আলো ঝলমলে ক্যারিয়ারে অনেক রেকর্ড-অর্জন-কীর্তি ছাপিয়ে ব্রড স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার লড়িয়ে মানসিকতার জন্য।
Published : 30 Jul 2023, 08:26 PM
৮ রানের ছোট্ট ইনিংস, তাতে একটি ছক্কা। পরিসংখ্যান বলবে, ক্রিকেট মাঠে নিজের খেলা শেষ বলটি ছক্কায় উড়িয়েছেন স্টুয়ার্ট ব্রড। গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো শেষ বলে উইকেট নিতে পারবেন কি না, তা বলবে সময়। তবে একটি ব্যাপার নিশ্চিত, ক্যারিয়ারের শেষ বলটিতেও চেষ্টার কমতি রাখবেন না তিনি। কখনোই তা রাখেন না। ব্রড মানেই নিজেকে উজাড় করে দেওয়া। নিবেদন তার শক্তি। তাড়না তার জ্বালানি। লড়াই তার পরিচয়।
প্রায় ১৬ বছরে ১৬৭ টেস্টের পথচলা। ছয়শর বেশি উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দেড়শ উইকেট শিকারের একমাত্র কীর্তি। অসাধারণ সব ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স আর স্মরণীয় সব স্পেল। রেকর্ড, অর্জন আর কীর্তিতে ভাস্বর ক্যারিয়ার। তবে সব ছাপিয়ে তার নামের প্রতিশব্দ যেন লড়াই।
তার জীবনের শুরুই তো তুমুল লড়াই দিয়ে! বল হাতে একদিন ক্রিকেট দুনিয়া রাঙাবেন বলেই কি না, পৃথিবীতে আসতে তর সইছিল না তার। ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটার ক্রিস ব্রড ও স্কুল শিক্ষিকা ক্যারলের এই সন্তান সম্ভাব্য সময়ের প্রায় ১২ সপ্তাহ আগেই চলে আসে দুনিয়ার আলো-হাওয়ায়। ওজন এক কেজিও হয়নি তখন!
ব্যস, এক মাস তাকে লড়তে হলো ইনকিউবেটরে। ‘জন’ নামের এক চিকিৎসকের চেষ্টায় জীবন বেঁচে গেল। নবজাতকের নামের সঙ্গে ডাক্তারের নামও যুক্ত করে দিলেন বাবা-মা, ‘স্টুয়ার্ট ক্রিস্টোফার জন ব্রড।’
ক্রীড়া বলয়ে বেড়ে উঠেছেন, পেশাদার ক্রীড়াবিদ তার হওয়ারই কথা ছিল। টানাপোড়েন ছিল, হকি নাকি ক্রিকেট! ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত হকিও খেলেছেন চুটিয়ে। ছিলেন গোলকিপার। তবে রক্তে তো ক্রিকেট। চলে আসেন বাবার খেলাতেই। তাতে তিনি যেমন আপন স্রোতে মিশে যান, তেমনি এই খেলাটিও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে আরও।
শুরুতে ছিলেন বাবার মতোই ব্যাটসম্যান। ক্রমে বোলার সত্ত্বাই বড় হয়ে ওঠে। ইংলিশ ক্রিকেটের নানা ধাপ পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। অস্ট্রেলিয়ায় ক্লাব ক্রিকেট খেলে পোক্ত হয়ে আসেন। প্রতিটি মৌসুমেই উন্নতি করে চমকে দিতে থাকেন চারপাশের সবাইকে। ২০০৬ সালে ২০ বছর বয়সে স্বপ্ন পূরণ হয় দেশের হয়ে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠে নেমে।
টি-টোয়েন্টি অভিষেকে দ্বিতীয় ওভারেই তার শিকার দুই উইকেট। টানা দুই বলে আউট শোয়েব মালিক ও ইউনিস খান। দুদিন পর ওয়ানডে অভিষেকে প্রথম ওভারেই উইকেট। এবারও শোয়েব মালিক। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিনতম দিকটাও তার দেখা হয়ে যায় বছর ঘুরতেই। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ডারবানের রাতের আকাশে উড়ে সাদা বল আছড়ে পড়তে থাকে কিংসমিড স্টেডিয়ামের নানা প্রান্তে। এক ওভারে একে একে ছয় ছক্কা!
ব্রড তাতে জোর ধাক্কা খেয়েছেন। তবে ভেঙে পড়েননি। পরে তিনি অনেকবারই বলেছেন, যুবরাজ সিংয়ের ব্যাটে ছয় ছক্কা হজম করেই লড়াইয়ের মন্ত্র শিখেছেন। নতুন আশার সঞ্জীবনী সুধা পান করেছেন। বিদায় ঘোষণার দিন ওভালে শনিবার সংবাদ সম্মেলনেও বলেছেন আরেকবার, ওই দিনটির পর থেকেই ‘যোদ্ধা’ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন তিনি।
ডারবানের সেই কালো রাতের মাস তিনেক পরই ইংল্যান্ডের হয়ে সাদা পোশাকে তার অভিষেক। তার প্রথম টেস্ট অধিনাক মাইকেল ভন পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে করতে পারেন সবকিছুই, “তাকে নিয়ে আমার গবেষণা ছিল যে, সে দুর্দান্ত এক বোলার হয়ে উঠছে, মোটামুটি ভালো ব্যাটসম্যান আর মানসিকভাবে ভীষণ কঠিন এক চরিত্র। খুবই সুনিশ্চিত সে। উদ্ধত ধরনের নয়, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। খেলাটা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসত। ড্রেসিং রুমে কিছু কিছু ক্রিকেটারকে দেখেই বোঝা যায় যে, অনেক বছর থাকবে। শ্রীলঙ্কায় তার প্রথম টেস্টে লম্বা সময় মাঠে থাকতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু সে ভেঙে পড়েনি এবং হাল ছাড়েনি। সে প্রথম তরুণ বোলারদের একজন, যে নিজের মতো করে ফিল্ডিং সাজাতো।”
প্রথম টেস্ট উইকেটের স্বাদ পেতে ২৯ ওভার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ওই কন্ডিশনে অভিষেকে ৩৬ ওভার বোলিং করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, লড়াইটা করতে জানেন।
ক্যারিয়ারজুড়ে লড়াকু পরিচয়টাই তাকে তুলে ধরেছে আলাদা করে।
তিন সংস্করণে আলো ছড়িয়ে এগিয়ে গেছেন। ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের জয়ে বড় অবদান লেখেছেন। সেমি-ফাইনালে ছিলেন ম্যাচ সেরা। বছর তিনেক টি-টোয়েন্টি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চট্টগ্রামে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হারের পর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত হয়েছেন। ওই বিশ্বকাপের পর আর এই সংস্করণে দেশের হয়ে খেলা হয়নি তার। ২০১৫ বিশ্বকাপে বিপর্যয়ের পর ওয়ানডে খেলেছেন স্রেফ আর দুটি।
এই যুগে রঙিন পোশাকে না খেলে নিজেকে উজ্জ্বল করে মেলে ধরা কঠিন। কিন্তু প্রিয় বন্ধু ও বোলিং জুটির সঙ্গী জিমি অ্যান্ডারসনের মতো তিনেও প্রাসঙ্গিক থেকে গেছেন পারফরম্যান্স দিয়েই। প্রতিবন্ধকতা এসেছে, বাজে সময় এসেছে। আগুনে পুড়ে তিনি খাঁটি হয়েছেন।
সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে গত কয়েক বছরের দূরত্ব নিশ্চিত ভাবেই টেস্টে তার পথচলা দীর্ঘায়িত করতে সহায়ত করেছে। ব্রড মানে তো টেস্ট ক্রিকেটের ব্রডই!
২০১৫ অ্যাশেজে ঘরের মাঠ ট্রেন্ট ব্রিজ দেখে তার সেরা বিধ্বংসী চেহারা। ১৫ রানে ৮ উইকেট নিয়ে প্রথম দিনেই লাঞ্চের আগে অস্ট্রেলিয়াকে গুটিয়ে দেন ৬০ রানে। তবে মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স তার কম নেই আরও।
ট্রেন্ট ব্রিজেই ২০১১ সালে ভারতের বিপক্ষে ৫ রানে ৫ উইকেটের স্পেল, পরের বছর হেডিংলিতে এবি ডি ভিলিয়ার্স, জ্যাক ক্যালিসদের গুঁড়িয়ে ৫ উইকেটের স্পেল, ২০১৩ সালে লর্ডসে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৪ রানে ৭ উইকেট, এই বছরই অ্যাশেজে চেস্টার-লি-স্ট্রিট টেস্টে ১১ উইকেট, ২০১৬ সালে জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৭ রানে ৬ উইকেট… তালিকা চলতেই থাকবে।
ব্যাট হাতে তার সম্ভাবনাগুলো পূর্ণতা পায়নি পুরোপুরি। ২০১০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে লর্ডসে ৯ নম্বরে নেমে ১৬৯ রানের ইনিংস খেলে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ব্যাটসম্যান হিসেবে পরে সেই উচ্চতায় উঠতে পারেননি। তবে কখনও কখনও ঠিকই দেখিয়েছেন ঝলক। ৫০০ উইকেটের সঙ্গে ৩ হাজার রান, এই যুগলবন্দি টেস্ট ইতিহাসে কেবল দুজনেরই আছে। ব্রড ও শেন ওয়ার্ন।
বল হাতে টেস্ট ক্যারিয়ারে তার প্রথম সত্যিকারের ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স সম্ভবত ২০০৯ অ্যাশেজের ওভাল টেস্টে। ম্যাচ সেরাও প্রথম হয়েছিলেন সেবারই। সেই ওভালেই ক্যারিয়ারের ইতি টানছেন। বৃত্ত পূরণ!
বিদায়ী সিরিজ, বিদায়ী অ্যাশেজেও দলের সফলতম বোলার তিনি। এভাবেই ক্যারিয়ারজুড়ে রাঙিয়েছেন বড় উপলক্ষগুলি। ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটারদের জন্য অ্যাশেজের চেয়ে বড় উপলক্ষ আর কী আছে! ব্রড রাজত্ব করেছেন অ্যাশেজে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনি টেস্ট ইতিহাসের সফলতম বোলার। শুধু উইকেট সংখ্যায়ই নয়, অ্যাশেজের যে উত্তেজনা, প্রবল চাপ, অ্যাশেজের আবহ, সবকিছুই তাকে তাতিয়ে দিয়েছে বরাবর, বের করে এনেছে তার সেরাটা। অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই, পারফরম্যান্স আর শরীরী ভাষায় জবাব, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া আর দর্শকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দাপুটে বিচরণ, সবকিছুই তাকে চিনিয়েছে আলাদা করে। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সেরা অধিনায়কদের একজন স্টিভ ওয়াহ তাই বলেছিলেন, ব্রডের মধ্যে তিনি খুঁজে পান অস্ট্রেলিয়ান চরিত্র।
বিদায়ের মঞ্চ হিসেবেও বেছে নিলেন অ্যাশেজকেই। নইলে তিনি আর ব্রড কেন!
ক্যারিয়ারের ঘাটতি বা অপূর্ণতা কিছু থাকলে তা উপমহাদেশে তার পারফরম্যান্স। ভারতে ৮ টেস্ট খেলে স্রেফ ১০ উইকেট তার। শ্রীলঙ্কায় ৪ টেস্টে ৬ উইকেট। পাকিস্তানে কখনও খেলেননি। বাংলাদেশে ৩ টেস্টে ৮ উইকেট। তবে উপমহাদেশের কন্ডিশন-উইকেট তো কঠিন পরীক্ষা নিয়েছে আরও কত কিংবদন্তি পেসারের!
নিজের শক্তির জায়গায় তিনি পোক্ত হয়েছেন সময়ের সঙ্গে। বয়স যত বেড়েছে, ততই যেন নিখুঁত হয়ে উঠেছেন। বোলিং গড় তিরিশের নিচে নামাতে তার লেগে গেছে ৭৪ টেস্ট। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টের আগে সেই গড় ২৮-এর নিচে।
বয়স ৩০ পেরিয়ে যাওয়ার পর ২৫৭ উইকেট শিকার করেছেন চলতি ওভাল টেস্টের শেষ ইনিংসের আগ পর্যন্ত। এই সময়ে বোলিং গড় ও স্ট্রাইক রেট তার ক্যারিয়ার গড় ও স্ট্রাইক রেটের চেয়েও ভালো!
তবে দিন শেষে, এসব পরিসংখ্যান, অর্জন আর রেকর্ড, অবিশ্বাস্য এই স্থায়িত্ব বা এই সব কিছু ছাপিয়ে ব্রড আরও বেশি কিছু।
বিদায় ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি নিজে যেমন বলেছেন, “আমি জানি, ইতিহাসের সবচেয়ে স্কিলফুল ক্রিকেটার আমি নই। আমি জানি, নিজের লড়াকু স্পিরিটের প্রতিটি ইঞ্চি, সবটুকু তাড়না এবং প্রচেষ্টা দিয়েই সামর্থ্যের সবটুকু বের করে আনতে হয় আমার। এভাবে মনপ্রাণ উজাড় করেই খেলেছি।”
এটিই স্টুয়ার্ট ব্রড।
ব্রড মানে সাদা ধবধবে হেড ব্যান্ড, ওই সাদা হ্যাট, কখনও চোয়ালবদ্ধ চেহারা, কখনও মুগ্ধতা ছড়ানো হাসি… আর নিবেদিতপ্রাণ এক ইংলিশ। লড়াকু এক যোদ্ধা।
তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে বটে। তবে ক্রিকেটে লড়াই ব্যাপারটি যতদিন থাকবে, ব্রডও থাকবেন, সদা প্রাসঙ্গিক হয়ে।