২০১৭ সালে স্নাতকের কোনো কোর্সের মানোন্নয়ন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৩.২৫ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
Published : 03 Jul 2023, 08:30 AM
স্নাতক পর্যায়ের কোনো শিক্ষার্থী মানোন্নয়ন পরীক্ষায় যত ভালোই করুণ না কেন, তাকে সর্বোচ্চ ৩.২৫ জিপিএ বা ‘বি প্লাস’ গ্রেড দেওয়ার ‘অন্যায্য’ নিয়মের অবসান চান ছাত্রছাত্রীরা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে। কয়েক বছর পর কেবল স্নাতক পর্যায়ে মানোন্নয়ন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৩.২৫ জিপিএ দেওয়ার নিয়ম বেধে দেয় প্রশাসন।
বিষয়টি নিয়ে ওই সময় তেমন আলোচনা না হলেও ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘অসন্তোষ বাড়ছে’। আর শিক্ষকরাও সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করছেন না।
তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষার্থীদের গণহারে ‘ইমপ্রুভমেন্ট’ দেওয়া ঠেকাতেই এ নিয়ম করা হয়েছিল। ফলে আপাতত এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী বলেছেন, অসুস্থতাসহ নানা কারণে তাদের পরে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নিতে হয়। কিন্তু মানোন্নয়নের সর্বোচ্চ ফলাফল বেঁধে দেওয়ায় তাদের গড় রেজাল্টে বড় প্রভাব পড়ে। আবার অনেক শিক্ষার্থী বিষয়টি না জেনে ‘ইমপ্রুভমেন্ট’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও হিতে বিপরীত হয়।
২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, “পারিবারিক ঝামেলার কারণে একবার কয়েকটা কোর্সে ভালো পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরে ইমপ্রুভে যেই রেজাল্ট হল, তাতে আসলে আমার কোনো লাভ হয়নি। ওই সীমা যদি নির্ধারিত না থাকত, তাহলে আমার রেজাল্ট উঠে যেত।”
বিষয়টি আগে জানতেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “ইমপ্রুভে আমাদের খরচও করতে হয় বেশি, কিন্তু রেজাল্ট কম কেন, বুঝলাম না। একটা সেমিস্টার ধরা খেয়ে গেলাম।”
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ফরম ফিলাপ করার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে প্রতি কোর্সের জন্য ২০০ টাকা ফি দিতে হয়। তবে কোনো শিক্ষার্থী মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিলে তাকে ফরম ফিলাপের জন্য দ্বিগুণ টাকা গুণতে হয়, অর্থাৎ প্রতি কোর্সের ৪০০ টাকা ফি দিতে হচ্ছে।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “আমি একবারই ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষায় বসেছিলাম। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েও দেখি ওই কোর্সের রেজাল্ট ৩.২৫; সত্যিই হতাশাজনক ছিল। পরে জানতে পারলাম ইমপ্রুভমেন্টে এর বেশি মার্কস দেওয়া হয় না।
“এই সিস্টেমটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছে করে তো আর ইমপ্রুভমেন্ট রাখে না। যাতে পরের বছর আরও ভালো ফলাফল করতে পারে, সেজন্যই রাখে। কিন্তু সেখানে যদি এমন নিয়মের বেড়াজাল কিংবা মার্কসের সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে, তাহলে বোধহয় ইমপ্রুভমেন্ট তুলে দেওয়াই ভালো।”
কেন এই সীমা
২০১৭ সালের ৩১ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের ফলাফল নির্ধারিত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে ওই বছরের ৯ জুলাই ৭৪তম সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্তটি অনুমোদন পায়।
ওই নিয়ম অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থী কোনো কোর্সে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে যেই ফলাফলই করুক না কেন, তাকে সর্বোচ্চ ৩.২৫ (বি প্লাস) এর বেশি দেওয়া হবে না। তবে কোনো শিক্ষার্থী এর কম পেলে, তাকে সেই নম্বরই দেওয়া হয়।
অবশ্য স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়; ২০১১ সালের ২২ জুনের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মানোন্নয়নে তাদের যেই ফলাফল আসবে তারা সেটাই পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা মূলত কোনো কোর্সে ৩.০০ পয়েন্টের (বি গ্রেড) কম পেলে পরের বছর মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান।
কোন প্রেক্ষিতে স্নাতক পর্যায়ের মানোন্নয়ন পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারিত করা হয়েছে- জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ কে এম আখতারুজ্জামান বলেন, “অনেকের পরীক্ষা ভালো হয় না। ফলে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পরীক্ষা না দিয়ে চলে যায় এই ভেবে যে, ইমপ্রুভমেন্ট দিয়ে ভালো করবে- এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক সরকার আলী আক্কাস এ নিয়মের কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না।
তিনি বলেন, “এমন হওয়া উচিত না। ইমপ্রুভমেন্ট দিতে কাউকে অ্যালাউ করছি- সেখানে গিয়ে যদি এ প্লাস, এ গ্রেড পায়, আমি সেটা কীভাবে আটকাব? কোথায় আটকাব? এটা সংশোধন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”
এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় কলা অনুষদের ডিন ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক রইছ উদ্দীনের সঙ্গেও।
তিনি বলেন, “কোনো শিক্ষার্থী যদি মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পায়, তাহলে তাকে সেই নম্বর দেওয়া হবে না- সেটা কি যৌক্তিক হল নাকি? সুযোগ দিলাম কিন্তু বলে দিলাম এর বেশি তুমি পাবা না, তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার দরকার নেই তো। এ ধরনের সিস্টেম ন্যায়সঙ্গত না। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর প্রতি এটা অবিচারের সামিল।”
যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে তুলবেন বলে জানালেন কলা অনুষদের ডিন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সদস্য অধ্যাপক আবু তাহের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। তবে এমন নিয়ম ‘ফেয়ার’ বলে তিনি মনে করেন না।
“এটা তো ঠিক না। তারা মনে হয় বিচক্ষণভাবে করলে ভালো হত। যেহেতু আমি ইমপ্রুভমেন্টের সুযোগ দিয়েছি, সেই সুযোগ তো হ্রাস করতে পারি না।”
‘প্রস্তাব এলে পরিবর্তন’
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফাতেমা মেঘলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নানা কারণেই শিক্ষার্থীরা অনেক সময় পরীক্ষা দিতে পারে না। তাদের পরে সুযোগ দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের মধ্যই পড়ে।
“তবে ফলাফল বেধে দেওয়া কখনই ভালো সিদ্ধান্ত নয়। এ সিদ্ধান্তকে ডিসকারেজ করতেছি আমরা। প্রতিবাদ জানানো ছাড়া কিছু করার নাই। এ জায়গায় আমাদের শিক্ষকদের হেল্পফুল ভূমিকা নেওয়া উচিত বলে মনে করি।”
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেনও বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জহুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু এটি সিদ্ধান্ত হিসেবে নেওয়া হয়েছে, তাই এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। তবে কেউ প্রস্তাব তুললে এটি পরিবর্তন করা হতেও পারে।”
একজন শিক্ষার্থী যদি মানোন্নয়ন পরীক্ষায় এ প্লাস পায়. তাহলে তাকে সেটা না দেওয়া ‘অবিচার’ কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা তুমি মনে করতেছো, আমরা মনে করতেছি; রুলস মনে করতেছে না। আমার কথা হল সুযোগই যেহেতু দেওয়া হল, তাহলে যা পেল, তাই দেওয়া হোক। তাই আমরা চাচ্ছি এটি পরিবর্তন হোক। প্রস্তাব কেউ ওঠালে হয়ত হবে।”