Published : 20 Nov 2023, 08:27 AM
কথাই বলতে পারছিলেন না মার্নাস লাবুশেন। কান্নার দমকে ধরে আসছিল তার কণ্ঠ। হাত দিয়ে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করলে একবার। নিজেকে সামলে প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু করলেন। কিন্তু কতটাই বা আর সামলে রাখা যায় নিজেকে! হৃদয়ে আবেগের যে উথাল-পাথাল ঢেউ, তা একসময় চোখ বেয়ে নেমে ভিজিয়ে দিল তার গাল।
আগেও এক দফায়, ম্যাচ শেষ হওয়ার পরপরই তার চোখে পানি দেখা গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুখের কান্না!
বিধ্বংসী সেঞ্চুরিতে যে ফাইনালের নায়ক ট্রাভিস হেড, সেই ম্যাচেই স্থিতধী ব্যাটিংয়ে পার্শ্বনায়ক লাবুশেন। ১১০ বলে ৫৮ রানের ইনিংস এই যুগের ওয়ানডে ক্রিকেটে অচল বলেই মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখাল, এমন ইনিংস কখনও কখনও কতটা মূল্যবান!
হেড আর লাবুশেনের ব্যাটিংয়ের বৈপরীত্য মিলেই তো দ্যোতনার সৃষ্টি হলো যে, তাতেই জয়ের আনন্দে নেচে উঠল অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বজয়ের সেই আবেগই ফুটে উঠল ম্যাচ শেষে লাবুশেনের কণ্ঠে।
“আজকে আমরা যা অর্জন করেছি, তা অবিশ্বাস্য। আমি যেসব অর্জনের অংশ হয়েছি, সেসবের মধ্যে সেরা অর্জন। ভারত ১০ ম্যাচের সবকটি জিতেছে, একটিই কেবল বাকি ছিল… টুর্নামেন্টের সেরা দল ছিল তখনও, অবিশ্বাস্য খেলছিল তারা… তবে আমরা জানতাম, নিজেদের সেরাটা দিতে পারলে আমাদের সুযোগ আছে। আমাদের বোলাররা আজকে ছিল অসাধারণ। এরপর ট্রাভিস (হেড) তো দুর্দান্ত প্রদর্শনী মেলে ধরর। এটির অংশ হতে পারা দারুণ।”
দল বিশ্বকাপ জিতলে এমন দুকূলপ্লাবী আবেগের প্রকাশ অস্বাভাবিক নয়। তবে লাবুশেনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি শুধু দলের সাফল্যের ব্যাপারই নয়। গত কয়েক মাসে তো আবেগ-অস্থিরতা-আশা-হতাশার কত মোড় পেরোতে হয়েছে তাকে!
বিশ্বকাপ ফাইনালে অবদান রাখা বহুদূর, বিশ্বকাপ স্কোয়াডেই তার থাকার কথা ছিল না। তিনি ছিলেন না। আরেকটু পেছনে গেলে, অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে দলেও তার জায়গা ছিল না।
বিশ্বকাপের ১৫ জনের স্কোয়াডে তো নয়ই, ১৮ জনের যে বিস্তৃত স্কোয়াড ঘোষণা করা হয়েছিল, তাতেই ছিল না লাবুশেনের নাম। টানা ব্যর্থতায় জায়গা হারান তিনি ওয়ানডে দলে। বিশ্বকাপের আগে সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের স্কোয়াডেও তিনি ছিলেন না। বরং তাকে পাঠানো হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলে, নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে সিরিজের জন্য।
এরপর একের পর নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ ঘটতে থাকে। স্টিভেন স্মিথ চোট নিয়ে ছিটকে পড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বদলি হিসেবে পাঠানো হয় লাবুশেনকে। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে যথারীতি একাদশে জায়গা পাননি। দর্শক হয়ে বসেছিলেন ডাগ আউটে। কিন্তু সুযোগ এবারও আসে আচমকা। ক্যামেরন গ্রিন চোট পাওয়ায় ‘কনকাশন সাব’ হিসেবে ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ পেয়ে যান লাবুশেন। ব্যস, সাত নম্বরে নেমে ৮০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে নিজে জিতে নেন ম্যাচ সেরা পুরস্কার।
ম্যাচ শেষে আরেকটি অসাধারণ ঘটনা জানা যায় লাবুশেনের কাছ থেকে। তার মা সেদিন দর্শক হয়ে খেলা দেখছিলেন গ্যালারিতে। একাদশে লাবুশেন না থাকলেও মায়ের স্থির বিশ্বাস ছিল, এই ম্যাচে কোনো না কোনোভাবে দেখা যাবে লাবুশেনকে! ম্যাচ শেষে সেই গল্প শোনান অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান।
"তিনি অসাধারণ এক নারী। যদিও ম্যাচের প্রথম সাড়ে তিন ঘণ্টায় আমি খেলিনি, তার পরও তিনি মাঠে রয়ে যান। তার ভেতরে এরকম মনে হচ্ছিল…আমি এখানে আসার পর তিনি একরকম নিশ্চিত ছিলেন যে, আমি এই ম্যাচে খেলবই। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘মাম, আমি দল দেখেছি…দলে নেই আমি।’তবু তার মনে হচ্ছিল (আমি খেলব) এবং আরও একবার, তিনিই ঠিক ছিলেন...। সত্যি বলতে, এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন…।”
মায়ের সেই বিশ্বাস তাকে বাড়তি প্রেরণা জোগাল হয়তো। পরের ম্যাচে একাদশে জায়গা পেলেন এবং এবার খেললেন ৯৯ বলে ১২৪ রানের ইনিংস।
বিশ্বকাপ দলে তবু তো জায়গা নেই! কিন্তু তার নাটকীয় প্রাপ্তির পালা শেষ হওয়ার নয়। চোটের কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেন অ্যাশটন অ্যাগার। তার বদলে বিশ্বকাপ দলেও ঠাঁই পেয়ে গেলেন লাবুশেন। স্পিনারের বদলে ব্যাটসম্যান!
বিশ্বকাপের ঠিক আগে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে ৫৮ বলে ৭২ রানের ইনিংস খেললেন। এতে বিশ্বকাপে একাদশের দুয়ার খুলে গেল। যে লাবুশেন শুরুতে স্কোয়াডেই ছিলেন না, সেই তিনি বিশ্বকাপে দলের সবকটি ম্যাচেই খেললেন!
শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেললেন ৪০ ছোঁয়া ইনিংস, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৪৭ বলে ৬২, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করলেন ৭১। পরে আফগানিস্তান ও সেমি-ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রান পাননি। ফাইনালের একাদশে তাকে রাখা হবে কি না, সেই সংশয় ছিল। বোলিংয়ে বাড়তি বিকল্পের জন্য মার্কাস স্টয়নিসকে খেলানো হতে পারে, এরকম সম্ভাবনার কথা ফাইনালের আগের দিন বলেছিলেন অধিনায়ক প্যাট কামিন্স।
শেষ পর্যন্ত সেই বদল হলো না এবং অস্ট্রেলিয়াকে তিনি প্রতিদান দিলেন পুরোপুরি। প্রবল চাপের মধ্যে ১৯২ রানের ম্যাচ জেতানো জুটির অংশীদার হলেন।
তিনি নিজে ইশ্বরে প্রবলভাবে বিশ্বাসী। তবে গত কয়েকমাসে এতটা কাকতাল তার সঙ্গে হয়েছে যে, সবকিছু যেন তিনি নিজেও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।
“আপনারা জানেন যে আমি বিশ্বাসী একজন… ইশ্বরে অগাধ বিশ্বাস আমার। কিন্তু যেভাবে সবকিছু হয়েছে আমার সঙ্গে, অবিশ্বাস্য লাগে। সবকিছু অসাধারণ… আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।”
“কতবার যে মনে হয়েছে আমার সম্ভাবনা শেষ! তার পর আবার কীভাবে কীভাবে সুযোগ এসেছে। এমনকি গত রাতেও… রাত ১০টা ১০ মিনিট পর্যন্ত দল জানানোই হয়নি। কোচরা মাঠে গিয়েছিল, শিশিরের প্রবল প্রভাব… সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি বাদ পড়তে পারি। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ আমাকে ধরে রাখার জন্য। অনভূতি ব্যাখ্যা করার ভাষা জানা নেই আমার। দুই মাস আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আমি এমনকি ওয়ানডে দলেই ছিলাম না। সেখান থেকে টানা ১৯টি ম্যাচ খেলা সত্যিই অলৌকিক ব্যাপার। জানি না কীভাবে হলো… ইশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা।”
ইশ্বর তো তাদের পাশেই থাকেন, যারা চেষ্টায় কমতি রাখেন না! লাবুশেনের প্রাপ্তিগুলো তাই পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর নিবেদনেরই পুরস্কার। অনুশীলনে এত ঘাম ঝরিয়েছেন বলেই বিশ্বকাপ শেষে সিক্ত হতে পারছেন অনির্বচনীয় সুখের আনন্দাশ্রুতে।