ভারত-নিউ জিল্যান্ড সিরিজ
১১ উইকেট নিয়ে মুম্বাইয়ে রোমাঞ্চকর জয়ের নায়ক এজাজ প্যাটেল, ইতিহাসে প্রথমবার দেশের মাঠে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইওয়াশড ভারত।
Published : 03 Nov 2024, 02:02 PM
স্লগ সুইপের চেষ্টায় ব্যাটে-বলে করতে পারলেন না ওয়াশিংটন সুন্দার। বল ছোবল দিল স্টাম্পে। হুঙ্কার ছুড়লেন বোলার এজাজ প্যাটেল। তাকে ঘিরে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেন সতীর্থরা। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে তখন আর কোনো আওয়াজ নেই। গ্যালারিতে যেন শ্মশানের নীরবতা। মাঠে গোল হয়ে উদযাপনে মেতে ওঠা নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের উল্লাস-ধ্বনিই স্রেফ ভেসে আসছিল বাতাসে।
এমন আনন্দ, আবেগের স্ফুরণ তো হবেই। ক্রিকেট ইতিহাসের কোনো দল যা পারেনি, সেটিই করে দেখাল এই নিউ জিল্যান্ড দল। ঘরের মাঠ যাদের দুর্গ, দেশের মাঠে যারা অপ্রতিরোধ্য ও অপরাজেয়, সেই ভারতকে হোয়াইটওয়াশ করে দিল কিউইরা!
মুম্বাই টেস্টে রিশাভ পান্তের ঝড় থামিয়ে রোমাঞ্চের দোলায় ভেসে ২৫ রানের স্মরণীয় জয় পেল নিউ জিল্যান্ড। সিরিজটিও তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে রইল অনন্য সাফল্যে।
দেশের মাঠে তিন বা এর বেশি ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশড হলো ভারত।
১১ উইকেট নিয়ে এই জয়ের নায়ক এজাজ প্যাটেল। প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়া বাঁহাতি স্পিনার দ্বিতীয় ইনিংসে শিকার করলেন ছয় উইকেট।
টেস্ট ইতিহাসের তৃতীয় বোলার হিসেবে ইনিংসে ১০ উইকেটের সবকটি নিয়েছিলেন তিনি এই মাঠেই। ২০২১ সালে সেই ম্যাচে তিনি মোট ১৪ উইকেট নেওয়ার পরও হেরেছিল নিউ জিল্যান্ড। এবার ১১ উইকেট নিয়ে ৩৬ বছর বয়সী স্পিনার দলকে এনে দিলেন মনে রাখার মতো জয়।
১৯৮৮ সালে তার জন্ম এই মুম্বাইয়েই (সেই সময়ের বোম্বে) এক গুজরাটি মুসলিম পরিবারে। জীবন এরপর তাকে নিয়ে গেছে নিউ জিল্যান্ডে। কিন্তু এখন তিনি ঠিকই মুম্বাইয়ের 'রাজা।' ইয়ান বোথামকে (২২ উইকেট) পেছনে ফেলে সফরকারী বোলারদের মধ্যে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সফলতম বোলার এখন তিনিই।
শেষ ইনিংসে নিউ জিল্যান্ড ও ইতিহাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেবল পান্ত। ৫৭ বলে ৬৪ রান করে ভারতের কিপার-ব্যাটসম্যান বিদায় নেন এজাজের বলেই।
৯ উইকেটে ১৭১ রান নিয়ে রোববার দিনের শুরু করে নিউ জিল্যান্ড। আর স্রেফ তিন রান যোগ করেই শেষ হয় তাদের ইনিংস। শেষ উইকেট নিয়ে ইনিংসে পাঁচ আর ম্যাচে ১০ উইকেট পূর্ণ করেন রাভিন্দ্রা জাদেজা।
এই নিয়ে ১৫ বার তিনি পেলেন ইনিংসে পাঁচ উইকেট, ম্যাচে ১০ উইকেট তৃতীয়বার।
তবে ভারতের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল এরপরই। ভীষণ শুষ্ক এবং এমন টার্নিং উইকেট ১৪৭ রানের লক্ষ্যও সহজ ছিল না মোটেও। আগের দিন শেষেই টিভিতে আলোচনায় ভারতের স্পিন কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে বলেছিলেন, এই উইকেটে দেড়শ রান তাড়া করতে হলেও ম্যাচে সম্ভাবনা ৫০-৫০। শেষ পর্যন্ত দারুণ রোমাঞ্চ ছড়িয়েই জিতল কিউইরা।
ভারতের রান তাড়ায় শুরুতে যদিও আগ্রাসী হওয়ার চেষ্টা করেন রোহিত শার্মা। এই উইকেটে শুরুতে একটি ঝড়ো ইনিংস খেলতে পারলে ম্যাচের প্রেক্ষাপটে তা হবে গুরুত্বপূর্ণ, জানতেন ভারতীয় অধিনায়ক। প্রথম ওভারে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ম্যাট হেনরিকে চার মারেন তিনি, পরের ওভারে এজাজ প্যাটেলকে রিভার্স সুইপে।
তবে অতি আগ্রাসন ডেকে আনে তার পতন। হেনরির অফ স্টাম্পের বাইরের লেংথ বল তুলে মারতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে ফেরেন তিনি।
এরপর এজাজের ছোবলে ভারতের ব্যাটিং অর্ডার ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মতো। বল ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হন শুবমান গিল। স্লিপে ড্যারিল মিচেলের দারুণ ক্যাচে ভিরাট কোহলি ফেরেন এক রানে।
সিরিজের ছয় ইনিংসে রোহিত ও কোহলির প্রাপ্তি স্রেফ একটি করে ফিফটি।
আগ্রাসনের চেষ্টায়ই এজাজের ফুল টসে ক্যাচ দিয়ে বসেন সারফারাজ খান। মাঝে ইয়াসাসভি জয়সওয়ালকে ফেরান গ্লেন ফিলিপস।
ভারত ৫ উইকেট হারায় ২৯ রানে।
এরপর শুরু হয় পান্তের পাল্টা আক্রমণ, আদতে যা তার সহজাত ব্যাটিং। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই ছক্কায় শুরু করেন তিনি। চাপের মধ্যেও নিজের মতো করেই ছুটতে থাকেন দারুণ সব শট খেলে।
তাকে ফেরানোর বড় একটি সুযোগ নিউ জিল্যান্ড পেয়েছিল। এজাজের বল লেগেছিল তার প্যাডে। আম্পায়ার আউট দেননি। তবে পরে দেখা যায়, রিভিউ নিলেই আউট হতেন পান্ত।
২১ রানে রক্ষা পাওয়া সেই পান্ত নিউ জিল্যান্ডের হাত থেকে ম্যাচ বের করে নেওয়ার হুমকিই দিচ্ছিলেন। টেস্ট ক্যারিয়ারে অসাধারণ কিছু ইনিংস তিনি এর মধ্যেই খেলেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এবার আর ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলতে পারেননি।
লাঞ্চের পর রিভিউ নিয়ে তাকে ফেরান এজাজ। যদিও ব্যাট-প্যাড ক্যাচটিতে আদৌ বল তার ব্যাটে লেগেছিল নাকি ব্যাট লেগেছিল প্যাডে, সেটা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ ছিল যথেষ্টই। তৃতীয় আম্পায়ার পল রাইফেল বারবার রিপ্লে দেখে আউটই দেন। নিউ জিল্যান্ডের উল্লাসেই ফুটে উঠছিল, জয়ের সুবাস তারা পেয়ে গেছেন।
ভারতের জয়ের জন্য তখন লাগে ৪১ রান। ওয়াশিংটন সুন্দার ও রাভিচান্দ্রান অশ্বিন তখন ক্রিজে। যথেষ্ট ভালো ব্যাটসম্যান দুজনই। কিন্তু এই উইকেটে যে কাজটা কঠিন!
অশ্বিন বিদায় নেন রিভার্স সুইপের চেষ্টায়। পরের বলেই দারুণ টার্নে আকাশ দিপকে বোল্ড করেন ফিলিপস।
তবে ম্যাচের শেষটা তো এজাজকে দিয়েই হতে হতো! ভারতের শেষ ভরসা ওয়াশিংটনকে বোল্ড করে ম্যাচও শেষ করে দেন এই বাঁহাতি স্পিনার। কোনো রান যোগ না করেই শেষ তিন উইকেট হারায় ভারত।
ম্যান অব দা ম্যাচ তো অবধারিতভাবেই এজাজ প্যাটেল। এই ম্যাচে জোড়া ফিফটি করা উইল ইয়াং জেতেন ম্যান অব দা সিরিজের পুরস্কার। অথচ কেন উইলিয়ামসন থাকলে হয়তো তিনি খেলার সুযোগই পেতেন না।
এবারের আগে প্রায় ৭০ বছরে ১২ বারের ভারত সফরে কোনো সিরিজ জয় ছিল না নিউ জিল্যান্ডের। আগের ৩৬ টেস্টে জয় ছিল মোটে দুটি। এই সফরে তারা পায়নি দলের সেরা ব্যাটসম্যান কেন উইলিয়ামসনকে। কদিন আগে তারা বাজেভাবে হেরে এসেছে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে। সেই দলটিই এবার চমকে দিল গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে।
পুনে টেস্টে হেরে দেশের মাঠে ১২ বছর পর প্রথম সিরিজ হারল ভারত। পুনেতে নিউ জিল্যান্ডের জয়ের নায়ক মিচেল স্যান্টনার মুম্বাইয়ে খেলতে পারেননি চোটের কারণে। তার পরও ভারত হেরে গেল আবার, প্রথমবার তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইওয়াশড হলো তারা দেশের মাঠে। নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে টম ল্যাথামের যাত্রা শুরু হলো অভাবনীয় সাফল্যে।
সাবেক পেসার সাইমন ডুল ধারাভাষ্যকক্ষে যথার্থই বললেন, 'নিউ জিল্যান্ডের টেস্ট ইতিহাসের সেরা সিরিজ জয়।'
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউ জিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ২৩৫
ভারত ১ম ইনিংস: ২৬৩
নিউ জিল্যান্ড ২য় ইনিংস: ১৭৪
ভারত ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ১৪৭) ২৯.১ ওভার ১২১ (জয়সওয়াল ৫, রোহিত ১১, গিল ১, কোহলি ১, পান্ত ৬৪, সারফারাজ ১, জাদেজা ৬, ওয়াশিংটন ১২, অশ্বিন ৮, আকাশ ০, সিরাজ০*; হেনরি ৩-০-১০-১, এজাজ ১৪.১-১-৫৭-৬ , ফিলিপস ১২-০-৪২-৩)
ফল: নিউ জিল্যান্ড ২৫ রানে জয়ী
ফল: তিন ম্যাচ সিরিজে নিউ জিল্যান্ড ৩-০ ব্যবধানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: এজাজ প্যাটেল
ম্যান অব দা সিরিজ: উইল ইয়াং