হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদের মতো সাবেক অধিনায়কের বিশ্বাস, খেলা ছাড়লেও মাহমুদউল্লাহর কাছ থেকে অনেক কিছু পেতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট, তার হাত ধরে এগিয়ে যেতে পারে নতুন প্রজন্ম।
Published : 13 Mar 2025, 09:05 AM
চোটের কারণে ভারতের বিপক্ষে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম ম্যাচ খেলতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। নিউ জিল্যান্ড ম্যাচে একাদশে ফিরলেও রানের দেখা পাননি। তবে এর আগে দারুণ ফর্মে ছিলেন তিনি। টানা চার ওয়ানডেতে খেলেছিলেন পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস। তবু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শেষ হতেই ভবিষ্যৎ নিয়ে উঠতে শুরু করে নানান প্রশ্ন।
এসবের মাঝে একরকম অভিমান রেখেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিলেন ৩৯ বছর বয়সী ক্রিকেটার। শেষটা ঠিক মনমতো না হলেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে মাহমুদউল্লাহর সামনের জীবনেও সাফল্যময় পথচলা দেখার কথা বললেন হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ ও হান্নান সরকার। সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া বার্তায় শুভকামনা জানালেন নাফিস ইকবাল।
হাবিবুল বাশার
ইতিহাসের সেরা ফিনিশার
“সত্যিকারের একজন ম্যাচ উইনার এবং সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ফিনিশার। অনেক লম্বা ক্যারিয়ার। অগণিত ভালো ভালো ইনিংস আছে। বিশেষ করে (২০১৭) চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে যে সেঞ্চুরিটা করেছিল, ওইটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা বিশেষ অধ্যায়। বিশ্বকাপে তিনটা সেঞ্চুরি... সব মিলিয়ে স্মরণীয় অনেক অনেক ইনিংস আছে। অনেকগুলো এখন মাথায় ঘুরছে। তবে একটা কথা জোর দিয়েই বলতে চাই, বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। খেলার সময় তো দিয়েছেই, খেলা ছাড়ার পরেও সে দেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিতে পারবে।”
এখনও প্রাপ্তির আছে অনেক কিছু
“একদম ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট নিয়েই মাহমুদউল্লাহর জীবনটা কেটেছে। এই খেলার সঙ্গে তার পুরোটা সময় কেটেছে। তাই ক্রিকেট ছাড়া থাকাটা তার জন্য একটু কষ্টকর হবে। যেটা হয় সাধারণত, অবসর নেওয়ার পর শুরুর কয়েক দিন নিয়মিত রুটিনে একটা পরিবর্তন আসে। যে কারণে অনেক সময় শূন্যতা অনুভব হয়। তবে কিছু দিন পর মানিয়ে নিতে পারবে। আমার বিশ্বাস, কোনো না কোনো ভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে থাকতে পারে মাহমুদউল্লাহ। আমি নিশ্চিত তার কাছ থেকে এখনও সামনে অনেক কিছু পেতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট।”
খালেদ মাসুদ
অবসর জীবনে শুভকামনা, সঙ্গে আক্ষেপ
“মাহমুদউল্লাহও ফেইসবুকে অবসরের ঘোষণা দিল? আহহা! অবসরের কথা শুনতে তো নিশ্চিতভাবেই ভালো লাগে না। তবু মাহমুদউল্লাহকে বিদায়ী শুভেচ্ছা। তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভকামনা থাকবে। পরবর্তী ইনিংসটা যেন সুন্দর ও ভালোভাবে কাজে লাগায় এই আশা থাকবে। ক্রিকেটে তার অনেক কিছু দেওয়ার আছে।”
“অবসরটা যদি মাঠ থেকে হতো, তাহলে আরও ভালো লাগত। সিদ্ধান্ত অবশ্যই তার নিজের। যেটা ভালো মনে করেছে, সেটাই করেছে। আমি বলব, এসব অবসরের সিদ্ধান্তগুলো আরও সহজ হতো, যদি নির্বাচকরা আগে থেকে তাদেরকে একটা সার্বিক ধারণা দিয়ে দিতো। টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে যদি আগে থেকেই একটা আলোচনা করত যে, আমরা তোমাকে এতদিন পর্যন্ত রাখব বা এরপর আর রাখব না। তোমার জন্য সুন্দর একটা বিদায়ের পথ তৈরি করে দিতে চাই। এভাবে সুন্দর একটা আলোচনা হলে বিদায়গুলো আরও ভালো হতো, মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারত ক্রিকেটাররা। এটা খুবই সম্ভব ছিল।”
যথাযথ সম্মানটা পেল না
“এসব ক্রিকেটাররা এত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। এরপর যদি তারা এভাবে অবসরে যান, সেটা ভালো নয়। আমার মনে হয়, আমরা ভালো সংস্কৃতি তৈরি করতে পারলাম না। ভালো কোনো দৃষ্টান্ত রইল না।”
“আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় ব্যাপার ১৫-১৬ বছর টানা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা। এত লম্বা সময় নিজেকে ধরে রাখা সহজ নয়। ২০-২৫ বছর আগে হয়তো সহজ ছিল। কারণ তখন অল্প খেলা ছিল। এখন তো ব্যস্ততা অনেক, প্রচুর খেলা। এর মধ্যে সব চাপ সয়ে, পারফর্ম করে... মাহমুদউল্লাহ কিন্তু এমন না যে অধারাবাহিক পারফর্মার, ভালো পারফর্মার ছিলেন। সবসময় দলে অবদান রেখে আসছিলেন। এরকম একজন ক্রিকেটারের এভাবে অবসরে যাওয়া... আমার মনে হয়, আমরা তাদের যথাযথ সম্মানটা দিতে পারলাম না।”
পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়ার যোগ্য একজন
“আমাদের কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাস খুব বেশি সমৃদ্ধ নয়। শুরুর দিনগুলোর কথা যদি বলেন, রকিবুল ভাই বা বাদশাহ ভাই বা তাদের সময়ে যারা ছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কিন্তু তেমন খেলতেন না। এখন যেটা হয়েছে, অনেক খেলা বেড়েছে। অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি হয়। এখন তামিম, মুশফিক বা মাহমুদউল্লাহর যে অভিজ্ঞতা, এটা আমাদের দেশের কারও নেই। আমি মনে করি, এখন কোনো না কোনো জায়গা বের করে তাদের কাজে লাগানো উচিত বিসিবির। তাদের থেকে জানা উচিত যে, তারা কোথায় কীভাবে দেশের ক্রিকেটকে সাহায্য করতে পারে। তাদেরকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো উচিত হবে। তাহলে অনেক ভালো হবে। টাকা-পয়সা বা সম্মান, জনপ্রিয়তা- সবই পেয়েছেন তারা। এখন পরবর্তী প্রজন্মকে কিছু দেওয়ার জন্য তারাই যোগ্য ব্যক্তি।”
হান্নান সরকার
বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিংবদন্তি
“বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে উত্থান, বিশ্ব মঞ্চে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখানো বা দেশের ক্রিকেটকে একটা ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়া, বিশ্বের সব জায়গায় বাংলাদেশ ক্রিকেটে পরিচয় করিয়ে দেওয়ানোর ক্ষেত্রে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তার জায়গা থেকে সর্বোচ্চটাই দিয়ে গেছে। আইসিসি টুর্নামেন্টে তার পারফরম্যান্স তো আমাদের সবারই জানা। রিয়াদের বিষয়ে আলাদা করে বলতে চাইলে, অনেক কিছুই বলা যাবে। তবে এক কথায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে বৈশ্বিক যে কয়েকজন কিংবদন্তি আছেন, সেই তালিকায় অবশ্যই রিয়াদকে রাখা যাবে।”
হৃদয়ের খুব কাছে টি-টোয়েন্টি অবসরের স্মৃতি
“মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে আমি কখনও খেলিনি বা প্রতিপক্ষ হিসেবেও পাইনি। তাই খেলোয়াড় হিসেবে ওর সঙ্গে কোনো স্মৃতি নেই। তবে জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক ভালো সময় কেটেছে ওর সঙ্গে। সামনাসামনি বা ফোনে যে কথোপকথন হতো, সেগুলো আমার জন্য অনেক ভালো স্মৃতি।”
“সাম্প্রতিক অতীতের একটা কথা যদি বলি, যখন টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিল, সিদ্ধান্তটা জানানোর ক্ষেত্রে ও আমাকেই বেছে নিয়েছিল। আমি তখন নির্বাচক ছিলাম। আমাকে বলেছিল, 'হান্নাই ভাই, আমি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি (প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন) লিপু ভাই ও (নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক) রাজ ভাইকে বলবেন দয়া করে।' সাম্প্রতিক অতীতে ওর সঙ্গে এটা আমার একটা ভালো স্মৃতি।”
দেশের ক্রিকেটের প্রয়োজন তাকে
“আমার প্রত্যাশা থাকবে অবশ্যই মাহমুদউল্লাহর মতো একজন সফল ও অভিজ্ঞ ক্রিকেটার যেন ক্রিকেটেই থাকে। এরকম ক্রিকেট ব্যাকগ্রাউন্ডের একজন ব্যক্তিত্বের ক্রিকেটে অবদান রাখার অনেক ক্ষেত্র আছে। তার সেই মেধাও আছে। যথেষ্ট স্মার্ট ও সামর্থ্যবান। আমার মনে হয়, যে দায়িত্বেই হোক, মাহমুদউল্লাহ যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটে থাকার চিন্তা করে, তাহলে শতভাগ নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক উপকৃত হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ওর ভূমিকা মাঠে যেমন ছিল, মাঠের বাইরেও যেন তেমন থাকে, সেই প্রত্যাশাই রাখব।”
নাফিস ইকবাল
লেগ্যাসি থাকবে
“মাহমুদউল্লাহ, কী দুর্দান্ত এক ক্যারিয়ার ছিল তোমার। একজন সতীর্থ হিসেবে তোমার সঙ্গে মাঠে খেলা, পরে টিম ম্যানেজারের ভূমিকায় একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া সত্যিই অনেক সম্মানের। তোমার নিবেদন, দৃঢ়তা ও নেতৃত্ব বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক অমলিন ছাপ রেখে গেছে।”
“চাপের মুখে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক জয়গুলোতে তোমার অসামান্য অবদান- সবকিছুই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তোমার সুস্থির স্বভাব ও দলের প্রতি অবিচল প্রতিজ্ঞা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।”
“জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রাখার মুহূর্তে জেনে রাখো, তোমার লেগ্যাসি চিরকাল ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে অটুট থাকবে। তোমার ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা। সামনের জীবনে সাফল্য, সুখ ও পরিপূর্ণতা কামনা করছি। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ, ‘সাইলেন্ট কিলার’!”