এনসিএল টি-টোয়েন্টি
স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্টের প্রথম আসরে ব্যাট-বলের দাপট দেখা গেছে সমান তালে, অভিজ্ঞদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করেছেন তরুণ ক্রিকেটাররাও।
Published : 25 Dec 2024, 08:53 AM
উদ্বোধনী ম্যাচে সিলেটের হয়ে জিসান আলমের সেঞ্চুরি। পরে আরিফুল ইসলামের বিধ্বংসী সেঞ্চুরিতে দুইশর বেশি রান তাড়া করে ঢাকার জয়। এনসিএল টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের শুরু যতটা উড়ন্ত ছিল, শেষটা যেন ততই অনুজ্জ্বল। ফাইনালে ঢাকা মেট্রোকে মাত্র ৬২ রানে গুটিয়ে ট্রফি ঘরে তোলে রংপুর।
শুরু ও শেষের এই বৈপরীত্যের মাঝেই শেষ হলো স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে দেশের নতুন টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। যেখানে দলীয় সাফল্যে সবাইকে ছাড়িয়ে গেল রংপুর। ব্যাটে-বলে আলো ছড়ালেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ, জিসান আলম, আলাউদ্দিন বাবু, আবু হায়দাররা। প্রথমবার স্বীকৃত ক্রিকেট খেলতে নেমে চমক দেখালেন আজিজুল হক তামিম।
স্থানীয় ক্রিকেটারদের যথাযথ চর্চায় রাখা, টি-টোয়েন্টির প্রতিভা তুলে আনার লক্ষ্যে জাতীয় ক্রিকেট লিগের চার দিনের সংস্করণের আট দল নিয়েই হয়েছে এনসিএল টি-টোয়েন্টি। যেখানে ব্যাট-বলের দাপট দেখা গেছে সমান তালে।
টুর্নামেন্টের ৩২ ম্যাচের মধ্যে ২১ ইনিংসে ১৬০ ছুঁয়েছে দলগুলো। ১৮০ রানের বেশি তাড়ায় জয়ের ঘটনা দেখা গেছে ৪টি। প্রথম ইনিংসে ১৩০ বা তার রানের কমে আটকে যাওয়ার নজির ছিল ১০টি। এর দুইটিতে আবার আগে ব্যাট করা দলই পেয়েছে জয়ের স্বাদ।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও আউটার মাঠে কুয়াশার প্রভাবও কিছুটা পড়েছে উইকেটে। কুয়াশার মাত্রা বেশি থাকা দিনগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই তেমন রানের দেখা মেলেনি। এর বাইরে ব্যাট-বলের দারুণ সমন্বয়ই দেখা গেছে আসরজুড়ে।
টুর্নামেন্টের পর্দা নামার পর একনজরে দেখে নেওয়া যাক এনসিএল টি-টোয়েন্টির প্রথম আসরের পর্যালোচনা
আসরের চমক জিসান-আজিজুল
এনসিএল টি-টোয়েন্টির প্রথম আসরে তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন জিসান আলম, আজিজুল হাকিম তামিমরা। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে নজর কেড়েছেন দুই তরুণ টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান।
এমনিতে ঢাকার হলেও, এবার সিলেটের হয়ে খেলেন জিসান। ঢাকার বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে ৮ বলের মধ্যে ৭টি ছক্কাসহ মোট ৪ চার ও ১০ ছক্কায় ৫২ বলে করেন সেঞ্চুরি। পরে খুলনার বিপক্ষে ৪৮ বলে ৭৩ ও শেষ ম্যাচে রাজশাহীর বিপক্ষে ২০ বছর বয়সী ওপেনার খেলেন ৩২ বলে ৬০ রানের ইনিংস।
সব মিলিয়ে ৭ ইনিংসে ৪০.১৪ গড় ও ১৫৮.৭৬ স্ট্রাইক রেটে জিসানের সংগ্রহ ২৮১ রান। তার চেয়ে বেশি রান শুধু মোহাম্মদ নাঈম শেখের, ৯ ইনিংসে ২১৬। টুর্নামেন্টে ১৭টি চার ও ২২টি ছক্কা মারেন জিসান। আর কেউ ২০টি ছক্কাও মারতে পারেননি।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেই প্রথম ঝড়ো ব্যাটিংয়ে সামর্থ্যের জানান দেন জিসান। এবার এনসিএলে যেন অনেকটাই পূর্ণতা পেল সেটি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে নিজের পারফরম্যান্সে তৃপ্তির কথা বলেন জিসান।
“আলহামদুলিল্লাহ্! অনেক ভালো একটা টুর্নামেন্ট কেটেছে। আমার অভিজ্ঞতা খুব ভালো ছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন একটা টুর্নামেন্ট আমাদের সবার জন্য অনেক উপকারী। আমি আশা করি, সামনে আরও ভালো কিছু করতে পারব।”
জিসান ব্যাট হাতে আলো ছড়ালেও দল হিসেবে ব্যর্থ ছিল সিলেট। প্লে-অফের আগেই থামে তাদের যাত্রা। ফলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়ার দৌড়েও দুই নম্বরে নেমে যান তিনি। এটি নিয়ে আক্ষেপ কিছুটা আছে জিসানের।
তবে সেই আক্ষেপ পেছনে ফেলে এবার বিপিএলেও ধারাবাহিকতা ধরে রাখার আশা দুর্বার রাজশাহী দলে ডাক পাওয়া তরুণ ওপেনারের।
“আমার প্রস্তুতি বেশ ভালো আছে। একটা ভালো টুর্নামেন্ট শেষ করেছি। অবশ্যই আশা করব, এই ধারাবাহিকতা যেন ধরে রাখতে পারি। আলাদা করে কোনো লক্ষ্য ঠিক করছি না। তবে যত ভালো করা যায়, চেষ্টা করব।”
সবশেষ অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করার তাজা স্মৃতি নিয়ে এনসিএল টি-টোয়েন্টি শুরু করেন আজিজুল। প্রথম ম্যাচেই রাজশাহীর বিপক্ষে তিনি খেলেন ৩১ বলে ৫৩ রানের ইনিংস। পরে রংপুরের বিপক্ষে ৪১ বলে করেন ৬৪ রান।
যুব এশিয়া কাপে ১২০ গড়ে ২৪০ রান করা আজিজুল এবার বড়দের ক্রিকেটে নিজের প্রথম টুর্নামেন্টে ৯ ইনিংসে ১৩৬.৯৯ স্ট্রাইক রেটে করেন ২৩৭ রান। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় পাঁচ নম্বরে তার নাম।
১৯টি চারের পাশাপাশি ১৬টি ছক্কা মারেন তরুণ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তার চেয়ে বেশি ছক্কা শুধু জিসান ও হাবিবুর রহমানের (১৭টি)।
এছাড়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ওপেনার জাওয়াদ আবরারও সম্ভাবনার ছাপ রাখেন। রাজশাহীর বিপক্ষে ৩৯ বলে ৬২সহ তিন ইনিংসে ১৪১.৮৯ স্ট্রাইক রেটে ১০৫ রান করেন ঢাকার ওপেনার।
অলরাউন্ড নৈপুণ্যে সেরা আবু হায়দার
শেষটা মনমতো করতে না পারলেও টুর্নামেন্টজুড়ে ব্যাট-বলে ঢাকা মেট্রোর চাহিদা মেটান আবু হায়দার। বল হাতে ৯ ইনিংসে ১৩ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে ১৬৪ স্ট্রাইক রেটে ১২৩ রান করেন বাঁহাতি পেস অলরাউন্ডার।
তাই দলীয় সাফল্যে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জেতেন অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। এতে ট্রফির পাশাপাশি ১ লাখ টাকার অর্থ পুরস্কারও পান তিনি।
ফাইনালের পর পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে ব্যাটিংয়েও অবদান রাখতে পারার আনন্দের কথা বলেন আবু হায়দার।
“আমি সবসময়ই বলি, বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও উপভোগ করি। এটি আমাকে বাড়তি প্রেরণা দেয়। আমার দলেরও শেষ দিকে কিছু বড় শটের চাহিদা থাকে। তাই বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও অবদান রাখার চেষ্টা করি।”
ব্যাটিংয়ে শীর্ষে নাঈম শেখ
রংপুরের বিপক্ষে ফাইনালে রানের খাতা খুলতে পারেননি মোহাম্মদ নাঈম শেখ। তবে আগের ৯ ইনিংসেই তিন ফিফটিসহ ৩১৬ রান করে ফেলেন মেট্রো অধিনায়ক। যা টপকাতে পারেনি কেউ। মূলত তিনশ রানই করতে পারেনি আর কেউ।
তাই টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যানের ট্রফি ও ৫০ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার জেতেন বাঁহাতি ওপেনার। ব্যক্তিগত সাফল্যে এনসিএলের আগে নেওয়া প্রস্তুতির কৃতিত্ব দেন নাঈম।
“টুর্নামেন্টের আগে আমি ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি। সামনে বিপিএল আছে। চেষ্টা করেছি যেসব জায়গায় উন্নতি প্রয়োজন, সেসব জায়গায় সঠিক সময়ে কাজ করার। সে পথে হেঁটেই আমি সফল হয়েছি।”
ব্যাটসম্যানদের তালিকায় নাঈমের পরেই জিসান। তিন নম্বরে আরেক অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান সোহান। ৮ ইনিংসে ৫৩.২০ গড়ে ২৬৬ রান করেন খুলনা অধিনায়ক। ২০ চারের সঙ্গে ১০টি ছক্কা মারেন তিনি।
চার নম্বরে রাজশাহীর ওপেনার হাবিবুর রহমান। ৭ ইনিংসে ৩৭ গড় ও ১৬০.৮৬ স্ট্রাইক রেটে ২৫৯ রান করেন ২৫ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। তালিকার পাঁচ নম্বর নামটি আজিজুলের।
এছাড়া দুইশ রান করতে পেরেছেন মেট্রো ওপেনার ইমরানউজ্জামান (১০ ইনিংসে ২২৮), ঢাকার আরিফুল ইসলাম (৭ ইনিংসে ২১৩), রংপুরের আকবর আলি (৯ ইনিংসে ২০৮) ও সিলেটের তৌফিক খান (৭ ইনিংসে ২০০)।
বোলিংয়ে দাপট পেসারদের
উদ্বোধনী ম্যাচে দুইশ রান তাড়া করে জয় অথবা পরে ১৮০ রানের বেশি তাড়া করে আরও তিন জয়ের টুর্নামেন্টে বল হাতে দাপট দেখান পেসাররা। আসরে অন্তত ১০ উইকেট নেওয়া ১০ জন বোলারের মধ্যে পেসারই ৮ জন।
ফাইনালে মেট্রোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া বোলিংয়ে ১২ রানে ৩ উইকেট নেন আলাউদ্দিন বাবু। সব মিলিয়ে ৯ ইনিংসে মাত্র ৯.৮৪ গড়ে ওভারপ্রতি ৫.৫০ রান খরচ করে তার শিকার ১৯ উইকেট। বোলারদের তালিকায় সবার ওপরে তিনিই।
রংপুরকে শিরোপা জিতিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা বোলারের ট্রফি ও ৫০ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার পান ৩৩ বছর বয়সী পেসার। স্বীকৃতি গ্রহণ করে অভিজ্ঞদের সময় ফুরিয়ে যায়নি বলেন আলাউদ্দিন।
“অনুভূতি অবশ্যই ভালো। তরুণদের পারফর্ম করার এখনও সময় আছে। আর অভিজ্ঞদেরও পারফর্ম করার সুযোগ আছে। ভালো করার ক্ষুধা সবসময়ই থাকতে হবে। এটি না থাকলে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারবেন না।”
ফাইনালের আগপর্যন্ত বোলারদের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন চট্টগ্রামের পেসার আহমেদ শরিফ। বাদ পড়ার আগে ৮ ইনিংসে ১৭ উইকেট নেন ২০ বছর বয়সী পেসার। পরের তিনজনই ঢাকা মেট্রোর- দুই স্পিনার রকিবুল হাসান (১৫) ও আলিস আল ইসলাম (১৪) ও আবু হায়দার (১৩)।
এছাড়া অন্তত ১০ উইকেট নিতে পারেন আরও পাঁচ বোলার- রংপুরের মুকিদুল ইসলাম (১২), চট্টগ্রামের ফাহাদ হোসেন (১১), সিলেটের ইবাদত হোসেন (১০), সৈয়দ খালেদ আহমদ (১০) ও মেট্রোর শহিদুল ইসলাম (১০)।
তারুণ্য-অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রাজ্জাকের সন্তুষ্টি
সিলেটের দুই মাঠে টুর্নামেন্টের সবগুলো ম্যাচ কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করেন জাতীয় দলের নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে এনসিএলে ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
“আমার মনে হয়েছে, খুবই সফলভাবে টুর্নামেন্টটা শেষ হয়েছে। আর এটাকে কিন্তু বিপিএল বা অন্য যে কোনো কিছুর প্রস্তুতি বলা ঠিক হবে না। এটাও বড় একটা আসর। এখানে ছেলেরা ভালো খেলেছে, মাঠের খেলা ভালো হয়েছে, এতেই আমি খুশি। কিছু কিছু ঘাটতি হয়তো ছিল। তবে এটা যদি প্রতি বছর হয়, সেগুলো কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে না।”
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় অভিজ্ঞ নাঈম, সোহানদের সঙ্গে আছেন তরুণ জিসান, আজিজুলরা। আবার বোলিংয়েও আলাউদ্দিন, আবু হায়দারদের পাশাপাশি আলো ছড়িয়েছেন শরিফ, রকিবুলরা।
পারফরম্যান্সে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের এই মিশেলই এনসিএল টি-টোয়েন্টির বড় সাফল্য মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক বাঁহাতি স্পিনার।
“এবারের পারফরম্যান্সে কিন্তু আদর্শ একটা সমন্বয় ছিল। এটা বলার কোনো সুযোগই নেই যে, টি-টোয়েন্টি দেখে শুধু তরুণরাই ভালো খেলবে। অভিজ্ঞরা পারবে না। তরুণরা তো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের থেকেই শিখবে।”
“আমি কারও নাম আলাদা করে বলতে চাই না। তবে আলাউদ্দিন বাবুর নাম উদাহরণ হিসেবে চলে আসবে। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাটিং-বোলিং দুই দিকেই উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স করেছে। এরকম আরও কয়েকজন ছিল। সব মিলিয়ে সন্তোষজনক একটা টুর্নামেন্ট।”
সার্বিকভাবে স্থানীয় ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যথাযথ চর্চায় রাখার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে মনে করেন রাজ্জাক।
“বোলারদের কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে। প্রথম ম্যাচেই যেমন দুইশর বেশি রান তাড়া করে জিতেছে দল। অন্য কিছু ম্যাচে ১৮০ রানও তাড়া হয়েছে। তো আমার মতে, এই ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়লেই বোলাররা আসলে শিখবে কীভাবে এসব পরিস্থিতিতে ভালো করতে হয়।”
“সব মিলিয়ে ব্যাটিং-বোলিং দুই দিকের জন্যই খুব ভালো হয়েছে। আমাদের জন্য এটা জানা খুব দরকার ছিল। কারণ বিপিএল ছাড়া তো কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট ছিল না। এই সংস্করণে খেলাটা আসলে কেমন সেটাও ভালোভাবে বোঝা গেছে।”