ব্যাটসম্যানকে ছাতার মতো ঘিরে একগাদা ফিল্ডার। রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। প্রতিটি বলে পাকিস্তানের যাত্রা জয়ের সমান এক ড্রয়ের পথে। কিউইদের চিন্তা ক্রমশ বাড়ন্ত। অবশেষে সবকিছুর সমাপ্তি। নাসিম শাহর ব্যাট ছুঁয়ে আসা বল দারুণ এক ফিরতি ক্যাচ নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লেন মিচেল স্যান্টনার। আবেগের প্রকাশে বরাবরই পরিমিত যিনি, সেই কেন উইলিয়ামসনও মেতে উঠলেন বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে।
Published : 30 Dec 2020, 11:52 AM
এই জয়ের মাহাত্মই আসলে এমন। ফাওয়াদ আলমের বিরোচিত সেঞ্চুরি আর মোহাম্মদ রিজওয়ানের সঙ্গে দুর্দান্ত জুটির প্রতিরোধের দেয়াল ভেঙে, শেষ জুটির লড়াই থামিয়ে, রোমাঞ্চের নানা মোড় পেরিয়ে তবেই না ধরা দিল এই জয়! পাশাপাশি এই জয় উইলিয়ামসনদের এনে দিল অনির্বচনীয় এক স্বাদও।
মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে পাকিস্তানকে ১০১ রানে হারিয়ে ২ ম্যাচ সিরিজে এগিয়ে গেল নিউ জিল্যান্ড। এই জয়ে কিউইরা নিশ্চিত করল নিজেদের সুদীর্ঘ টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবার আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠা।
টেস্টের শেষ দিনে বুধবার পাকিস্তান দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ২৭১ রানে।
১০১ রানের জয়ে যা ফুটে ওঠে, বাস্তবতা ছিল তার উল্টো। শেষ জুটিতে শাহিন শাহ আফ্রিদি ও নাসিম উইকেটে কাটিয়ে দেয় প্রায় ৮ ওভার। নাসিমের বিদায়ে ম্যাচ যখন শেষ হলো, ড্রয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল মাত্র ৪.৩ ওভার!
এই সম্ভাব্য ড্র, এমনকি এক পর্যায়ে অভাবনীয় এক জয়ের প্রেক্ষাপটও পাকিস্তান রচনা করেছিল ফাওয়াদ আলমের ব্যাটে। ১০ বছর পর তিনি টেস্ট দলে ফিরেছেন গত বছর ডিসেম্বরে। গত অগাস্টে ইংল্যান্ডে গিয়ে ২ টেস্ট খেলে সুবিধা করতে পারেননি। এই টেস্ট হয়তো ছিল তার জন্য শেষ সুযোগ। অসাধারণ এক সেঞ্চুরিতে ৩৫ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান শুধু জায়গা ধরে রাখাই নিশ্চিত করেননি, পাকিস্তানের অনুনমেয় চরিত্রের প্রকাশও ফুটিয়ে তোলেন আরেকবার।
ম্যাচ বাঁচানোর লড়াইয়ে পাকিস্তান বড় ধাক্কা খায় দিনের শুরুতেই। দ্বিতীয় ওভারে ট্রেন্ট বোল্টকে বাউন্ডারি মারার পরের বলেই আলগা শটে বিদায় নেন অভিজ্ঞ আজহার আলি (১২০ বলে ৩৮)।
পাকিস্তানের আরেকটি ব্যাটিং বিপর্যয় তখন অস্বাভাবিক কিছু হতো না। কিন্তু ফাওয়াদ ও রিজওয়ান মিলে মেলে ধরেন স্কিল, টেকনিক আর প্রতিজ্ঞার প্রদর্শন। বলের পর বল, ওভারের পর ওভার কাটিয়ে দেন দুজন।
সময় গড়াল, রানের ধারাও বেগবান হতে থাকল। চিন্তার ভাঁজ পড়ল কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের কপালে। রোমাঞ্চ ছড়াল পাকিস্তানের ড্রেসিং রুমে।
এক পর্যায়ে এই জুটিতে রান আসছিল ওভারপ্রতি সাড়ে চারের বেশি। পাকিস্তানের জয় তখন মনে হচ্ছিল খুবই সম্ভব!
কিউইদের স্বস্তি দেন কাইল জেমিসন। নিজের ২৬তম জন্মদিনে দলকে দারুণ এক উপহার দেন দীর্ঘদেহী এই পেসার। তীক্ষ্নভাবে ভেতরে ঢোকা দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দেন রিজওয়ানকে।
আম্পায়ার আউট না দিলেও রিভিউ নিয়ে নিউ জিল্যান্ড ভাঙতে পারে ৩৮৮ বলে ১৬৫ রানের জুটি। প্রথম ইনিংসে ৭১ রানের পর পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক রিজওয়ানের প্রাপ্তি দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯১ বলে ৬০।
এর আগেই নিল ওয়্যাগনারের বলে দুর্দান্ত এক পুল শটে বাউন্ডারি মেরে তিন অঙ্কে পা রাখেন ফাওয়াদ। ২০০৯ সালে অভিষেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরিটির সাড়ে ১১ বছর পর আবার শতরানের স্বাদ পেলেন এই বাঁহাতি। যদিও এটি তার মাত্র ষষ্ঠ টেস্ট।
রিজওয়ানের বিদায়ের পর বেশিক্ষণ লড়াই চালাতে পারেননি ফাওয়াদ। ওয়্যাগনারের রাউন্ড দা উইকেটে করা লেগ স্টাম্পের বাইরের শর্ট বল পুল করতে গিয়েই গড়বড়, বল তার গ্লাভসে লেগে আশ্রয় নেয় কিপারের গ্লাভসে।
সাড়ে ৬ ঘণ্টার লড়াই শেষে ২৬৯ বলে ১০২ রান করে ফাওয়াদ মাঠ ছাড়েন মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। দর্শকদের অভিনন্দনের জবাবে ব্যাট উঁচিয়ে ধরছিলেন বটে, কিন্তু চোখে-মুখে তখন রাজ্যের হতাশা।
জেমিসন এরপর ইয়াসির শাহকে ফেরান শূন্যতে। উইলিয়ামসন দারুণ এক সিদ্ধান্ত নেন আক্রমণে স্পিন এনে। স্যান্টনার থামান ২৬ বল খেলে ফেলা মোহাম্মদ আব্বাসকে (১)।
পাকিস্তান তবু হাল ছাড়েনি। শেষ উইকেটে শাহিন আফ্রিদি ও নাসিম চালিয়ে যান লড়াই। একটু একটু করে উজ্জ্বল হতে থাকে পাকিস্তানের সম্ভাবনা। কিন্তু জুটির পথচলা থেমে যায় ৪৭ বল খেলে। শেষ বিকেলের মরে আসা আলোয় ঝলমল করে ওঠে কিউইরাই।
শেষ দিনে বোলারদের সৌজন্যে জয় এলেও প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিটির জন্য ম্যাচের সেরা নিউ জিল্যান্ড অধিনায়ক উইলিয়ামসন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউ জিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৪৩১
পাকিস্তান ১ম ইনিংস: ২৩৯
নিউ জিল্যান্ড ২য় ইনিংস: ১৮০/৫ (ডি.)
পাকিস্তান ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ৩৭৩, আগের দিন ৭১/৩) ১২৩.৩ ওভারে ২৭১ (মাসুদ ০, আবিদ ০, আজহার ৩৮, হারিস ৯, ফাওয়াদ ১০২, রিজওয়ান ৬০, ফাহিম ১৯, ইয়াসির ০, আব্বাস ১, আফ্রিদি ৮*, নাসিম ১; সাউদি ২৩-৮-৩৩-২, বোল্ট ২৫-৯-৭২-২, জেমিসন ২৬-১৩-৩৫-২, ওয়্যাগনার ২৮-৯-৫৫-২, স্যান্টনার ১৯.৩-৩-৫২-২, উইলিয়ামসন ২-১-১-০)।
ফল: নিউ জিল্যান্ড ১০১ রানে জয়ী
সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজে নিউ জিল্যান্ড ১-০তে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: কেন উইলিয়ামসন