বিশ্বকাপে খেলারই কথা ছিল না যার, সেই অ্যালেক্স হেলস ইংল্যান্ডকে তুললেন ফাইনালে।
Published : 10 Nov 2022, 06:33 PM
জনি বেয়ারস্টো চোটে না পড়লে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দূরে থাক, ইংল্যান্ড জাতীয় দলেই হয়তো থাকা হতো না অ্যালেক্স হেলসের। অভাবনীয়ভাবে পাওয়া সুযোগটা কী দারুণ ভাবেই না কাজে লাগাচ্ছেন এই ওপেনার। বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে রান তাড়ায় বিস্ফোরক ইনিংস খেলে জয়ের নায়ক তিনিই।
অ্যাডিলেইডে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে ভারতকে ১০ উইকেটে উড়িয়ে ফাইনালে পা রাখে ইংল্যান্ড। ভারতের ১৬৮ রান হেলস ও জস বাটলারের অবিচ্ছিন্ন উদ্বোধনী জুটিতেই ইংলিশরা পেরিয়ে যায় ৪ ওভার বাকি থাকতে।
৪৭ বলে ৮৬ রানের খুনে ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা হেলস। ইনিংসে ৭টি ছক্কার পাশে চার ৪টি। তিনি জয়ের নায়ক হলে পার্শ্বনায়ক বাটলার। ইংলিশ অধিনায়ক ৪৯ বলে ৯ চার ও ৩ ছক্কায় করেন ৮০ রান।
এই দুজনের ১৭০ রানের জুটি বিশ্বকাপের ইতিহাসে যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ। এই আসরে সিডনিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক ও রাইলি রুশোর ১৬৮ রানের জুটি ছিল আগের সেরা।
রান তাড়ায় ভুবনেশ্বর কুমারের প্রথম ওভারে তিনটি বাউন্ডারি মেরে সুর বেঁধে দেন বাটলার। প্রথম ৫ বলে হেলসের রান ছিল ৫। এরপর ভুবনেশ্বরকে লং-অফ দিয়ে ছক্কায় উড়িয়ে ডানা মেলে দেন তিনি।
হেলসের সামনে পাত্তা পাননি ভারতের কোনো বোলারই। অন্য দুই পেসার মোহাম্মদ শামি, আর্শদিপ সিং এবং দুই স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও আকসার প্যাটেলকেও ছক্কা হাঁকান তিনি। ফিফটি পূর্ণ করেন স্রেফ ২৮ বলে; এর মধ্যেই ছক্কা হাঁকান পাঁচটি।
১২ ওভার শেষে ইংল্যান্ডের রান যখন ১২৩, হেলসের রানই ৭৭। বাটলারের রান তখন ৪২। পরে ঝড় তোলেন তিনিও। দলকে ফাইনালে তুলে জয়ীর বেশে মাঠ ছাড়েন দুজন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হেলসের দ্বিতীয় সেরা ইনিংস এটি। ২০১৪ আসরে চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে রান তাড়ায় ৬৪ বলে অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংসে জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি।
সেই ম্যাচের পর এই প্রথম বিশ্বকাপে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেলেন ৩৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে এই স্বাদ পেলেন ষষ্ঠবার।
ভারতের বিপক্ষে ইনিংসটির পথে ইংল্যান্ডের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে দুই হাজার রানের মাইলফলকও পেরিয়ে যান হেলস।
অথচ মাস দুয়েক আগেও জাতীয় দলের সীমানা তার জন্য ছিল দূরের বাতিঘর। শৃঙ্খলা আর দলের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতির কারণে ইংল্যান্ড দলের দরজা তার জন্য বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন।
গভীর রাতে পানশালায় মারামারি থেকে শুরু করে নানা সময়ে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় জড়ান তিনি। বারবার পার পেলেও ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে ডোপ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে আবার জায়গা হারান দলে।
এরপর থেকে অনেকটা সময় তার দিকে আর ফিরে তাকানো হয়নি। সেই সময়ের অধিনায়ক ওয়েন মর্গ্যান বলেছিলেন, দলীয় মূল্যবোধকে বারবার অবজ্ঞা করেছেন হেলস ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন ড্রেসিং রুমের।
এতে সবাই ধারণা করেছিল, জাতীয় দলের দুয়ার হয়তো চিরতরেই বন্ধ হয়ে গেছে হেলসের। ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট বা বিগ ব্যাশ কিংবা পিএসএল, ক্রিকেট দুনিয়ার নানা প্রান্তে ২০ ওভারের ক্রিকেটে ২২ গজে দুর্দান্ত পারফরম্যন্স করলেও ইংল্যান্ড দলের দুয়ার ছিল বন্ধ। তিনি নিজেও ছেড়ে দেন হাল।
কিন্তু নাটকীয় পালাবদলে তার ফেরার সুযোগটা এসে যায় অভাবনীয়ভাবে। গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে গলফ খেলতে গিয়ে অদ্ভুতুড়ে চোটে পড়েন বেয়ারস্টো। তার জায়গায় পাকিস্তান সফর ও বিশ্বকাপের দলে ডাক পেয়ে যান হেলস।
পাকিস্তান সফরে ফেরার ম্যাচ রাঙান তিনি ফিফটি করে। যে ম্যাচটিকে তিনি বলেছিলেন ‘দ্বিতীয় অভিষেক’।
সাত ম্যাচের ওই সিরিজের পরে আরও পাঁচ ম্যাচ খেলে অবশ্য তেমন ভালো করতে পারেনি ডানহাতি ব্যাটসম্যান।
ওই সিরিজে চোটের কারণে ছিলেন না বাটলার। হেলসের সঙ্গে ওপেন করেন ফিল সল্ট। বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে বাটলার ফেরায় তার উদ্বোধনী সঙ্গী কে হবেন, তা নিয়ে ছিল আলোচনা। শেষ পর্যন্ত হেলসেই আস্থা রাখে টিম ম্যানেজমেন্ট।
সেই আস্থার প্রতিদান তিনি দেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৫১ বলে ৮৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে। দলের ৮ রানে জয়ের পর জেতেন ম্যাচ সেরার পুরস্কারও। পরের দুই ম্যাচে যদিও দুই অঙ্কে যেতে পারেননি।
বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচ মিলিয়েও হেলস করতে পারেন কেবল ২৬ রান। এরপর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪০ বলে ৫২ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩০ বলে ৪৭ রানের কার্যকর দুটি ইনিংস খেলেন তিনি।
তবে সেরাটা যেন তুলে রেখেছিলেন সেমি-ফাইনালে জন্য। এমন ম্যাচে চাপ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেসবের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল বা হেলসের ব্যাটিংয়ে। ভারতের বোলারদের স্রেফ কচুকাটা করে দুর্দান্ত ইনিংস খেলে বিদায় করে দিলেন প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়নদের। আর ইংল্যান্ডকে তুললেন ফাইনালে।
ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিতে এসে হেলস বললেন, আরেকবার বিশ্বকাপে খেলার কথা কল্পনাতেও ছিল না তার।
"কখনোই ভাবিনি আমি আবার বিশ্বকাপে খেলব। তাই এটি খুবই স্পেশাল। এমন একটি দেশে ইনিংসটি খেললাম, যেখানে আমি খেলতে পছন্দ করি। আজ আমার ক্যারিয়ারের সেরা রাতগুলির একটি।”
আগামী রোববার মেলবোর্নের ফাইনালে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। সেদিনও হেলসের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকবে দল।