Published : 29 Apr 2025, 01:06 PM
পাঁচ বছর ধরে তোলা ‘মুষ্টির চাল’ বিক্রি ও দানের টাকায় রাস্তা সংস্কার করার চেষ্টা করেছেন টাঙ্গাইলের দুই গ্রামের মানুষ। তবে ক্ষুদ্র সামর্থে্য সম্পূর্ণ মেরামত সম্ভব না হওয়ায় প্রশাসনের কাছে স্থায়ীভাবে রাস্তা পাকা করার দাবি গ্রামগুলোর হাজারো বাসিন্দার।
ডুবাইল ও গবড়া নামের গ্রামগুলোর অবস্থান জেলার দুই উপজেলার সীমান্তে এলাকায়। এর মধ্যে গবড়া মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নে এবং ডুবাইল দেলদুয়ার উপজেলায় ডুবাইল ইউনিয়নে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হয়ে গেলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি প্রত্যন্ত এই গ্রাম দু’টিতে। এক কিলোমিটার দীর্ঘ ভঙ্গুর এই রাস্তাটাই গ্রামগুলোয় যাতায়াতের একমাত্র পথ। তাই এখন তাদের গলার কাটা।
তাদের ভোগান্তি দূর করদে নানা সময় জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসন রাস্তা সংস্কারের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি।
গবড়া গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী মধু মিয়া বলেন, “এই রাস্তা নিয়ে আমরা সবার কাছে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ কোনো গুরুত্ব দেয় না। অনুদান আসে, অন্য দিকে চলে যায়। তাই আমরা রাস্তাটা সবাই চান্দা ধরে উঠিয়ে মেরামত করতেছি। কিন্তু এখন তো টাকা পয়সা কিছু নাই।”
স্থানীয়রা জানান, গ্রাম দুটি নিচু এলাকা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে গ্রামীণ এই কাঁচা রাস্তাটি তলিয়ে থাকে। তখন নৌকায় চলাচল করতে হয়। পরে শুষ্ক মৌসুমে রাস্তা চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অল্প বৃষ্টিতেই যানবাহন চলাচলতো দূরের কথা কাঁদা মাটিতে হেঁটে চলাচলই দায় হয়ে পড়ে।
এতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, অসুস্থ হলে হাসপাতালে রোগী নিয়ে যেতে কষ্ট করতে হয় স্থানীয়দের।চলাচলের এমন দুর্ভোগে এলাকার ছেলে-মেয়েদের ভাল জায়গায় বিয়েও হচ্ছে না বলে অনেকের অভিমত।
গ্রামবাসী জানায়, বাধ্য হয়ে ৫ বছর ধরে দুই গ্রামের মানুষ মিলে সাপ্তাহিকভাবে পাড়া মহল্লায় মুষ্টির চাল তুলছেন। সংগ্রহ করা চাল বাজারে বিক্রি করে সেই টাকা এবং নিজেরা কিছু টাকা জমিয়ে চলাচলে অনুপযোগী রাস্তা সচল করতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মাটি ফেলেছেন। কিন্তু তাতেও তারা পুরো কাজ শেষ করতে পারেননি।
রাস্তাটি পাকা হলে দুই উপজেলা ছাড়াও বাসাইল উপজেলার হাজারও মানুষের উপকার হবে বলে জানান স্থানীয়রা।
৩৬ বছর বয়সী সোহেল মিয়া বলেন, “কতো বছর যাবত এই রাস্তা অবহেলিত, শত চেষ্টা করেও চেয়ারম্যান, মেম্বার-এমপির কাছে আবেদন করে চলাফেরার কোনো সচ্ছলতা পাই নাই। তবে লাস্ট মুহূর্তে আমাদের মুষ্ঠি ফান্ডের টাকায় আমরা কিছু কাজ করেছি, তারপরেও আমরা কাজ পরিপূর্ণ করতে পারি নাই।”
তিনি বলেন, “সারা বাংলাদেশে ডিজিটাল হইছে, মির্জাপুর থানার লাস্ট প্রান্ত দেলদুয়ার উপজেলার এই অঞ্চল ডিজিটালে পড়ে না। প্রশাসন-কর্মকর্তার কাছে আবেদন করতেছি আমাদের ৪০ বছরের ভুক্তভোগী রাস্তাটা অবহেলিত রাস্তায় দৃষ্টি দেন, কাজ করে দেন- আমরা রক্ষা পাবো।”
৬০ বছর বয়সী মো. আলী আজম বলেন, গ্রামে একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠান আছে। একটা হাফিজিয়া খানা আছে। এখানে সামান্য বর্ষা হলেই কোমর পর্যন্ত পানি হয়ে থাকে। ওনাদের প্রতিষ্ঠানে বাচ্চারা যাতায়াত করতে পারে না। নৌকা-টৌকা এখন চলেই না।
“তাছাড়া এই এলাকার দিকে কেউ নজরও দেয় না। চেয়ারম্যান মেম্বার যারাই আসে, যখন এমপিরা আসে, যখন নির্বাচন হয় তখন তারা আগে উল্লেখ করে গবড়ার এই রাস্তাটা কইরা দিমু। এমপি হইয়া গ্যালে আর আমাদের খবর বার্তা নাই।”
গবড়া গ্রামের এই প্রবীণ বলেন, “আমাদের পরিবার নিয়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নাই। একটা রুগী হাসপাতালে নেওয়ার মতো কোনো ক্ষমতা নাই। আমাদের সমিতিতে কিছু টাকা ছিলো। যতটুকু পারছি করেছি। এখন আমাদের আর উপায় নাই, সামর্থ্যও নাই।”
৩১ বছর বয়সী মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “মির্জাপুর উপজেলার গোবরা, দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল, এখানে দুই সীমান্ত হওয়ার কারণে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তর মতো হওয়ার কারণে মেম্বার, চেয়ারম্যান কিংবা উপজেলা কর্মকর্তা, কেউ আমাদের এখানে সুদৃষ্টি দেয় নাই। কোনো মূল্যায়ন করে নাই।
তিনি বলেন, “আমাদের মুষ্ঠি সমিতি নামে একটা ফান্ড আছে। বিগত ৫ বছর টাকা জমিয়ে চাউল বিক্রি করে আমরা মাটি ফালাইছি। মাটি ফালানোর পর টাকার ঘাটতি আছে, সমাজবাসীর কাছে আবারও মুষ্টি বা টাকা তুলে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে সেইটুকুই দিয়ে আমরা এ পর্যন্ত মাটি ফালাইছি। বর্তমানে ফান্ডে টাকা নাই। ”
গ্রামের কলেজ শিক্ষার্থী ইফাত মিয়া (২০) বলেন, “ছোটবেলা থেকে এই রাস্তাটা এরকমই দেখতেছি। বর্ষাকালে কলেজে যাইতে কষ্ট হয়।”
ডুবাইল গ্রামের ২৭ বছর বয়সী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা নিজের উদ্যোগে রাস্তাটা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করতেছি। আমাদের যতটুকু সম্ভব, ততটুকু বাস্তবায়ন করতে পারতেছি। ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি মেম্বার এবং দয়াবান ব্যক্তিদের আহ্বান জানাচ্ছি এই রাস্তাটা দ্রুত তৈরি করলে সবাই চলাচল করতে পারে।
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ. বি. এম. আরিফুল ইসলাম বলেন, “বিষয়টি আমাকে কেউ অবগত করেনি। স্থানীয়দের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “যোগাযোগ করা হলে সরেজমিন পরিদর্শন করে গুরত্বপূর্ণ এই রাস্তাটি দ্রুত সংস্কার করার চেষ্টা করা হবে। ”