গত কয়েকদিনে ঘটনাপ্রবাহে অভিষেকটা অনুমেয়ই ছিল। বৃহস্পতিবার এলো সেই মুহূর্ত। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্রিজবেন টেস্টের আগে নাসিমের মাথায় টেস্ট ক্যাপ তুলে দিলেন বোলিং কোচ ও কিংবদন্তি ওয়াকার ইউনিস। ১৬ বছর ২৭৯ দিন বয়সে অভিষেক, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, এত কম বয়সে টেস্ট খেলেনি আর কেউ।
কায়েদ-এ-আজম ট্রফিতে দারুণ বোলিংয়ে নজর কেড়েছিলেন। এই সফরে প্রস্তুতি ম্যাচগুলিতেও গতির ঝড় তুলে হইচই ফেলে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ায়। আর কম বয়সীদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নামিয়ে দিতে পাকিস্তান তো বরাবরই এগিয়ে। সব মিলিয়ে নাসিমের অভিষেক।
স্বপ্নের অভিষেকে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি নাসিম। তবে সেই চোখের জলে আনন্দের সাথে মিশে ছিল সবচেয়ে কাছের মানুষকে হারানোর কষ্টও। এই সফরেই প্রস্তুতি ম্যাচের সময় হারিয়েছেন মাকে। দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন তখনই। কিন্তু তার ভাইয়েরা বললেন, অস্ট্রেলিয়াতেই থেকে যেতে। প্রাপ্তি মিলল, টেস্ট ক্যাপ।
বাবার আপত্তি, অতঃপর লাহোর
আরও অনেক বাবার মতো নাসিমের বাবাও ছেলেকে অনিশ্চিত পথে ঠেলে দিতে চাননি। চেয়েছিলেন পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক নাসিম। কিন্তু ছেলের চোখে যে কেবল ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন! এগিয়ে এলেন বড় ভাই এবং আঙ্কেল। তাদের অনুরোধে মন থেকে না হলেও অনুমতি দিলেন বাবা। লাহোর চলে এলেন নাসিম। থাকতে শুরু করলেন ভাইদের সঙ্গে।
সালোয়ার-কামিজ পরা এবং ক্রিকেট বুট ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর নাসিমকে শুরুতে খুব একটা পাত্তা দেননি সালমান। কিন্তু বোলিং দেখার পর চমকে গেছেন। পরে তিনিই পাকিস্তানে সিনিয়র ক্রিকেটারদের বলেছিলেন ছেলেটির দিকে চোখ রাখতে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে উত্থান
২০১৮ কায়েদ-এ-আজম ট্রফিতে অভিষেকে খুব একটা বল করার সুযোগ পাননি নাসিম। দুই ইনিংস মিলিয়ে করেছিলেন মাত্র দশ ওভার।
বেশ কিছু ম্যাচ বাইরে থাকার পর আবার সুযোগ পান একটি ম্যাচে। দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৬ উইকেট। জানান দেন নিজের সামর্থ্যের। ছড়িয়ে দেন হয়তো আগমণীবার্তাও।
তবে ক্রিকেটের ভিন্ন বাস্তবতাটাও দেখে ফেললেন খুব দ্রুতই। পিঠের চোটের কারণে খেলতে পারলেন না পাকিস্তান সুপার লিগে। মাঠের বাইরে কাটানো হলো ৬ মাস! পরে ফিরেছেন অবশ্য দারুণভাবে। পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে পেয়েছেন ১২ উইকেট।
তবে জাতীয় দলের রাডারে ধরা পড়েছেন গত কায়েদ-এ-আজম ট্রফি দিয়ে। চার ম্যাচে ১৯.২৭ গড়ে নেন ১৮ উইকেট। উইকেট শিকারের চেয়েও বেশি করে নজর কাড়েন ছন্দময় রান-আপ, চমৎকার গতি, লাইন-লেংথের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং দিয়ে।
এবং জাতীয় দল
“নাসিমকে আমি প্রথম দেখি সেন্ট্রাল পাঞ্জাবের নেটে। সেখানেই সে আমার নজর কেড়ে নিয়েছিল” – ব্রিজবেন টেস্টের আগে সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান অধিনায়ক আজহার আলি ফিরে গেলেন নাসিমকে চেনার সময়টায়।
“যেটা আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হলো ওর পরিস্থিতি বুঝে বল করার ক্ষমতা। মাঝেমাঝে অনেক বোলারই তরুণ বয়সে প্রতিভার ঝলকানি দেখায়, কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে না। তবে আমি নাসিমের সঙ্গে যে চার-পাঁচটি ম্যাচ খেলেছি, প্রতিটিতেই সে আগের চেয়ে বেশি ভালো করেছে।”
“সে ব্যাটসম্যানকে খুব ভালো পড়তে জানে। খুব বেশি বোলার এত দ্রুত এই পর্যায়ে আসতে পারে না, কিন্তু সে ব্যতিক্রম।”
“তার অ্যাকশনটা খুব শক্তিশালী। আসলে ও আমাকে ডেনিস লিলির কথা মনে করিয়ে দেয়। অ্যাকশনটা লিলির সাথে মিলে যায়। সে যদিও লিলির মতো অতো বড়সড় নয়। তবে যখন সে সবকিছু ঠিকঠাক করে, তখন তার বল দারুণ কার্যকরী।”
গ্যাবায় টেস্টের প্রথম দিনে বোলিংয়ের সুযোগ পায়নি পাকিস্তান। নাসিমের বোলিং প্রদর্শনী দেখতে তাই অপেক্ষা করতে হবে দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত।
অভিষেকে মিশে মা হারানোর বেদনা
পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত তাগাদাতেও মাকে লাহোর আসতে রাজি করাতে পারেননি নাসিম। তবে ছেলে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে শুনে আর থাকতে পারেননি।
পার্থে অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের বিপক্ষে প্রথম তিন দিনের ম্যাচের প্রথম দিন শেষে মাকে ফোন দিয়েছিলেন নাসিম। মা জানিয়েছিলেন, পর দিনই লাহোরের উদ্দেশে রওনা দেবেন। পাকিস্তানের হয়ে খেলার পাশাপাশি বাবা-মাকে লাহোরে নিয়ে আসার স্বপ্নটাও ছিল সত্যি হবার পথে।
তবে সেই স্বপ্নটা দুঃস্বপ্নে বদলে গেছে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। লাহোরের আসার পথে মারা যান মা। মন ছুটে গেছে পাকিস্তানে। কিন্তু ৯০০০ কি.মি দূরত্ব পাড়ি দিয়ে মাকে শেষবারের মতো দেখতে যেতে পারবেন না, একটা সময় মেনে নিয়েছেন এই বাস্তবতাও।
ভাইয়েরাও চেয়েছেন, নাসিম যেন অস্ট্রেলিয়াই থাকেন। পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলে যেন সত্যি করেন মায়ের স্বপ্ন। এবার নতুন স্বপ্নকে ধাওয়া করার পালা।