দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি এটি, দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে প্রথম তো বটেই। রেকর্ড-পরিসংখ্যান-ইতিহাস, এসব তো গড়া হলোই। তবে ম্যাচের বিচারে জয়ের ইনিংসের গুরুত্ব ও মাহাত্ম আরও বেশি।
কয়েকটি সংখ্যাতেই তা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা যায়। জয়ের ব্যাট থেকে এসেছে ১৩৭ রান। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস স্রেফ ৪১ রানের। ৩২৬ বল খেলেছেন জয়, দলের আর কেউ খেলতে পারেননি ১০০ বলও!
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ লিড পায়নি। খুব শক্ত অবস্থানেও নেই। তবে লড়াইয়ে টিকে আছে। সেটির কৃতিত্ব ২১ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যানের।
আলোকস্বল্পতা আর বৃষ্টিতে তৃতীয় দিনের খেলার সমাপ্তি ১৭ ওভার আগেই। প্রথম ইনিংসে ৬৯ রানের লিড দক্ষিণ আফ্রিকা আরেকটু বাড়িয়ে ততক্ষণে দক্ষিণ আফ্রিকা এগিয়ে ৭৫ রানে। দিনের নায়ক তবু একজনই। মুগ্ধতার ঘোর লাগিয়ে জয় উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটি।
৪ উইকেটে ৯৮ রানের নড়বড়ে অবস্থায় থেকে দিনের শুরু করে বাংলাদেশ। নাইটওয়াচম্যান তাসকিন আহমেদকে দিনের তৃতীয় ওভারেই ফিরিয়ে অভিষিক্ত লিজাড উইলিয়ামস স্বাদ পান প্রথম টেস্ট উইকেটের।
এরপরই বাংলাদেশ পায় দিনের সেরা সময়টুকু আর ইনিংসের সর্বোচ্চ জুটি। জয়ের সঙ্গী সেখানে দারুণ ফর্মে থাকা লিটন কুমার দাস।
আগের দিন ১৪১ বলে ৪৪ রান করে অপরাজিত ছিলেন জয়। নতুন দিনেও শুরু করেন সেখান থেকেই। ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে উইকেট আঁকড়ে রাখেন। নিজের জোনের বাইরে শট খেলেননি একটিও। অফসাইডে পাতা ফাঁদে পা বাড়াননি একটুও। ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো তিনি পড়ে থাকেন উইকেটে।
লিটন ছিলেন উল্টো রথের যাত্রী। উইকেটে যাওয়ার পরপরই ডুয়ান অলিভিয়েরকে এক ওভারে দুটি বাউন্ডারি মারেন, একটি দুর্দান্ত পুল শটে, আরেকটি নান্দনিক স্কয়ার ড্রাইভে। শট খেলার তাড়নায় বিপদও ডেকে আনেন। ১৬ রানে বেঁচে যান ডিন এলগার স্লিপে সহজ ক্যাচ ছাড়ায়। ৩৯ রানে আরেক দফায় রক্ষা পান ক্যাচ দিয়ে।
শেষ পর্যন্ত সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে ইনিংস বড় করতে পারেননি লিটন। দক্ষিণ আফ্রিকার অপেক্ষা যখন দ্বিতীয় নতুন বলের, ঠিক এর আগের ওভারে তারা পেয়ে যায় ‘বোনাস।’ লিজাড উইলিয়ামসের একটু নিচু হওয়া ভেতরে ঢোকা বলে বোল্ড লিটন।
৪১ রানে ফেরেন তিনি, জুটি থামে ৮২ রানে।
জয় ফিফটি পেয়ে গেছেন এর বেশ আগেই। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে ৭৮ রানের ইনিংসের পথে পঞ্চাশ ছুঁয়েছিলেন ১৬৫ বলে, এবারের পঞ্চাশ ১৭০ বলে।
পরে তিনি ছাড়িয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের রেকর্ড মুমিনুল হকের ৭৭ রানকে। ইয়াসির আলি চৌধুরির সঙ্গেও আরেকটি জুটি গড়ে ওঠে।
ইয়াসির বেশ ভালো শুরু করেছিলেন। কিন্তু সম্ভাবনাময় ইনিংসটি আর এই জুটি শেষ হয় বাংলাদেশের জন্য চরম হতাশায়। অযথা দুই রানের চেষ্টায় আত্মঘাতী দৌড়ে রান আউট হয়ে ফেরেন ইয়াসির (২২)।
বাংলাদেশ তখনও দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে অনেকটা পেছনে। মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে সেই ব্যবধান কমান জয়।
এই জুটির পথচলাতেই জয় পৌঁছে যান তিন অঙ্কের কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। ৬ ঘণ্টার বেশি ক্রিজে থেকে ২৬৯ বল খেলে স্পর্শ করেন সেঞ্চুরি। মাইলফলক উদযাপন করেন শূন্যে লাফিয়ে আর মুক্তো ঝরানো হাসিতে।
আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে মিরাজ শুরু করেন সাবলিল ব্যাটিংয়ে। ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে তিনিও খেলেন দারুণ কিছু শট। গড়ে ওঠে আরেকটি অর্ধশত রানের জুটি।
মিরাজকে ২৯ রানে থামিয়ে ৫১ রানের জুটি ভাঙেন ভিয়ান মুল্ডার। তখন বাকি স্রেফ দুই টেলএন্ডার। জয় তখন দেখান তার ব্যাটিংয়ের আরেক রূপ। সাইমন হার্মারের বলে মারেন চার ও ছক্কা। মুল্ডারের এক ওভারেই মারেন চারটি চার। শট খেলতে থাকেন উইকেটের চারপাশে। বাড়তে থাকে রান।
শেষ জুটির সময় ‘ক্যারিং দা ব্যাট থ্রু আ কমপ্লিটেড ইনিংস’ কীর্তি গড়ার হাতছানি ছিল জয়ের সামনে। তবে নিরাপদ পথে না হেঁটে তিনি ভাবেন দলের রান বাড়ানোর কথা। সেই চেষ্টায়ই শেষ পর্যন্ত আউট হয়ে যান শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে। দল ততক্ষণে তিনশর কাছে। আর জয় পৌঁছে গেছেন ইতিহাসের ঠিকানায়।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ৩৬৭
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: (আগের দিন ৯৮/৪) ১১৫.৫ ওভারে ২৯৮ (জয় ১৩৭, তাসকিন ১, লিটন ৪১, ইয়াসির ২২, মিরাজ ২৯, খালেদ ০, ইবাদত ০*; অলিভিয়ের ১৫-৫-৩৬-১, উইলিয়ামস ১৮.৫-৩-৫৪-৩, হার্মার ৪০-১২-১০৩-৪, মহারাজ ৩৭-১৫-৬৫-০, এলগার ১-০-৮-০, মুল্ডার ৪-১-২৩-১)।
দক্ষিণ আফ্রিকা ২য় ইনিংস: ৪ ওভারে ৬/০