শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ২৬ রানের, তিন ছক্কা ও তিন চার মেরে ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে রংপুর রাইডার্সকে স্মরণীয় জয় এনে দিলেন নুরুল হাসান সোহান।
Published : 09 Jan 2025, 05:41 PM
প্রথম বলে ছক্কা, পরের দুই বলে দুটি চার। এরপর ছক্কা, চার, ছক্কা। নুরুল হাসান সোহান যা দেখালেন, এমন কিছু আর কখনও দেখা যায়নি বাংলাদেশের ক্রিকেটে। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ২৬ রান। কাইল মেয়ার্সকে গুঁড়িয়ে ৩০ রান নিয়ে রংপুর রাইডার্সকে অবিস্মরণীয় এক জয় এনে দিলেন অধিনায়ক সোহান।
সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম স্বাক্ষী হলো অসাধারণ এক লড়াইয়ের। কাগজে-কলমে বিপিএলের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই দলের লড়াইয়ে ফরচুন বরিশালের মুঠো থেকে জয় বের করে নিলেন সোহান। তিন উইকেটের জয়ে রংপুর রাইডার্স ধরে রাখল তাদের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। ছয় ম্যাচে ছয় জয়।
সাত ছক্কায় কাইল মেয়ার্সের ২৯ বলে ৬১ রানের অপরাজিত ইনিংসে বরিশাল ২০ ওভারে কোলে ১৯৭ রান। সেই রান তাড়ায় একসময় অনেকটা পিছিয়ে পড়া রংপুরকে লড়াইয়ে ফেরান ইফতিখার আহমেদ ও খুশদিল শাহ। এরপরও জয়ের পথেই ছিল বরিশাল। কিন্তু শেষ ওভারে সোহান জন্ম দিলেন রূপকথার।
বিপিএলে শেষ ওভারে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের কীর্তি এটিই। ম্যাচ জিতে যেন শিরোপা জয়ের উল্লাসে মেতে উঠল রংপুর।
সেরা জুটিতে শুরু
আগের ম্যাচের কৌশল ধরে রেখে নাজমুল হোসেন শান্তকে কিপার-ব্যাটম্যান হিসেবে একাদশে রেখে ওপেনিংয়ে নামা বরিশাল। আসরে তিন ম্যাচ মিলিয়ে ১৩ রান করা ব্যাটসম্যান অবশেষে ফর্মে ফেরার আভাস দেন। তার সঙ্গে তামিম ইকবালের জুটি বরিশালকে গড়ে দেয় বড় রানের ভিত।
দুই বাঁহাতির জন্য দুই অফ স্পিনার দিয়ে আক্রমণ শুরু করে রংপুর। তামিমকে আটকে রেখে শেখ মেহেদি হাসানের মেডেন ওভারে শুরু হয় ম্যাচ। পরের ওভারে ইফতিখার আহমেদের বলে শান্তর বাউন্ডারিতে আসে ম্যাচের প্রথম রান।
তামিমের রান এক পর্যায়ে ছিল ১৪ বলে ৪। শেখ মেহেদিকে দুটি বাউন্ডারি মেরে অস্বস্তির জাল ছেঁড়েন তিনি। এর আগেই এই অফ স্পিনারকে ছক্কায় ওড়ান শান্ত।
নাহিদ রানার প্রথম ওভারে শান্তর ব্যাট থেকে আসে তিনটি বাউন্ডারি। ২২ বলে ১৪ রানে থাকা তামিম দুটি ছক্কা একটি চার মারেন ইফতিখারের টানা তিন বলে।
১০ ওভারে ৮১ রান যোগ করেন দুজন। এবারের বিপিএলে এখনও পর্যন্ত সেরা উদ্বোধনী জুটি এটিই।
ইনিংসের শুরুর দিকেই তামিম পূর্ণ করেন ২০ ওভারের ক্রিকেটে ৮ হাজার রান। আরও অনেক ব্যাটিং মাইলফলকের মতো এখানেও তিনি বাংলাদেশের প্রথম।
কামরুলের জোড়া ছোবল
কামরুল হোসেন রাব্বি আক্রমণে এসে বিদায় করেন দুই ওপেনারকে। ৩০ বলে ৪১ রান করে শান্ত আউট হন কামরুলের প্রথম বলেই। কাইল মেয়ার্স ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলটিই উড়িয়ে মারেন সীমানার বাইরে।
তামিম আউট হওয়ার ঠিক আগে রক্ষা পান দুই দফায়। টানা দুই বলে ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে ক্যাচ হননি তিনি একটুর জন্য। পরের বল তুলে মেরে ধরা পড়েন তিনি মিড অফে (৩৪ বলে ৪০)।
আরেকটি জুটি
ভিত মজবুত ছিল বলে জোড়া ধাক্কাতেও নড়বড়ে হয়নি বরিশাল। মেয়ার্স তার ফর্মের ধারা ধরে রেখেই শট খেলতে থাকেন। তাকে সঙগ দেন তাওহিদ হৃদয়। জুটিতে আসে ৩৫ বলে ৫৯ রান।
হৃদয় আউট হন ১৮ বলে ২৩ করে।
শেষের ঝড়
হৃদয় আউট হওয়ার পর দ্রুত ফেরেন মাহমুদউল্লাহও (২)। তবে মেয়ার্স ও ফাহিম আশরাফ মেটান শেষ সময়ের দাবি।
নাহিদ রানাকে তিন বলের মধ্যে দুটি ছক্কা ও একটি চার মেরে ফাহিম রান আউট হন ৬ বলে ২০ রান করে। একইভাবে কামরুলকে তিন বলের ভেতর দুটি ছক্কা একটি চার মারেন মেয়ার্স, শেষ ওভারে তিনটি ছক্কা মারেন তিনি সাইফ উদ্দিনকে।
শেষ দুই ওভারে ২২ রান করে মোট ৪৪ রান নিয়ে দুইশর কাছে যায় বরিশাল।
শ্রান্ত নাহিদ
নাহিদ রানার বোলিংয়ে ক্লান্তির ছাপ চোখে পড়ছিল আগের ম্যাচেই। ৯ দিনের মধ্যে তার পঞ্চম ম্যাচ ছিল সেটি। সেদিন তিন উইকেট নিলেও বেশ ক্লান্ত লাগছিল তাকে। বেশির ভাগ ডেলিভারির গতি ছিল ১৪০ কিলোমিটারের কম। ম্যাচের পর তার বিশ্রাম নিয়ে আলোচনা হয় অনেক। তবু তাকে এই ম্যাচে আবার মাঠে নামায় রংপুর। ১১ দিনের মধ্যে তার ষষ্ঠ ম্যাচ যেটি।
যথারীতি তার শরীরকে মনে হচ্ছিল অবসন্ন। চেনা গতি ও ধার ছিল উধাও। চার ওভারে ৪৭ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন তিনি। এবারের আসরে তার সবচেয়ে খরুচে বোলিং এটি।
হেলস-ধাক্কা
রান তাড়ায় রংপুরের সবচেয়ে বড় বাজি আর বরিশালের বড় বাধা ছিলেন অ্যালেক্স হেলস। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ইংলিশ ওপেনার আউট হয়ে যান ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই। তানভির ইসলামের বলে তাকে স্টাম্পিং করেন নাজমুল হোসেন শান্ত।
বিপিএলে রান করা, উইকেট নেওয়া, ক্যাচ নেওয়া আর স্টাম্পিং করা, সব অভিজ্ঞতাই হয়ে গেল শান্তর।
জুটির চেষ্টা ও বরিশালের ফেরা
দ্বিতীয় উইকেটে রংপুরকে লড়াইয়ে রাখার চেষ্টা করেন তৌফিক খান তুষার ও সাইফ হাসান। শুরুটা যদিও দুজনের ছিল ধীরগতিতে। ৭ ওভারে রংপুরের রান ছিল ৪১। পরে দুজন চেষ্টা করেন পুষিয়ে দিতে।
তৌফিকের রান ছিল এক পর্যায়ে ১৬ বলে ৯। পরে তানভিরের এক ওভারে দুটি ছক্কা একটি চার মারেন তিনি। ছক্কা মারেন তিনি রিশাদকেও।
পরে রিশাদকেই ফিরতি ক্যাচ দেন তিনি ২৮ বলে ৩৮ করে। সাইফ এর আগেই বিদায় নেন ১৯ বলে ২২ রান করে।
১০ ওভার শেষে রংপুরের রান দাঁড়ায় ৩ উইকেটে ৭২। শেষ ১০ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ১২৬ রানের।
ম্যাচ বদলে দেওয়া জুটি
ইফতিখার আহমেদ ও খুশদিল শাহর সামনে সময় নিয়ে থিতু হওয়ার সুযোগ ছিল না। ওভারপ্রতি রানের চাওয়া বাড়ছিল দ্রুতই। ক্রিজে যাওয়ার পর থেকেই সেই দাবি মেটানোর চেষ্টা করেন দুজন।
এরপরও শেষ ৬ ওভারে রংপুরের প্রয়োজন ছিল ৮৬ রানের। বরিশালের স্ট্রাইক বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদির ওভারে দুই জনের দুটি ছক্কায় আশা জেড়ে ওঠে নতুন করে। পরের ওভারে জাহান্দাদ খানের বলে দুজনে তোলেন ১৬ রান। ফাহিম আশরাফের ওভার থেকে আসে ১৩।
এই জুটি ভাঙে অষ্টাদশ ওভারে। ৩৬ বলে ৪৮ রান করে আউট হন ইফতিখার। জুটি থামে ৫৩ বলে ৯১ রানে।
দুর্দান্ত বোলিংয়ে ওই ওভারে স্রেফ তিন রান দেন আফ্রিদি।
নাটকীয়তা ও রূপকথা
শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৩৯ রানের। জাহান্দাদ খানের প্রথম দুই বলেই ছক্কা মারেন স্বদেমী খুশদিল শাহ। পরের বলেই আরেকটি ছয়ের চেষ্টায় ধরা পড়েন তিনি সীমানায়। ৫ ছক্কায় তার ৪৮ রান আসে ২৪ বল খেলে।
পরের বলেই অন্যরকম উত্তেজনা। শেখ মেহেদি হাসানের ব্যাট থেকে বল ছুটে যায় বোলারের দিকে। নন-স্ট্রাইক প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন সোহান। গতিপথ একটু পরিবর্তন করছিলেন বলেও মনে হয়েছে টিভি রিপ্লেতে। ‘অবস্ট্রাক্টিং দা ফিল্ড’ আউটের আবেদন করে বরিশাল। রিপ্লে দেখে আউট দেন টিভি আম্পায়ার। বল যেহেতু শূন্যে ছিল এবং বোলার ক্যাচ নিতে যাচ্ছিলেন, তাই বাধা দেওয়া ব্যাটসম্যান সোহান আউট হননি, নিয়ম অনুযায়ী আউট হন শেখ মেহেদি।
জাহান্দাদের ওই ওভারে আউট হন মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনও।
এরপর সেই শেষ ওভার। মেয়ার্স মূলত নতুন বলের বোলার। পুরোনো বলে বা ডেথ ওভারে তিনি কার্যকর নন কখনোই। মূল দুই পেসারের ওভার শেষ হয়ে যাওয়ায় তার হাতেই বল তুলে দেওয়া হয়। নির্বিষ শর্ট বলসহ আলগা বোলিংয়ে তিনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন প্রতিপক্ষের দিকে।
তবে বোলিং যেমনই হোক, শেষ ওভারে ২৬ রান নেওয়া তো সহজ নয় কখনোই! সোহান জয় করলেন সেই কঠিনকেই।
ম্যাচ শেষে তার ও দলের উদযাপনও তাই হলো উদ্দাম ও খ্যাপাটে। বরিশালের সঙ্গে আগের লড়াইয়েও জিতেছিল রংপুর।
ম্যাচ শেষ হলেও রয়ে গেল উত্তেজনার রেশ। ম্যাচ শেষে বেশ কিছুক্ষণ পরে বরিশাল অধিনায়ক তামিম ইকবালকে দেখা গেল রংপুরের কোনো একজনের দিকে তেড়ে যেতে। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন রংপুরের ডিরেক্টর শাহিয়ান তানিম।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ফরচুন বরিশাল: ২০ ওভারে ১৯৭/৫ (তামিম ৪০, শান্ত ৪১, মেয়ার্স ৬১*, হৃদয় ২৩, মাহমুদউল্লাহ ২, ফাহিম ২০, জাহান্দাদ ১*; শেখ মেহেদি ৩-০-১৯-১, ইফতিখার ২-০-২৩-০, আকিফ ৪-০-১৬-১, নাহিদ ৪-০-৪৭-০, সাইফ ৪-০-৪২-১, কামরুল ৩-০-৪৭-২)।
রংপুর রাইডার্স: ১৩.২ ওভারে ১১৩/১ (তৌফিক ৩৮, হেলস ১, সাইফ ২২, ইফতিখার ৪৮, খুশদিল ৪৮, সোহান ৩২*, শেখ মেহেদি ০, সাইফ ০, কামরুল ০*; মেয়ার্স ২-০-৩৩-০, তানভির ৪-০-৩৩-১, আফ্রিদি ৪-০-৩০-১, জাহান্দাদ ৪-০-৪৮-২, ফাহিম ৪-০-৩০-১, রিশাদ ২-০-২৬-১)।
ফল: রংপুর রাইডার্স ৩ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: নুরুল হাসান সোহান।