ ম্যাচে ৫ সেঞ্চুরিতে ৭৫২ রান, অসাধারণের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এরকম পারফরম্যান্স স্রেফ হয়ে যায় না, প্রবল মনোযোগ ও কঠোর পরিশ্রম থেকে আসে এটা। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাও ও প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগাও।”
গত ২৩ ডিসেম্বর জাম্মু ও কাশ্মীরের বিপক্ষে ১১২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ভিজায় হাজারে ট্রফির অভিযান শুরু করেন তিনি। পরের ম্যাচটিতেই কেবল ফিফটি করতে পারেননি তিনি। পারবেন কীভাবে, দলের লক্ষ্যই ছিল যে ছিল ৮১! সেখানেও তিনে নেমে ৪৪ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি।
পরের ম্যাচে অপরাজিত থাকেন ১০৭ বলে ১৬৩ রান করে। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তার ক্যারিয়ার-সেরা ইনিংস।
পরের তিন ইনিংসে তার ব্যাট থেকে আসে ১০৩ বলে অপরাজিত ১১১, ১০১ বলে ১১২ ও ৮২ বলে অপরাজিত ১২২ রান। কুমার সাঙ্গাকারার টানা চার সেঞ্চুরির কীর্তি স্পর্শ করেন তখন। এরপর খেললেন এই ৮৮ রানের অপরাজিত ইনিংস।
এমন রানের জোয়ার দেখে তাকে জাতীয় দলে ফেরানোর ডাকও উঠেছে জোরেসোরে। যদিও শনিবার ঘোষিত ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে তার জায়গা হয়নি শেষ পর্যন্ত। সেটা নিয়ে বিতর্কও চলছে বেশ।
এখনও পর্যন্ত ৬ টেস্ট ও ২ ওয়ানডে খেলেছেন তিনি ভারতের হয়ে। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে আলোড়ন তুলেছিলেন। ম্যাচটি খেলার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন আজিঙ্কা রাহানে চোটে পড়ায়। তাকে নিয়ে আরও বেশি আলোচনার ঝড় উঠেছিল পরের টেস্টে। ট্রিপল সেঞ্চুরি করেও বাদ পড়েন দল থেকে, কারণ চোট কাটিয়ে ফেরেন রাহানে।
পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনটি টেস্টে চার ইনিংস খেলে আর ফিফটি করতে পারেননি। দল থেকে বাদ পড়েন। আর সুযোগও পাননি। ২০১৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুটি ওয়ানডে খেলে ৪৬ রান করেন। এরপর আর দেশের হয়ে সুযোগ মেলেনি এই সংস্করণেও।
আইপিএলে তিনি খেলেছেন দিল্লি ডেয়ারডেভিলস, রাজস্থান রয়্যালস, কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব ও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে। ২০১৪, ২০১৬, ও ২০১৮ আসরে তিনশর বেশি রান করেছেন। কিন্তু চমকপ্রদ কোনো মৌসুম কাটাতে পারেননি। ২০২২ সালের পর আইপিলেও আর দেখা যায়নি তাকে।
২০২২ সালই ছিল তার ক্যারিয়ারের চরম হতাশার মৌসুম। একসময় যে দলের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি, সেই কর্নাটাকা রাজ্য দলেও জায়গা হারান তিনি। তখন খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না কোথাও। ওই বছরের ডিসেম্বরে সামাজিক মাধ্যমে তার একটি আকুতি নাড়া দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট মহলে। টুইটারে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় ক্রিকেট, আরেকটি সুযোগ আমাকে দাও।’
২০২৩ সালেও ভাগ্য ফেরেনি তার। সেবার যদিও নর্থ্যাম্পটনশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে তিনটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। এর মধ্যে এক ম্যচে ৭৮, আরেকটিতে ১৫০ রানের ইনিংস খেলেন। অথচ কর্নাটকা থেকে বিতারিত ব্যাটসম্যান ভারতীয় ক্রিকেটে একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলারও সুযোগ পাননি ওই বছর।
তবে ক্রিকেট তাকে আরেকটি সুযোগ দিয়েছে। এক পর্যায়ে যখন টানা তিন-চার মাস বাড়িতে বসে ছিলেন, কিছু একটা খেলার আশায় তখন মুম্বাইয়ে গিয়ে পরিচিতদের অনুরোধ করে একটি স্থানীয় টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পান। সেখানেই তার দেখা হয় আবে কুরুভিল্লার সঙ্গে। সাবেক এই ভারতীয় পেসার এখন বিসিসিআইয়ের মহাব্যবস্থাপক। তাকেই কারুন অনুরোধ করেন, "আমার জন্য কি একটি দলের ব্যবস্থা করা যায়?' কুরুভিল্লা পরে কারুনকে সুযোগ করে দেন বিদার্ভা রাজ্য দলে।
কর্নাটকার কারুন এভাবেই হয়ে যান বিদার্ভার। দেড় বছর পর রাঞ্জি ট্রফিতে ফেরেন তিনি নতুন দলের হয়ে। এখনও পর্যন্ত বিদার্ভার হয়ে ১৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে রান করেছেন প্রায় ৪৩ গড়ে ৯৭৯।
এবার ভিজায় হাজারে ট্রফিতে তো বিস্ময়কর পথচলায় ছুটছেন। এই ৩৩ বছর বয়সে তাকে আবার জাতীয় দলে ফেরানোর ডাক উঠছে।
আপাতত তার সামনে এখন ভিজায় হাজারে ট্রফির ফাইনাল। সেখানে তার প্রতিপক্ষ? সেই কর্নাটকা!