বিপিএলে পরপর তিন ফাইনালে হারের তিক্ত স্মৃতির সাক্ষী হওয়া তাওহিদ হৃদয়ের সামনে আরেকটি সুযোগ শিরোপার রঙে নিজেকে রাঙানোর।
Published : 07 Feb 2025, 10:00 AM
‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’- কালীপ্রসন্ন ঘোষের সেই ছড়া মনে রাখলেও একশবার চেষ্টা করার সুযোগ বাস্তবে পাবেন না তাওহিদ হৃদয়। তবে এর মধ্যে তিনবার চেষ্টা করে ফেলেছেন তিনি। একবারও পারেননি বিপিএলের ট্রফিতে চুমু এঁকে দিতে। তিনবার বিপিএল ট্রফির সুবাস পেয়েও হারিয়ে ফেলা এই ব্যাটসম্যানের সামনে এখন আরেকটি সুযোগ।
বিপিএলের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্কটা এখন পর্যন্ত অম্ল-মধুর। ২০১৯ সালে তার অভিষেকটা ছিল ভুলে যাওয়ার মতো। পরে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে গত দুই আসরে ব্যাট হাতে তিনি মেলে ধরেন চমৎকার ব্যাটিং প্রদর্শনী। তার সেই সাফল্যময় যাত্রায় দলও ছিল সঙ্গী। সবশেষ তিন বিপিএলেই তিনি ও তার দল দল পা রাখে শেষের মঞ্চে।
কিন্তু সেই মঞ্চে উৎসব করা হয়নি তার। শিরোপার সঙ্গে শেষ ধাপের দূরত্ব ঘোচানো হয়নি একবারও। নাগালে পেয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেননি ট্রফি।
ধারাবাহিকতার পথ ধরে এবার টানা চতুর্থ আসরে ফাইনালে তার দল। গত তিন আসরের অপূর্ণতা ঘোচানোর সুযোগ এবার ২৪ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে চিটাগং কিংসের মুখোমুখি হবে হৃদয়ের ফরচুন বরিশাল। তার টানা তিন ফাইনাল হারের শুরুটাও ছিল এই বরিশাল দিয়েই।
ফাইনালের বেদনাগাঁথার আগে তার বিপিএল অভিষেকের দিনটিতেও একটু ফিরে যাওয়া যায়। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে থাকতেই ২০১৯ সালে সিলেট সিক্সার্সের হয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে যাত্রা শুরু হয় হৃদয়ের। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে ওই ম্যাচে ৮ রান করতে তিনি খেলেন ২৪ বল। সেদিন ডেভিড ওয়ার্নারের রান আউটেও তার ছিল বড় দায়।
বাজে অভিজ্ঞতায় বিপিএল অভিযান শুরু করে পরের আসরে আর দল পাননি হৃদয়। পরে ২০২২ সালের আসরে তাকে নেয় বরিশাল। এবারও কথা বলেনি তার ব্যাট। ফাইনালের আগপর্যন্ত ৯ ইনিংসে করতে পারেন ১২৭ রান। কুমিল্লার বিপক্ষে কোয়ালিফায়ার ম্যাচে ৩ বলে করেন মাত্র ১ রান। তবু ফাইনালে তাকে সুযোগ দেয় বরিশাল।
আগের ম্যাচগুলোর ব্যর্থতা ভুলিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল হৃদয়ের। নায়ক হওয়ার মঞ্চ পেয়ে গিয়েছিলেন তরুণ ব্যাটসম্যান। আট নম্বরে তিনি যখন ব্যাট করতে নামেন, জয়ের জন্য বরিশালের প্রয়োজন ১৭ বলে ১৮ রান। উইকেট তখনও বাকি ছিল ৪টি।
কিন্তু বাকি ১৭ বলে কোনো বাউন্ডারি পায়নি বরিশাল। শেষ বলে বাকি থাকে ৩ রান। শহিদুল ইসলামের বলে চার মারতে পারেননি হৃদয়। ৯ বলে ৯ রানে অপরাজিত থেকে দলের ১ রানের পরাজয় দেখেন তিনি।
২০২৩ সালে দল বদলে সিলেট স্ট্রাইকার্সে নাম লেখান তরুণ ব্যাটসম্যান। প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল না তাকে নিয়ে। কিন্তু এই আসর থেকেই নিজেকে তিনি উপস্থাপন করেন নতুন রূপে। দেশের ক্রিকেট স্বাক্ষী হয় ভিন্ন এক হৃদয়ের। আগ্রাসী ব্যাটিং আর ধারাবাহিতায় দারুণ চমকে দেন তরুণ ব্যাটসম্যান। প্লে-অফের আগপর্যন্ত ৯ ইনিংসে ১৪৬.৫১ স্ট্রাইক রেটে তখন পর্যন্ত আসরের সর্বোচ্চ ৩৭৮ রান ছিল তার।
কিন্তু প্লে-অফে গিয়েই যেন খেই হারিয়ে ফেলেন হৃদয়। কুমিল্লার বিপক্ষে প্রথম কোয়ালিফায়ারে রানের খাতা খুলতে পারেননি। হেরে যায় সিলেট। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে ২৫ রান করতে তিনি খেলেন ২৫ বল। সম্মিলিত পারফরম্যান্সে সেদিন জিতে যায় সিলেট। ফাইনালে ফেরেন শূন্য রানে।
দলও হেরে যায় সেদিন। আরও একবার ফাইনালের মঞ্চ থেকে খালি হাতে ফেরেন তরুণ ক্রিকেটার।
ওই আসরের পারফরম্যান্স তাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। জাতীয় দলের হয়েও দারুণ কিছু ইনিংস খেলেন। গত বিপিএলের আগে তাই তিনি ছিলেন দলগুলির কাছে দারুণ কাঙ্ক্ষিত। কোটি টাকার বেশি দিয়ে তাকে দলে নেয় টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
দল বদলালেও ব্যাটের ধার থাকে একইরকম। আসরজুড়ে ১৪ ইনিংসে এক সেঞ্চুরি ও দুই ফিফটিতে তিনি করেন ৪৬২ রান। রংপুরের বিপক্ষে প্রথম কোয়ালিফায়ারেও খেলেন ৪৩ বলে ৬৪ রানের ইনিংস।
কিন্তু ফাইনালের গেরো সেবারও খুলতে পারেননি হৃদয়। বরিশালের বিপক্ষে ১০ বলে ১৫ রান করে তিনি ধরেন ড্রেসিং রুমের পথ। দলের কোনো ব্যাটসম্যান পারেননি চল্লিশ ছুঁতে। পরে সহজে ম্যাচ জিতে নেয় তামিম ইকবালের দল। সব মিলিয়ে তিন ফাইনালে মাত্র ২৪ রান করতে পারেন হৃদয়।
দুই আসর পর চলতি বিপিএলে আবার বরিশালের ডাগআউটে ফিরেছেন হৃদয়। টুর্নামেন্টের শুরু থেকে তেমন ফর্মে না থাকলেও তাকে সব ম্যাচেই সুযোগ দিয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। লিগ পর্বের ১২ ম্যাচে তিনবার শুধু ছুঁতে পেরেছেন ত্রিশ। ফিফটি করতে পারেননি একটিও।
তবু হৃদয়ের ওপর আস্থা হারায়নি দল। প্রথম কোয়ালিফায়ারে বেশ ভালোভাবেই এর প্রতিদান দেন তিনি। চিটাগংয়ের বিপক্ষে ১৫০ রানের লক্ষ্যে শুরুতেই তামিমের বিদায়ের পর দায়িত্ব নিয়ে নেন হৃদয়। শুরুতে রয়েসয়ে খেলে ৪৫ বলে করেন আসরে নিজের প্রথম পঞ্চাশ। পরের ১১ বলে ঝড় তুলে করেন ৩২ রান।
ফাইনালের আগে হৃদয়ের বড় রান পাওয়া নিশ্চিতভাবেই আশা জোগাবে বরিশালকে। তবে গত তিন ফাইনালে তার পারফরম্যান্সের চিত্র কি কিছুটা হলেও চিন্তার ভাঁজ ফেলবে চ্যাম্পিয়নদের মনে? ফাইনালের আগেও অবশ্য তার ওপর বিশ্বাস রাখার কথা বলেছেন প্রধান কোচ মিজানুর রহমান।
সেই বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে পারেন যদি, কে জানে, হয়তো এবার ট্রফির ছোঁয়ায় উষ্ণ হবে হৃদয়ের হৃদয়।