Published : 29 Oct 2022, 04:38 PM
চোখধাঁধানো দুটি ছক্কা, ৬ বলে ১৫ রান, স্ট্রাইক রেট ২৫০। বাংলাদেশের টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট শ্রীধরন শ্রীরাম যেরককম ‘ইন্টেন্ট’ দেখতে চান, সেরকমই দেখা গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সৌম্য সরকারের ব্যাটে। তার খুশিই হওয়ার কথা। তবে সেদিন ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ওই ইনিংস নিয়েই বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন জেমি সিডন্স। বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচের মতে, স্রেফ ছক্কার ভাবনায় ডুবে না থেকে ‘স্মার্ট’ ক্রিকেট খেলতে হবে ব্যাটসম্যানদের।
এমনিতেই ‘ইন্টেন্ট’ ও ‘ইম্প্যাক্ট’ নিয়ে গত কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলোচনা তুমুল। যদিও এগুলো নিয়ে আগেও নানা সময় টুকটাক কথা হয়েছে। তবে শ্রীরাম দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এসবের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কথার সেই স্রোত এখনও ২২ গজের মোহনায় মিলতে পারেনি। টি-টোয়েন্টিতে স্মার্ট ক্রিকেট খেলার তাড়নাও বাংলাদেশের কোচ ও ক্রিকেটারদের কণ্ঠে নানা সময় শোনা গেছে। মাঠে প্রতিফলন পড়েনি খুব একটা। সিডন্স সেই প্রসঙ্গ তুলে আনলেন আরেক দফায়।
তবে ‘ইন্টেন্ট’, ‘ইম্প্যাক্ট’ আর ‘স্মার্ট ক্রিকেট’ মিলিয়ে এমন জগাখিচুড়ি অবস্থা যে, ক্রিকেটারদের বিভ্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ক্রিকেটারদের কাছে সঠিক ও স্বচ্ছ বার্তা যাচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্নও জাগছে।
শ্রীরাম যেমন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বেশ কবারই বলেছেন, ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনি অভিপ্রায় দেখতে চান। শট খেলতে গিয়ে আউট হলেও আপত্তি নেই। সাব্বির রহমানের ৫ রানের ইনিংস, নাজমুল হোসেন শান্ত বা সৌম্য সরকারের একটি-দুটি শট থেকেই তাই ‘ইন্টেন্ট’ খুঁজে বের করা হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু স্রেফ এটুকুই বা বড় শটের চেষ্টা করাই যে যথেষ্ট নয়, এটা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সিডন্সের কথায়ই ফুটে ওঠে।
“সীমানা পার করার চেষ্টা আমরা একটু বেশিই করেছি। আমরা তো ক্রমাগত ছক্কা মারার মতো দল নই। আরও স্মার্ট হতে হবে আমাদের। বাতাসে বল উড়িয়েছি আমরা একটু বেশিই। ভালো একটা শুরুর পর আমরা বাতাসে বল উড়িয়ে উইকেট হারিয়েছি এবং নিজেদের চাপে ফেলেছি।”
“রাইলি রুশো, কুইন্টন ডি ককরা যা করে, আমাদের কৌশল আরেকটু ভিন্ন হতে হবে। ছক্কা মারার চেষ্টা করে খুব বেশি ম্যাচ আমরা জিততে পারব না। স্মার্ট ক্রিকেট খেলতে হবে আমাদের। সৌম্য দারুণ কয়েকটি শট খেলেছে। কিন্তু ওকে আরও স্মার্ট হতে হবে, শান্তকে আরও স্মার্ট হবে হবে। এই মুহূর্তে ওরা দ্রুত রান করছে ও দ্রুত আউট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরেকটু লম্বা সময় ব্যাট করতে হবে।”
টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট ও ব্যাটিং কোচের কথায় তাই দুই রকম সুর ফুটে উঠছে স্পষ্টভাবেই। দক্ষিণ আফ্রিকার ওই ম্যাচে বাংলাদেশের ২ ওভারে ২৬ রান তোলা নিয়ে যেমন শ্রীরাম সন্তুষ্টির কথা শোনালেন শনিবার ব্রিজবেনে সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু দুইশর বেশি রান তাড়ায় স্রেফ শুরুর ২ ওভারে কিছু শট খেলার পর আত্মহত্যা করে ফিরলে যে দলের সম্ভাবনাও মরে যায়, ওই ম্যাচেই তো প্রমাণ হয়ে গেছে।
‘ইন্টেন্ট’, ‘ইম্প্যাক্ট’ ও ‘ম্মার্ট’ ক্রিকেট, তাত্ত্বিকভাবে কোনোটিই খারাপ নয় এবং পরস্পর সম্পর্কিত। কিন্তু কোনো একটিতে ঘাটতি থাকলে সবটুকুই অকার্যকর হয়ে পড়ে।
স্মার্ট ক্রিকেটের তাড়না নানা সময়ে নানা রূপে ফিরে এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। একসময় বাংলাদেশি ব্র্যান্ড নিয়েও আলোচনা হয়েছে। যেহেতু এই দেশের ক্রিকেটারদের পেশীর জোর খুব বেশি নেই, যেহেতু একাই পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো ক্রিকেটার নেই বললেই চলে, তাই স্মার্ট ক্রিকেট খেলে এই সংস্করণে সাফল্যের পথ খোঁজা হয়েছে। সেই স্মার্ট ক্রিকেটের নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কখনও কখনও দু-একটি ম্যাচে বা সিরিজে সেই স্মার্টনেসের ছাপ পড়েছে। বেশির ভাগ সময়ই তা ছিল উধাও।
স্মার্ট ব্যাটিং এমন একটি ব্যাপার, যেটির আদর্শ কোনো সংজ্ঞা নেই। সাধারণ অর্থে বলা যায়, ভেন্যু, উইকেট, প্রতিপক্ষ, ম্যাচের অবস্থা, নানা কিছু বিবেচনায় পরিস্থিতির দাবি মেটানো। অস্ট্রেলিয়ায় স্মার্ট ব্যাটিংয়ের একটি সংজ্ঞা শ্রীরাম তুলে ধরলেন ব্রিজবেনে রোববার সংবাদ সম্মেলনে।
“মাঠের ডাইমেনশন কাজে লাগানো... এটা বুঝতে হবে। উপমহাদেশে খেলার চেয়ে এটা ভিন্ন… এমনকি নিউ জিল্যান্ডের কোনো কোনো জায়গার চেয়েও আলাদা। অস্ট্রেলিয়া মেলে ধরে স্বতন্ত্র চ্যালেঞ্জ। এখানে কিছু মাঠ কোনাকুনিভাবে বড়, কিছু মাঠের সীমানা অনেক বড়, কিছু মাঠ আড়াআড়ি ছোট কিন্তু লম্বালম্বি বড়।”
“ডাইমেনশন অনুযায়ী খেলা, ব্যাটসম্যানের শক্তির জায়গাটা জেনে ফাঁকা জায়গায় বল পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ। জেমি (সিডন্স) এসব নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেছে।”
কথা বলার পালা চলে আসছে আসছে জেমি সিডন্স ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগে থেকেই। কিন্তু লাভ খুব বেশি হয়নি। হাহাকার তাই ক্রমেই দীর্ঘ হয়েছে। এখন তো ‘ইন্টেন্ট’, ‘ইম্প্যাক্ট’ আর ‘স্মার্ট’ ক্রিকেটের গোলকধাঁধায় পড়ে নিজেদের আপন সত্ত্বাও উধাও হওয়ার পথে।