“আমরা, আপনার হাজারো সন্তান আপনার সহযোগিতার প্রতীক্ষায় আছি।”
Published : 02 Apr 2024, 09:18 PM
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) ‘ছাত্র রাজনীতিমুক্ত’ রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আর্জি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সরকারপ্রধানের উদ্দেশে লেখা এক খোলা চিঠিতে তারা বলেছেন, “আমাদের অনুরোধ, আপনি দয়া করে আমাদের ক্যাম্পাসে আসুন; ছাত্ররাজনীতিহীন বুয়েট গত কয়েকবছর ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য যে আদর্শ ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে, সেটা আমরা আপনাকে দেখাতে চাই।”
উচ্চ আদালতের আদেশে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরার পথ খোলার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা। সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা এই চিঠি পড়ে শোনান।
চিঠিতে বলা হয়, “আমাদের চাওয়া, বুয়েটকে ঘিরে আমাদের জাতির জনকের যে ভিশন ছিল, তাকে বাস্তবায়ন করা হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন বুয়েটের প্রকৃতি ভিন্ন। তাই তিনি নিজে রাজনীতির আওতা থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাইরে রেখেছিলেন।
“আজ যখন তারই গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বুয়েটের মত বিশেষায়িত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে কোনো মূল্যে রাজনীতির আওতায় আনার কথা বলে, আমরা বিশ্বাস করি তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও সিদ্ধান্তকে অপমান করা হয়।”
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরারকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েটে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি।
এরপর থেকে গত সাড়ে চার বছর প্রকৌশল শিক্ষার এই বিদ্যাপীঠে ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধই ছিল। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ একদল নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
তাদের ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের মধ্যে পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়। তিনিই সেই রাতে নেতাদের জমায়েত ঘটিয়েছিলেন বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ।
এরপর বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরানোর দাবিতে পাল্টা কর্মসূচি দেয় ছাত্রলীগ। রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে তারা অবিলম্বে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চালুর অনুমতি দেওয়ার দাবি জানায়। পরে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে প্রকাশ্যে বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী।
এদিকে ছাত্র রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সোমবার হাই কোর্টে রিট মামলা করেন হল থেকে বহিষ্কৃত ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম। তার আবেদনের শুনানি করে বুয়েটের নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করে হাই কোর্ট।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার সোমবার বলেন, “কোর্ট যেটা বলবে আমাদের সেটা মানতে হবে। কোর্টের আদেশ শিরোধার্য। আদালত অবমাননা আমরা করতে পারব না।”
আর মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, বুয়েট শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ছাত্র রাজনীতি চালুর লক্ষ্য নিয়ে তারা সাংগঠনিক কার্যক্রমে যাবে।
তবে বুয়েট শিক্ষার্থীরা ‘রাজনীতিমুক্ত’ ক্যাম্পাসের দাবিতে তাদের অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা খোলা চিঠিতে বলেন, “আপনার প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, বুয়েটকে নিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে পলিসি গ্রহণ করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন করুন।
“বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখুন, প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও। কারণ সুবিচারের জন্যই আইনের সৃষ্টি।”
নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বুয়েট শিক্ষার্থীরা চিঠিতে বলেন, “বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মত ঘটনা এবং এর ব্যাপ্তি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল’৯৯ এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল’'০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল'১৭ এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি।
“শুধুমাত্র আবরার ফাহাদ ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডই নয়, এর পূর্ববর্তীতেও অসংখ্য শিক্ষার্থীদের র্যাগিং এর দ্বারা কিংবা ছাত্ররাজনৈতিক দাপটের দ্বারা অমানুষিকভাবে নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের বুয়েটের র্যাগিং স্টোরি আর্কাইভে সারি সারি আকারে লিপিবদ্ধ আছে।”
ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ‘সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব’ ছিল দাবি করে চিঠিতে বলা হয়, “বর্তমান বুয়েটে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ থাকায় নিজ নিজ প্রকৌশল ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণামুখী কাজে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি রাজনীতিবিহীন নিরাপদ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য সারা দেশব্যাপী জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে।
“রাজনীতিমুক্ত বুয়েট ক্যাম্পাসের গত ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের এই সকল সফলতা আমাদের জানান দেয়, আমরা আমাদের বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ব্যতীতও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব গঠন এবং বিকাশ প্রয়োজন, তা করতে পারি, স্মার্ট বাংলাদেশ এর লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিরন্তর কাজ করে যেতে পারি।”
বিভিন্ন দিবস পালন নিয়ে ছাত্রলীগ যে অভিযোগ করেছে, তা খণ্ডন করে চিঠিতে বলা হয়, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হবার পর থেকে আজ অবধি প্রতিটি জাতীয় দিবস সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে আসছি।
“আমরা ছাত্ররা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের জাতীয় মূল্যবোধ ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে-প্রাণে ধারণ করি। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কতিপয় ব্যক্তি বা গণমাধ্যমের তৎপরতায় ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েট ক্যাম্পাসকে ‘জাতীয় চেতনার বিরোধী’ মতাদর্শের স্থান হিসেবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিষয়টিতে আমরা অত্যন্ত ব্যথিত।”
ক্যাম্পাসে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার প্রত্যয় জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেক মহল থেকেই বলা হচ্ছে যে, ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ মৌলবাদী বা সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রম বিদ্যমান এবং এর ফলশ্রুতিতেই তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির চর্চার পক্ষে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন।
“আমরা আপনাকে নির্দ্বিধায় বলতে চাই, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যদি যে কোনো মুহূর্তে এসকল নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যে কোনো কার্যকলাপ ক্যাম্পাসে চলমান দেখি, শীঘ্রই তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেব এবং প্রশাসনকে অবহিত করব। এমনকি ভবিষ্যতে যদি ক্যাম্পাসে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সেটার বিরূদ্ধেও আমাদের অবস্থান দৃঢ়।”
প্রধানমন্ত্রীকে পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সকল সময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন, আমরা জানি এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।
“আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমরা প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে দেব খুব শীঘ্রই। শেষ কয়েকবছর এই প্রত্যয় নিয়েই প্রতিটি প্রকৌশল বিভাগে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছি, ইতোমধ্যে যার ফলও পেতে শুরু করেছি। আমাদের এই পথচলা আপনিই নির্বিঘ্ন রাখতে পারেন। সেই আশাতেই এই চিঠি। আমরা, আপনার হাজারো সন্তান আপনার সহযোগিতার প্রতীক্ষায় আছি।”