টুর্নামেন্টের শুরু থেকে দারুণ ফর্মে থাকা তানজিদ হাসান ছক্কার রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি আসরে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে পেরিয়ে গেলেন চারশ রান।
Published : 22 Jan 2025, 05:21 PM
চিটাগং কিংসের ইনিংস ততক্ষণে শেষ। তড়িঘড়ি করে মাঠে ঢুকলেন স্থানীয় দলটির জার্সি পরা এক দর্শক। চিটাগং দেড়শও করতে পারেনি জানার পর তার আত্মবিশ্বাসী উত্তর, 'ভালো বোলার আছে, আমরাই জিতব।' চিটাগংয়ের বোলিং আক্রমণ নিয়ে ওই ভরসা ছিল হয়তো প্রায় পূর্ণ গ্যালারির আরও হাজার হাজার দর্শকের। কিন্তু তানজিদ হাসানের খুনে ব্যাটিংয়ে চূর্ণ হলো তাদের সেই বিশ্বাস।
আসরের শুরু থেকে দারুণ ছন্দে থাকা তানজিদ এবার জাগান টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির সম্ভাবনা। কিন্তু লক্ষ্যই যে খুব বেশি ছিল না! তার ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ৮ উইকেটের জয় পেল ঢাকা ক্যাপিটালস। হার দিয়ে চট্টগ্রাম পর্ব শেষ করল চিটাগং কিংস।
৫৪ বলে ৯০ রানের অপরাজিত ইনিংসে ৩ চারের সঙ্গে ৭টি ছক্কা মারেন তানজিদ। এবারের আসরে তার মোট ছক্কা হলো ২৯টি। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এক আসরে এটিই সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড।
গত বছর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে ১৪ ইনিংসে ২৪টি ছক্কা মেরেছিলেন তাওহিদ হৃদয়। এবার ১০ ইনিংসেই তাকে ছাড়িয়ে গেলেন তানজিদ। সব মিলিয়ে এক আসরে তানজিদের চেয়ে বেশি ছক্কা আছে শুধু ক্রিস গেইলের (৪৭টি)।
তানজিদের রেকর্ড গড়ার ম্যাচে অর্ধেক কাজ করে দেন বোলাররা। চিটাগংকে মাত্র ১৪৮ রানে আটকে রাখেন মুস্তাফিজুর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেনরা। পরে ১১ বল বাকি থাকতে ম্যাচ জিতে যায় ঢাকা।
দুই দলের প্রথম লড়াইয়ে ১৭৭ রান করেও জিততে পারেনি তারা। সিলেটে ওই ম্যাচে ৭ উইকেটে জিতেছিল চিটাগং।
এবার প্রতিশোধ নিয়ে প্লে-অফ খেলার আশাও বাঁচিয়ে রাখল ঢাকা। দশ ম্যাচে তৃতীয় জয়ে চার নম্বরে উঠে গেছে তারা। এক ম্যাচ কম খেলে পাঁচ জয়ে তাদের ঠিক ওপরে চিটাগং।
চিটাগংয়ের প্রশ্নবিদ্ধ শুরু
টস জিতে ব্যাট করতে নেমে যেন রান করার কথা ভুলেই যান নাঈম ইসলাম। শুরু করেন তিনি মেডেন ওভার খেলে। আগের ম্যাচের ম্যান অব দা ম্যাচ এবার প্রথম ২০ বলে মাত্র বাউন্ডারি মারতে পারেন স্রেফ একটি, রান তখন তার মাত্র ৭ রান। প্রথম পাঁচ ওভারে কোনো উইকেট না হারালেও মাত্র ২১ রান জমা হয় চিটাগংয়ের খাতায়।
মুস্তাফিজুর রহমানের প্রথম ওভার মেইডেন খেলেন নাঈম। প্রায় ৯ বছর পর বিপিএল খেলতে আসা ক্যারিবিয়ান পেসার রন্সফোর্ড বিটনের বলে দুটি চার মারেন বিপিএলে অভিষিক্ত আফহান ওপেনার জুবাইদ আকবারি। ষষ্ঠ ওভারে মেহেদি হাসানের বল ছক্কা মেরে স্ট্রাইক রেট কিছুটা বাড়ান আগের ম্যাচে ফিফটি করা নাঈম।
মোসাদ্দেক হোসেনের বলে বোল্ড হয়ে ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন আকবারি (১৯ বলে ২৩)। তার বিদায়ে সমাপ্তি ঘটে ৪৪ বলে ৪০ রানের জুটির।
ক্লার্ককে নিয়ে নাঈমের চেষ্টা
মন্থর শুরুর পর গ্রাহাম ক্লার্কের সঙ্গে জুটি গড়ে রান বাড়ানোর চেষ্টা করেন নাঈম। মেহেদির বলে ছক্কার পর তিনি মারেন বাউন্ডারি। দশম ওভারে প্রথম ছয়ের ওপরে ওঠে চিটাগংয়ের রান রেট।
এক ওভার পর থিসারা পেরেরার বলে একটি করে বাউন্ডারি মারেন দুই ব্যাটসম্যান। তবে ঠিক ছন্দ খুঁজে পাননি ক্লার্ক (১৮ বলে ১৯)। ত্রয়োদশ ওভারে নাজমুল ইসলামের বলে বড় শটের খোঁজে লং অফে ক্যাচ দেন চিটাগংয়ের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান।
নাঈমের সঙ্গে ক্লার্কের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৩১ বলে আসে ৪৯ রান।
আসরে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা পাকিস্তানি অলরাউন্ডার হুসাইন তালাতকে ওই ওভারেই স্টাম্পড করেন নাজমুল।
পরের ওভারে মোসাদ্দেকের শিকার নাঈম। ছক্কার খোঁজে লং অনে ক্যাচ দেন তিনি। মন্থর শুরুর পর গতি বাড়ালেও শেষ পর্যন্ত ৫ চার ও ২ ছক্কায় ৪০ বলে ৪৪ রান করে ড্রেসিং রুমে ফেরেন।
শেষের লড়াইয়ে দেড়শর কাছে চিটাগং
হায়দার আলি, মোহাম্মদ মিঠুনদের ছোট ছোট ইনিংসে শেষ ৬ ওভারে ৫১ রান যোগ করে চিটাগং। পঞ্চদশ ওভারে নাজমুলের বলে জীবন পান হায়দার। ওই ওভারের শেষ দুই বলে চার-ছক্কা মেরে বাঁহাতি স্পিনারের হতাশা বাড়ান তিনি।
এরপর আরও দুইবার ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান হায়দার। তার পরও ১১ বলে ১৬ রানের বেশি করতে পারেননি পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান।
ঝড় তুলতে পারেননি শামীম হোসেনও (১৬ বলে ১৫)।। নতুন ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ মিঠুনকে টানা ৩টি ওয়াইড করেন বিটন।
শেষ দুই ওভারে একটি করে ছক্কা মারেন মিঠুন ও সৈয়দ খালেদ আহমেদ।
আঁটসাঁট মুস্তাফিজ, উজ্জ্বল মোসাদ্দেক
মেডেন দিয়ে শুরু করা মুস্তাফিজ ৪ ওভারে খরচ করেন মাত্র ১৮ রান। পুরো স্পেলে মাত্র ২টি বাউন্ডারি হজম করেন বাঁহাতি পেসার। এছাড়া ৩ ওভারে ১৩ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন মোসাদ্দেক। এক ওভারে নাজমুলের জোড়া উইকেটও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
তানজিদের উড়ন্ত সূচনা
রান তাড়ায় প্রথম দুই ওভার দেখেশুনে কাটিয়ে দেন তানজিদ ও লিটন কুমার দাস। খালেদের বলে বাউন্ডারি মেরে ডানা মেলে দেন তানজিদ। এক বল তিনি মারেন ছক্কা। চতুর্থ ওভারে শরিফুল ইসলামের শেষ দুই বল ওড়ান ছক্কায়।
শরিফুলের বলে দ্বিতীয় ছক্কাটি ছিল চলতি আসরে তার ২৫তম। ওই ছক্কায়ই হৃদয়কে ছাড়িয়ে যান তানজিদ।
বাঁহাতি ওপেনারের ঝড়ে পাওয়ার প্লেতে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৫৭ রান করে ঢাকা।
জবুথবু লিটন
অন্যপ্রান্তে তানজিদ একের পর এক স্ট্রোক খেললেও ঠিক ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না লিটন। তার বেশ কিছু শট আটকে যায় ত্রিশ গজের বৃত্তের ফিল্ডারের হাতে। কয়েকটি বলে ঠিকঠাক টাইমিংও করতে পারেননি আগের ম্যাচে চমৎকার ফিফটি করা ব্যাটসম্যান।
নবম ওভারে তালাতের বলে ছক্কা মারার চেষ্টায় ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন লিটন। ২৫ রান করতে তিনি খেলেন ২৮ বল। লিটনের বিদায়ে ভাঙে ৫৪ বলে ৭৫ রানের জুটি।
তানজিদের ব্যাটেই ঢাকার জয়
উদ্বোধনী সঙ্গীকে হারালেও অবিচল থাকেন তানজিদ। দশম ওভারে আরাফাত সানির বল ছক্কায় মেরে ২৮ বলে ফিফটি করেন ২৪ বছর বয়সী ওপেনার। চলতি আসরে তার তৃতীয় পঞ্চাশ এটি। সঙ্গে আছে একটি সেঞ্চুরিও।
তিন নম্বরে নেমে একদমই সুবিধা করতে পারেননি একাদশে ফেরা মুনিম শাহরিয়ার। আলিস আল ইসলামের বলে ক্রিজ ছেড়ে মারার চেষ্টায় বোল্ড হন তিনি। ১২ রান করতে খেলে ফেলেন ১৮ বল।
তবে তানজিদ একই ছন্দে খেলতে থাকায় রানের চাপে পড়েনি ঢাকা। চার নম্বরে নামা সাব্বির রহমানও ইতিবাচক ব্যাটিং করেন শুরু থেকেই। খালেদের বলে চমৎকার লফটেড ড্রাইভে ছক্কা মারেন তিনি।
খালেদের পরের ওভারে ফ্লিক করে নিজের সপ্তম ছক্কাটি মারেন তানজিদ। পরে শরিফুলের বলে ম্যাচ জেতানো শটটিও তার ব্যাট থেকেই আসে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
চিটাগং কিংস: ২০ ওভারে ১৪৮/৬ (নাঈম ৪৪, আকবারি ২৩, ক্লার্ক ১৯, তালাত ২, শামীম ১৫, হায়দার ১৬, মিঠুন ১২, খালেদ ৮*; মুস্তাফিজ ৪-১-১৮-০, বিটন ৪-০-৩৫-১, মোসাদ্দেক ৩-০-১৩-২, মেহেদি ৪-০-৩১-১, পেরেরা ২-০-২০-০, নাজমুল ৩-০-২৭-২)
ঢাকা ক্যাপিটালস: ১৮.১ ওভারে ১৪৯/২ (তানজিদ ৯০*, লিটন ২৫, মুনিম ১২, সাব্বির ১৪*; শরিফুল ৩.১-০-৩৯-০, আলিস ৪-০-১৮-১, খালেদ ৪-০-৩৬-০, সানি ৩-০-২৪-০, তলত ৩-০-২৩-০, নাঈম ১-০-৪-০))
ফল: ঢাকা ক্যাপিটালস ৮ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: তানজিদ হাসান