ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বুধবার বিকেলে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
ঔপনিবেশিক আমলে ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় ভারতের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। আর বঙ্গভঙ্গ রদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ঘটনার আবর্তে ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠা পায় পূর্ববঙ্গের প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সোনালি চক্রবর্তীর মূল্যায়নে, ঢাকার এই ‘মহীরূহ বিদ্যাঙ্গন’ গত ১০০ বছরে বিদ্যার মাধ্যমে জনজীবনকে এবং জনজীবন চর্চার মাধ্যমে বিদ্যাকে সমৃদ্ধ করে সারা বিশ্বের ‘শ্রদ্ধা’ কেড়ে নিয়েছে।
কেবল শিক্ষায়তন নয়, ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাঙালির প্রতিটি গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভাষায়, “ভাষা প্রেমের ভিত্তিতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গঠন এবং রাষ্ট্রগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ অবদান আমার আলোচনার অপেক্ষা করে না।
“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাকেন্দ্রিক স্বাদেশীকতার গৌরব প্রতিষ্ঠায় আপনারা যা করেছেন, তাকে গোটা বিশ্ব কুর্ণিশ জানায়।”
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চশিক্ষা ও জনজীবনের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ও অবস্থান ‘অত্যন্ত গৌরবময়’।
“বাস্তবিকই দক্ষিণ এশিয়ার এই পূর্বপ্রান্তে একটি শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নির্মাণে, দেশবোধ ও জনবোধের সৃজনে বিশ্ববিদ্যাকে সংযুক্ত করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনুপম।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথাও বক্তৃতায় তুলে ধরেন অধ্যাপক সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার নাড়ীর সংযোগ ছিল। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছিন্ন সংযোগ ছিল। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাত্রীভূমি থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পায় তার নিজস্ব চারণভূমি হিসেবে।”
সে সময় ১৩শ স্কুল এবং ২৪টি কলেজ কলকাতা থেকে ঢাকার আওতায় এসেছিল জানিয়ে উপাচার্য বলেন, “বর্ধিত শক্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নবগঠিত জাতির জনজীবনে মহাকায় গুরুত্ব পায়। এরপর যা ঘটেছে, তা ইতিহাস।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নের ইতিহাসও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন অধ্যাপক সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।
“১৯১৭ সালে বড়লাট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর চেমস ফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালেয়কে ঢেলে সাজানোর জন্য একটি কমিশন গঠন করলেন, যারা মাথায় রইলেন বিলেতের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এমি স্যাডলার। এই স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল যত শিগগির সম্ভব ঢাকায় একটি টিচিং ইউনিভার্সিটি স্থাপন করতে হবে।
“গঠনের দিক থেকে এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হবে ইউনিটারি। শতবর্ষ আগে ১৯২১ সালে এভাবেই ঢাকায় গড়ে উঠলো এই মোহনীয় শিক্ষাকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেল কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও অ্যাফিলিয়েশনের ভার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থানান্তরিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক স্বভাবতই ঐতিহাসিক। এই বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্ধী ছিল না।এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
“এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র আছে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একধরনের , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরেক ধরনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। আবাসিক চরিত্রটাই এর একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে জানি ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে, যখন দেশভাগের কারণে আমরা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলাম। ১৯৫২ তে এর ছাত্র ছিলাম। তারপর শিক্ষক হয়েছি এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনের অবিস্মরণীয় স্মৃতি। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মাতৃসম।”
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতারও অংশ নেন আলোচনায়। সঞ্চালনায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন। বিকালে আলোচনা সভার পর সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশন।