কোষাগার ছিল শূন্য, ভিত্তি ছিল নড়বড়ে। দেশের ক্রিকেটের টালমাটাল সেই সময়ে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন যারা, তাদেরই একজন রাইসউদ্দিন আহমেদ। অসংখ্য প্রতিকূলতা পেরিয়ে দেশের ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন যিনি, তিনি এবার পাড়ি জমালেন পরপারে। ৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন বিশিষ্ট এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।
Published : 20 Jan 2021, 02:00 PM
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি হন রাইসউদ্দিন। পরে কোভিড নেগেটিভও হন। তবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন নিউমোনিয়ায়। পাশাপাশি শারীরিক জটিলতা ছিল আরও। বুধবার সকালে হাসপাতালেই মারা যান তিনি।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সেই সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিবি) জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন রাইসউদ্দিন। পরে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ছিলেন বোর্ডের সহ-সভাপতি। বাংলাদেশে প্রথম কোনো বিদেশি দলকে আমন্ত্রণ জানানো, আইসিসির সদস্যপদ পাওয়া, সবই ছিল তার উদ্যোগে।
বাংলাদেশ বিমানের চিফ অব অ্যাডমিন ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে লন্ডন যাওয়া হতো তার প্রায়ই। এমসিসিতে (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব) তার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। সেই সম্পর্ক থেকেই তিনি এমসিসি দলকে আমন্ত্রণ জানান বাংলাদেশে। ১৯৭৭ সালে সফরে আসে অভিজাত এই ক্লাব। বাংলাদেশ বিমান থেকে টিকেটের ব্যবস্থাও করেছিলেন তারা। বাংলাদেশ ক্রিকেটে স্পন্সর প্রথাও শুরু হয় তখন থেকে।
সেই সফর থেকে ফিরে এমসিসি দল ইতিবাচক রিপোর্ট দেওয়ার পরই বাংলাদেশের আইসিসি সহযোগী সদস্যপদ হওয়ার পথ খুলে যায়।
শুধু এমসিসিই নয়, রাইসউদ্দিনদের উদ্যোগে সেসময় শ্রীলঙ্কা, হায়দরাবাদ ব্লুজ, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন বিদেশি দল আসে বাংলাদেশ সফরে। ক্রিকেট দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেই দলগুলির সঙ্গে ম্যাচ আয়োজন করা হয় ঢাকার বাইরেও। দেশে স্কুল ক্রিকেট চালু হয়েছিল তার উদ্যোগেই।
২০১৭ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাইসউদ্দিন তুলে ধরেছিলেন তাদের শুরুর সময়ের লড়াইয়ের কথা।
“১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে যখন দায়িত্ব নিই, তখন অবস্থা খুব খারাপ। বোর্ডের কোষাগার শূন্য। এমনও দিন গেছে যে বিদ্যুতের বিল দেওয়ার টাকা পর্যন্ত বোর্ডের নেই। মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করেছি আমরা। রেডক্রস থেকে দুধ এনে, হাই প্রোটিন বিস্কুট এনে খেলোয়াড়দের খাইয়েছি। যখন তা পারিনি, অনুশীলনের পর ক্রিকেটারদের কলা-বনরুটি খেতে দিতাম।”
“এই যে এমন কঠিন সময়, তখনও আমি স্বপ্ন দেখতাম। এখন যখন দেখি সত্যি বিশ্ব পর্যায়ের ক্রিকেটে সবার সঙ্গে সমানতালে লড়ছে বাংলাদেশ, গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।”
১৯৮১ সালে বোর্ড ছেড়ে দেওয়ার পর আবার তিনি ফেরেন ১৯৯১ সালে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ‘এ’ দলগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় দল নিয়ে সার্ক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালুর পেছনে তখন তার ছিল বড় ভূমিকা। বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাওয়ায় ওই টুর্নামেন্ট ছিল বড় সহায়ক। রাইসউদ্দিন এই দফায় দায়িত্বে থাকার সময়ই বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে, ওয়ানডে ও টেস্ট মর্যাদা পায়। ২০০১ সালের পর আর বোর্ডে থাকেননি তিনি।
সংগঠক হিসেবে বেশি পরিচিতি থাকলেও স্বাধীনতার আগে তিনি ছিলেন দক্ষ ক্রীড়াবিদ। ভিক্টোরিয়ার হয়ে খেলেন ফুটবল-ক্রিকেট দুটোই। ফুটবলে তার পরের ক্লাব ছিল ওয়ান্ডারার্স। ক্রিকেটে খেলেন পরে ঈগলেটসে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতেও। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বাস্কেটবলে পূর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক ছিলেন, পরে হন কোচ। শীর্ষ পর্যায়ে খেলেছেন ভলিবলও। ১৯৬৯ সালে ঢাকায় পাকিস্তান-নিউ জিল্যান্ড টেস্ট ম্যাচে ধারাভাষ্যও দিয়েছেন।
তবে সংগঠক হিসেবে তার পরিচয় ছাপিয়ে গেছে আর সব কিছুকে। খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই ছিলেন দারুণ সাংগঠনিক। ১৯৬৫ সালে হন পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের সেক্রেটারি। সংগঠক হিসেবে পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি। ১৯৮২ সালে পান এমসিসির আজীবন সদস্যপদ পাওয়ার সম্মান।
এবার কোভিড আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই নানা রোগে তিনি ছিলেন কাবু। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বিসিবি।