সিলেট পর্বের প্রথম ম্যাচে হেরে গেল সিলেট স্ট্রাইকার্স, ব্যাটিং স্বর্গ উইকেট ও ছোট সীমানার ম্যাচে ২০৫ রানের পুঁজি যথেষ্ট হলো না তাদের জন্য।
Published : 06 Jan 2025, 05:59 PM
২০৫ রান মানে যে কোনো উইকেটেই ভালো স্কোর। মাঝবিরতিতে তার পরও সংশয়টা ছিল, সিলেট স্ট্রাইকার্সের পুঁজি যথেষ্ট তো? তাদের বোলিং আক্রমণ খুব ভালো নয়। উইকেট এখানে ব্যাটিং স্বর্গ। সংশয়ের আরেকটি বড় কারণ, মাঠের ছোট্ট সীমানা। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের বাউন্ডারি এমনিতেই বড় নয় ততটা। বিপিএলের জন্য সীমানা আরও কমানো হয়েছে। বিশেষ করে, প্রেসবক্স প্রান্তে তো ৩০ গজের বৃত্ত শেষে আর ৩০ গজও নেই সীমানা!
সেই সংশয়ই পরে সত্যি হলো। বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকা ছক্কায় নতুন রেকর্ড দেখল বিপিএল। অ্যালেক্স হেলস ও সাইফ হাসানের রেকর্ড জুটিতে দুইশ ছাড়ানো স্কোর টপকে দারুণ জয় পেল রংপুর রাইডার্স। বিপিএলের সিলেট পর্বের শুরুটা হলো সিলেটের হার দিয়ে।
টসের সময় আরিফুল হক বলেছিলেন, ‘১৭০-১৮০ রান করতে পারলে ভালো হবে।’ অ্যারন জোন্স ও জাকের আলির শেষের ঝড়ে অধিনায়কের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে দল। কিন্তু রংপুরের ব্যাটের দাপটে ম্যাচে লড়াই জমেনি খুব একটা।
আগের ম্যাচে ৪৯ রানে অপরাজিত থাকা হেলস এবার অপরাজিত রইলেন শতরান ছুঁয়ে। সাইফ খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। ৬ বল বাকি থাকতেই ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতে নিল রংপুর।
বিপিএলে এর চেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয় আছে আর একটি। ২০২৩ সালে খুলনা টাইগার্সের দেওয়া ২১১ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
চার ম্যাচে রংপুরের এটি চতুর্থ জয়। দুই ম্যাচে সিলেট হারল দুটিতেই।
ছক্কা মেরে ম্যাচ শেষ করা হেলস শেষ পর্যন্ত ১০ চারের সঙ্গে ৭ ছক্কায় মাত্র ৫৬ বলে খেলেন ১১৩ রানের ইনিংস। দলকে জয়ের কাছে রেখে আউট হওয়া সাইফের ব্যাট থেকে আসে ৪৯ বলে ৮০ রান। ৩ চারের সঙ্গে তিনিও মারেন ৭টি ছক্কা।
রান তাড়ায় বিপিএল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১৮৬ রানের জুটি গড়েন হেলস ও সাইফ। আগের রেকর্ডেও আছে হেলসের নাম। ২০১৯ সালে রংপুরের হয়েই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে ১৮৪ রান যোগ করেছিলেন তিনি।
হেলস-সাইফের রেকর্ড জুটির দিন হয়েছে ছক্কারও নতুন রেকর্ড। ব্যাটিংবান্ধব উইকেটের পাশাপাশি ছোট সীমানার সুবিধা কাজে লাগিয়ে মোট ৩১টি ছক্কা মেরেছেন ব্যাটসম্যানরা। বিপিএলে এক ম্যাচে এটিই সর্বোচ্চ ছয়ের রেকর্ড। এর আগে ভিন্ন দুটি ম্যাচে দেখা গেছে ২৯টি করে ছক্কা।
মানজি-রনির ভালো শুরু
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ইনিংসের তৃতীয় বলে চার মারেন রনি তালুকদার। পরের ওভারে শেখ মেহেদি হাসানের বলে জর্জ মানজি মারেন নিজের প্রথম চার। একই ওভারে রনিও মারেন আরও দুটি বাউন্ডারি।
চতুর্থ ওভারে নাহিদ রানার প্রথম বলে ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে ম্যাচের প্রথম ছক্কা পেয়ে যান রনি। এক বল পর ডিপ মিড উইকেট দিয়ে ছক্কায় ওড়ান মানজি। পরের ওভারে আকিফ জাভেদের বলে আরেকটি ছক্কা মারেন বাঁহাতি ওপেনার।
তবে পরের বল আবারও ছক্কায় ওড়াতে গিয়ে সীমানায় ধরা পড়েন স্কটিশ ব্যাটসম্যান। ডিপ স্কয়ার লেগে দারুণ ক্যাচ নেন আজিজুল হাকিম। ১২ বলে ১৮ রান করেন মানজি। ৩০ বলে ৪৭ রানে ভাঙে উদ্বোধনী জুটি।
রনির ঝড়ো ফিফটি
আগের ম্যাচে চল্লিশ ছোঁয়া ইনিংস খেলা রনি এবার ফিফটি পর্যন্ত যেতে পারেন। অষ্টম ওভারে নাহিদের বলে ছক্কার পর চার মারেন এই অভিজ্ঞ ওপেনার। পরের ওভারে মেহেদির বল ছক্কায় উড়িয়ে মাত্র ৩০ বলে পঞ্চাশ স্পর্শ করেন তিনি।
ওই ওভারেই রনিকে এলবিডব্লিউ করেন মেহেদি। ৭ চার ও ৩ ছক্কায় ৩২ বলে ৫৪ রান করেন সিলেট ওপেনার।
জাকির হাসানের সঙ্গে রনির দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে আসে ২৩ বলে ৪১ রান।
ধুঁকলেন স্টার্লিং
৩৬৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে মাত্র তৃতীয়বার চার নম্বরে নেমে একদমই ছন্দ পাননি পল স্টার্লিং। ফলে কমতে থাকে সিলেটের গতি। জাকিরের সঙ্গে তার ৩৬ রানের জুটি গড়তে লেগে যায় ৩১ বল।
একাদশ ওভারে রকিবুল হাসানের প্রথম বলে বাউন্ডারি মারেন স্টার্লিং। শেষ বল ছক্কায় ওড়ান জাকির। এক ওভার পর মেহেদির বল লং অফ দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠান বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
চতুর্দশ ওভারের শেষ বলে সাইফউদ্দিনের লো ফুল টসে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেট সীমানায় ধরা পড়েন স্টার্লিং (১৬ বলে ১৬)।
ফিফটি করে জাকিরের বিদায়
স্টার্লিংয়ের বিদায়ের পর ব্যক্তিগত ৩৫ রানে জীবন পান জাকির। খুশদিল শাহর বলে ক্যাচ নিতে পারেননি ইফতিখার আহমেদ। ওই ওভারেই ছক্কা মেরে খুশদিলের হতাশা আরও বাড়ান জাকির।
অষ্টাদশ ওভারে নাহিদের পরপর দুই বলে ছক্কা মারেন অ্যারন জোন্স। ওভারে মোট ১৬ রান দেন তরুণ পেসার।
পরের ওভারে ক্যারিয়ারের সপ্তম ফিফটি পূর্ণ করেন জাকির। এরপরই সাইফউদ্দিনের দ্বিতীয় শিকার হন তিনি। ৩৮ বলে করেন তিনি ৫০ রান।
জাকের-জোন্সের শেষে ঝড়
ইনিংসের ৯ বল বাকি থাকতে ক্রিজে গিয়ে তাণ্ডব চালান জাকের আলি। জোন্সও তাকে দারুণ সঙ্গ দেন। মাত্র ৯ বলে দুজন মিলে যোগ করেন ৩৪ রান।
উনবিংশ ওভারের শেষ বল ছক্কায় ওড়ান জোন্স। শেষ ওভারে আকিফের প্রথম দুই বল একই ঠিকানায় পাঠান জাকের। চতুর্থ বল আবার ছক্কা মারেন জোন্স। শেষ বল এক্সট্রা কভার সীমানার ওপারে পাঠিয়ে সিলেটকে দুইশ পার করান জাকের।
জোন্স ১৯ বলে ৩৮ ও জাকের ৫ বলে ২০ রানে অপরাজিত থাকেন।
সাইফউদ্দিনের ২ উইকেট, খরুচে নাহিদ-আকিফ
ব্যাটসম্যানদের তাণ্ডবের মাঝে বৈচিত্র্যের ব্যবহারে দারুণ বোলিং করেন সাইফউদ্দিন। ৪ ওভারে ৩১ রান খরচ করে ২ উইকেট নেন তিনি। আগের তিন ম্যাচে গতির ঝড়ে দুর্দান্ত বোলিং করা নাহিদ এবার ৪ ওভারে খরচ করেন ৪৫ রান। পাকিস্তানি বাঁহাতি পেসার আকিফের ৪ ওভারে খরচ ৫১ রান।
আজিজুলের আরেকটি শূন্য
স্কোরবোর্ডে বিশাল পুঁজি নিয়ে বল হাতে চমৎকার শুরু করে সিলেট। প্রথম ওভারে আজিজুল হাকিম তামিমের ফিরতি ক্যাচ নেন তানজিম হাসান। আগের ম্যাচে প্রথম বলে ফেরা তরুণ ওপেনার এবার ৫ বলে রানের খাতা খুলতে পারেননি।
হেলস-সাইফের দাপট
শুরুর ধাক্কা পাত্তা দেননি হেলস ও সাইফ। উল্টো দাপুটে ব্যাটিংয়ে সিলেটের বোলারদের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করেন রংপুরের দুই ব্যাটসম্যান। প্রায় প্রতি ওভারেই ফুল টস, হাফ ভলি আর শর্ট বলের পসরা মেলে তাদের কাজ আরও সহজ করে দেন আল আমিন হোসেন, আরিফুল, নিহাদউজ্জামানরা।
তবু শুরুতে কিছুটা সময় নেন হেলস ও সাইফ। প্রথম ৪ ওভারে রংপুরের স্কোর ছিল ১ উইকেটে ২৪ রান। পঞ্চম ওভারে নিহাদউজ্জামানের বলে ছক্কা মারেন সাইফ। ওই ওভার থেকে আসে মোট ১৫ রান।
সেই শুরু, এরপর নিয়মিতই বড় রানের ওভার বের করতে থাকে রংপুর। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে দুই চারের মাঝে ছক্কা হজম করেন আল আমিন। পরের ওভারে নিহাদউজ্জামানের বলে আসে দুটি বাউন্ডারি।
একাদশতম ওভারে নিহাদউজ্জামানের বলই ছক্কায় উড়িয়ে মাত্র ৩১ বলে ফিফটি পূর্ণ করেন সাইফ। ওই ওভারেই একশ ছুঁয়ে ফেলে রংপুর। পরের ওভারে আরিফুলের বল তিনি দুবার পাঠান সীমানার ওপারে।
সাইফের সমান বলে ফিফটি করেন হেলসও। ততক্ষণ পর্যন্ত ৭ চারের সঙ্গে তার ছক্কা ছিল একটি। এরপর আরও বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন ইংলিশ ওপেনার। রিস টপলির বলে চারের পর মারেন ছক্কা।
ষোড়শ ওভারে আরিফুলের ওভারে একটি চারের সঙ্গে তিনটি ছক্কা মেরে নব্বইয়ে পৌঁছে যান হেলস। পরের ওভারে টপলির বলে নিজের সপ্তম ছক্কা মারেন সাইফ।
একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল অবিচ্ছিন্ন জুটিতেই ম্যাচ জিতে যাবে রংপুর। তবে তানজিমের শর্ট বলে ছক্কা মারতে গিয়ে লং অনে ধরা পড়ে যান সাইফ। ভাঙে ১৮৬ রানের জুটি। আগের ম্যাচে দুজন গড়েছিলেন ১১৩ রানের জুটি।
বিপিএলের এক আসরে একাধিক শতরানের জুটি গড়া পঞ্চম যুগল হেলস ও সাইফ।
সাইফের বিদায়ের পর ৫৪ বলে বিপিএলে দ্বিতীয় ও ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি স্পর্শ করেন হেলস। ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এই সংস্করণে তার চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি আছে শুধু জস বাটলারের (৮টি)।
১৯তম ওভারে আল আমিনের বলে পরপর দুটি ছক্কা মেরে চওড়া হাসিতে মাঠ ছাড়েন হেলস।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
সিলেট স্ট্রাইকার্স: ২০ ওভারে ২০৫/৪ (রনি ৫৪, মানজি ১৮, জাকির ৫০, স্টার্লিং ১৬, জোন্স ৩৮*, জাকের ২০*; সাইফউদ্দিন ৪-০-৩১-২, মেহেদি ৪-০-৩৮-১, আকিফ ৪-০-৫১-১, নাহিদ ৪-০-৪৫-০, খুশফিল ২-০-২১-০, ইফতিখার ১-০-৪-০, রকিবুল ১-০-১৩-০)
রংপুর রাইডার্স: ১৯ ওভারে ২১০/২ (হেলস ১১৩*, আজিজুল ০, সাইফ ৮০, ইফতিখার ৮*; তানজিম ৪-০-২৩-২, আল আমিন ৪-০-৫৩-০, টপলি ৪-০-৩৭-০, নিহাদউজ্জামান ৪-০-৪৪-০, আরিফুল ৩-০-৫১-০)
ফল: রংপুর রাইডার্স ৮ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: অ্যালেক্স হেলস