ভয়াল সুন্দর পেস আক্রমণ

ওটিস গিবসনের হাত ধরে পেস সংস্কৃতি বদলের শুরু, অ্যালান ডোনাল্ড যেটিকে নিয়ে যাচ্ছেন নতুন উচ্চতায়। পেস বোলিংয়ে বাংলাদেশের সামনে হাতছানি আরও দারুণ কিছুর। 

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2023, 10:33 AM
Updated : 24 March 2023, 10:33 AM

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। মাঠে তখন কয়েকটি জটলা। এক জায়গায় কোচ ও নির্বাচকদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বলছিলেন সাকিব আল হাসান। কাছেই অধিনায়ক তামিম ইকবাল কথা বলছিলেন কয়েকজনের সঙ্গে। তবে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তখন তিন পেসারকে ঘিরে। হাসান মাহমুদের হাতে সিরিজ জয়ের ট্রফি। পাশেই তাসকিন আহমেদ ও ইবাদত হোসেন। সংবাদকর্মীরা ও অন্যরা তো বটেই, বোর্ড কর্তাদের বেশ কজনকেও দেখা গেল তিন পেসারের সঙ্গে কথা বলতে, ছবি তুলতে, পিঠ চাপড়ে দিতে।  

টুকরো টুকরো ছবিগুলোকে বলা যায় সময়ের প্রতিবিম্ব। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটের সবকটিই পেস বোলিংয়ে নিতে পেরেছে বাংলাদেশ। সিরিজের প্রথম ম্যাচের জয়েও পেসারদের উইকেট ছিল ৬টি, স্পিনারদের ৪টি। পেসারদের তাই আগ্রহের কেন্দ্রে থাকারই কথা। তবে শুধু এই ম্যাচ বা এই সিরিজই নয়, বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের বদলে যাওয়া বাস্তবতার চিত্রই এটি। গত কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে যে উন্নতি, স্পিনের দেশে পেসারদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা, সেটিই এখন প্রায় রূপ নিয়েছে পেস বিপ্লবে। 

হ্যাঁ, অবশ্যই ভারতের মতো পেস বিপ্লব এখনও হয়নি। পাকিস্তানের মতো পেস সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, গভীরতাও ততটা নয়। এই সিরিজের প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড, যাদের বিপক্ষে পারফরম্যান্সকে বিবেচনায় নিতে হবে বৈশ্বিক মানদণ্ডকে বাইরে রেখে। দেশের ভেতরে-বাইরে আরও অনেক কঠিন পরীক্ষা বাকি আছে। তবে যেটুকু হয়েছে, সেটুকুই বা কতজন ভাবতে পেরেছিলেন বছর দুই-আড়াই আগে!

প্রতিপক্ষ যে দলই হোক না কেন, দেশের মাঠে বাংলাদেশ পেস দিয়ে দাপট দেখাবে, পেসাররা ছড়ি ঘোরাবে, বাংলাদেশের পেস আক্রমণ প্রতিপক্ষের জন্য ভীতি ছড়াবে, এমন কিছু অভাবনীয়ই ছিল আগে। প্রথাগত বড় দলগুলির কথা তো বাদই, জিম্বাবুয়ের সঙ্গেও সেভাবে দেখা যায়নি। স্পিন সহায়ক উইকেট বানিয়ে শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানের কাছে বিব্রতকর হারের নজির তো ভোলার নয়। সেই বাংলাদেশ এখন অন্যরকম বটে! 

গতি, সুইং, বাউন্স, আগ্রাসন- বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের সঙ্গে খুব কম সময়ই দেখা গেছে এসব। বিশেষ করে দেশের মাঠে। এখন এসবই নিয়মিত অনুষঙ্গ বাংলাদেশের পেস আক্রমণের। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজেই ইবাদতের বলের গতি ছাড়িয়েছে ঘণ্টায় ১৪৯ কিলোমিটার। ১৪৫ কিলোমিটার গতির আশেপাশে বল করে চলেছেন তিনি নিয়মিতই। তাসকিন তো ১৪০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যান ধারাবাহিকভাবেই। হাসানের গতি এখনও এতটা নয়। তবে তিনিও ১৩৫ কিলোমিটারের আশেপাশে গতিতে করেন বল। 

আইরিশদের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে সুইং বোলিংয়ের যে প্রদর্শনী মেলে ধরলেন তারা সবাই মিলে, বিশেষ করে হাসান নতুন বলে প্রাণের সঞ্চার করলেন, অনেকটা ভেতরে ঢোকা যে ডেলিভারিতে আউট করে দিলেন অভিজ্ঞ পল স্টার্লিংকে, লর্কান টাকারকে যেভাবে অনেকটা দেরিতে সুইং করে ভেতরে ঢোকা দুর্দান্ত ইয়র্কারে পরাস্ত করলেন ইবাদত, সবই ফুটিয়ে তুলছে এই পেসারদের স্কিলের উন্নতি। 

পেসারদের মানসিকতা, মাথা খাটিয়ে বল করা, ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা বের করা ও মনোভাব পড়তে পারার উন্নতিগুলোও দৃশ্যমান। 

একটা সময় পেসারদের নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহসই পেত না বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখার রসদ ছিল না। রসদ সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ ছিল না। দেশের মাঠে তাদেরকে দূরে ঠেলে রাখা হতো অবহেলায়। ছিল না তাদের নিয়ে কোনো পরিকল্পনা বা প্রক্রিয়া। কিন্তু দেশের বাইরে গেলে হুট করেই তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা থাকত আকাশচুম্বি। অনভ্যাসে, চর্চার অভাবে, স্কিলের দুর্বলতা আর মানসিক ঘাটতিতে সেই প্রত্যাশা পূরণে তারা মুখ থুবড়ে পড়তেন বারবার। 

২০১৫ সালে যখন বাংলাদেশের বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক আর ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা, পেস বোলিং নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা বদলের ইঙ্গিত তখন চোখে পড়ে। দেশের মাঠে ওয়ানডেতে চার পেসার নিয়ে খেলার অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিয়ে সফলও হয় দল। তবে সেই ধারা স্থায়ী হয়নি। 

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ওটিস গিবসন বোলিং কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই এখনকার এই বদলের শুরু। পেস বোলিং নিয়ে বাংলাদেশ দলের দৃষ্টিভঙ্গি, এদেশের পেস সংস্কৃতি বদলের ভাবনাকে তিনি একরকম ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। নিজের ভাবনার কথা তিনি বলতেন এবং কাজও করতেন। রাতারাতি কাজ হবে না জেনে তিনি ছোট ছোট প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। উন্নতিও দৃশ্যমান হতে থাকে একসময়। 

দুই বছরের চেষ্টায় বাংলাদেশের পেস বিভাগকে যে জায়গায় রেখে যান তিনি, গত এক বছরে তা আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যান অ্যালান ডোনাল্ড। বোলারদের নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করা, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে তাদের ঘাটতি বা প্রয়োজন অনুভব করা এবং সেই অনুযায়ী পথ বাতলে দেওয়ার কাজটা দারুণভাবে করে চলেছেন তিনি। সঙ্গে চেষ্টা করে যাচ্ছেন পেসারদের পুল বাড়াতে, গভীরতা আরও বাড়াতে। 

এই আলোচনাতেই যেমন, মুস্তাফিজুর রহমানের নামই আসেনি আগে! ওয়ানডেতে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের সব উইকেট পেস বোলিংয়ে নিয়েছে, সেই ম্যাচের একাদশেই নেই মুস্তাফিজ, কিছুদিন আগেও তা অকল্পনীয় ছিল। এখন সবই বাস্তব। 

সৈয়দ খালেদ আহমেদের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। শরিফুল ইসলাম, রেজাউর রহমান রাজার মতো পেসাররা আছেন আশেপাশেই। জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্প বা সিরিজের প্রস্তুতির ফাঁকে কয়েক দফায় ডোনাল্ড উঠতি পেসারদের নিয়ে আলাদা করে কাজ করেছেন ভবিষ্যতের জন্য তৈরি রাখতে। 

কোচদের প্রচেষ্টা আর পেসারদের পরিশ্রম মিলিয়েই আজকের আনন্দদায়ী অবস্থানে বাংলাদেশের পেস আক্রমণ। বাংলাদেশ তাই এখন নিজেদের চ্যালেঞ্জ জানানোর পরিকল্পনাও নিতে পারে অনায়াসে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের সব ম্যাচেই এবার উইকেটে ছিল ঘাসের ছোঁয়া, ছিল বাউন্স। সঙ্গে মেঘলা আকাশ, ভেজা বাতাস আর খানিকটা ঠাণ্ডা মিলিয়ে কন্ডিশন ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধ, আয়ারল্যান্ডের জন্যই অনেকটা সহায়ক। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে ঠিকই আইরিশরা পাত্তা পাননি। 

কিছুটা হলেও নিজেদের মতো কন্ডিশন পেয়ে তা কাজে না লাগাতে পারায় সিরিজ শেষে হতাশা লুকাননি আইরিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু বালবার্নি। বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবালের কণ্ঠে তৃপ্তি ছিল নিজেদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জে জয়ের। সেখানে বড় কৃতিত্ব যে পেসারদের, সিরিজ শেষে তা উচ্ছ্বাস নিয়েই বলেছেন অধিনায়ক। 

“আমি যদি শুধু এটা বলি যে, তারা অসাধারণ বল করেছে, দুর্দান্ত করেছে, স্রেফ এটা বলাটা ভুল হবে। আমার কাছে মনে হয়, মাঠের বাইরে যে পরিমাণ কাজ তারা করেছে, তা এখন মাঠে ফুঠে উঠছে। তাদের এই সফলতা ফ্লুক নয়, তারা নেটে কঠোর পরিশ্রম করে আসছে।” 

“এমন একটা ফাস্ট বোলিং আক্রমণ যখন হাতে থাকবে, তখন অধিনায়কের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। খেলা যেখানেই হোক, দেশের ভেতরে বা বাইরে, যে কোনো জায়গায় আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে ওঠা যায়। পুরো পেস বোলিং ইউনিটকে নিয়েই গর্বিত আমি। শুধু হাসান পাঁচ উইকেট পেয়েছে বলেই নয়, অন্য কেউ তিন-চার উইকেট পেয়েছে বলে নয়, যেভাবে তারা বল করেছে পুরো সিরিজে, তা সত্যিই সন্তুষ্টির ও আনন্দের।” 

তবে তৃপ্তির সবে শুরু। বিশ্বকাপের বছরে আরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে পেসারদের কাছ থেকে, আরও অনেক উন্নতির জায়গা তাদের আছে। ২০১১ সালে দেশের মাঠে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে শচিন টেন্ডুলকার, গৌতম গম্ভির, যুবরাজ সিংদের যেমন অবদান ছিল, তেমনি বড় ভূমিকা ছিল জহির খানের পেস বোলিংয়ের। তাসকিন-হাসানদের সামনেও চ্যালেঞ্জ নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করে আরও বড় পরীক্ষা ও বড় মঞ্চের জন্য নিজেদের তৈরি করার।