‘নকল’ পণ্য: নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা নাকচ করল বিজিএমইএ

আগামী বছর ১ জানুয়ারি থেকে বাংলা বর্ণমালায় ‘বাংলাদেশে তৈরি’ লেখাটি পোশাকের গায়ে সংযুক্ত করার উদ্যোগ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2023, 02:06 PM
Updated : 18 March 2023, 02:06 PM

বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে ‘নকল’ পোশাক ও জুতা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের অভিযোগে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা আসার আশঙ্কা নেই বলে আশা করছে বিজিএমইএ।

শনিবার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারদের এ সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদ সম্মেলনে পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে এমন আশার কথা শোনান।

উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনের সম্মেলন কক্ষে এ প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি জানান, আগামী ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলা বর্ণমালায় ‘বাংলাদেশে তৈরি’ লেখাটি পোশাকের গায়ে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “নকল পণ্য তৈরির অভিযোগ নিয়ে শাস্তির কোনও ইয়ে (সুযোগ) আছে। গত ১২ বছর ধরে ভারতের নাম আসছে, কোনও শাস্তি নেই। এটা আসলে প্রমাণের ব্যাপার আছে।

“তাছাড়া বাংলাদেশ এলডিসি কান্ট্রি হিসেবে এখনও ওয়েভার (ছাড়) পাই। সুতরাং এ মুহূর্তে এরকম কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও সুযোগই নেই।“

এসময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নকল পণ্য সরবরাহ করলে কীভাবে শাস্তির মুখোমুখি করা হয় সেই নিয়ম তুলে ধরে বলেন, “প্রথমে কারও নাম আসে। এরপর ওই প্রতিষ্ঠান নিয়ে রিভিউ করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট করে প্রমাণ করা সম্ভব হলে তখন কিছু করতে পারে।“

তবে নকল পণ্য দিয়ে রপ্তানি বাজারের সুনাম নষ্ট করা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা নকল পণ্য পাঠানোর পক্ষে নই। এ নিয়ে কাজ করছি। বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছি।”

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরে (ইউএসটিআর) বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বাংলাদেশ থেকে নকল পণ্য সরবরাহের অভিযোগ জমা পড়ার পর বিজিএমইএ ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে সদস্য কারখানাগুলোকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করে।

পণ্য তৈরির ক্রয়াদেশ নেওয়ার ক্ষেত্রে এর প্রকৃত ব্র্যান্ড মালিকদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয় রপ্তানিকারকদের। এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা জানায় সংগঠনটি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ, চীনসহ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ থেকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর নামের লোগো হুবহু নকল করে পণ্য তৈরি ও রপ্তানি হচ্ছে বলে সম্প্রতি ইউএসটিআর এর কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে; যারা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ও কার্যকরের দিকটিও দেখভাল করে।

এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের সুবিধা কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সম্প্রতি ইউএসটিআর থেকে এ বিষয়ে একটি নোটিস বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে জমা পড়ে। সরকারের পক্ষে থেকেও বিষয়টি আমলে নিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

এরপর বিজিএমইএ নেতারা বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক ও উদ্যোক্তাদের সংগঠনটি একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান ও তথ্য প্রচার, সক্ষমতা বাড়ানোর কর্মসূচি নেওয়ার কথা জানায়।

শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সংগঠনের সভাপতি ফারুক আমেরিকার অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনকে (এএএফএ) নকল পণ্য ঠেকাতে চলমান লেবেলিং এর পরিবর্তে কিউআর কোডের মাধ্যমে ডিজিটাল লেবেলিংয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা জানান।

Also Read: ‘নকল পণ্য’ নিয়ে সতর্ক করল বিজিএমইএ

Also Read: ‘নকল’ পোশাক রপ্তানি: যুক্তরাষ্ট্রে পর্যালোচনার মুখে বাংলাদেশ

“এটি একদিকে যেমন আমাদের পণ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে কাউন্টারফিট পণ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে,” বলেন তিনি।

২০৩১ পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা পেতে চেষ্টা চলছে

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ইউরোপে এখনকার মতো জিএসপি সুবিধা থাকবে না। এজন্য প্রস্তুতির দরকার আছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধা আরও ছয় বছর চালুর রাখার জন্য চেষ্টা চালানোর কথা জানান।

তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপিপ্লাস নামে তিন বছরের একটা সুবিধা দিয়েছে। আমরা সকল দেশের বাজারে এ সুবিধা ২০৩১ সাল পর্যন্ত চাই। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাতারে অনুষ্ঠিত এলডিসি সম্মেলনেও এ সুযোগ চেয়েছেন।

এজন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউটিও) যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করা হচ্ছে, যা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান তিনি।

রপ্তানি মূল্যে প্রবৃদ্ধি হলেও আদেশ কমেছে

ফারুক হাসান বলেন, বিশ্বে রেকর্ড মূল্যস্ফীতির কারণে কেনাকাটা কমায় রপ্তানি আদেশে এর প্রভাব পড়েছে। তবে এখন এখন আগের তুলনায় কিছুটা বেশি মূল্যের পণ্যের আদেশ মিলছে। যে কারণে সার্বিকভাবে মোট রপ্তানি মূল্যে কিছুটা প্রবৃদ্ধি থাকলেও আদেশ কিছুটা কম রয়েছে।

“কোভিড ১৯ এর ক্ষত সেরে উঠতে না উঠতেই আমরা একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি,” বলেন তিনি।

এমন প্রেক্ষাপটে ক্রেতারাও তাদের ‘সোর্সিং কৌশল’ পরিবর্তন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “একসঙ্গে বড় অর্ডার না দিয়ে ছোট ছোট স্লটে অর্ডার দিচ্ছেন। ফলে কারখানা পর্যায়ে আমাদের উৎপাদন পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হচ্ছে।“

এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ২০২২ সালে আমাদের পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ এর তুলনায় ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩ এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২২ এর একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।“

বেশি প্রবৃদ্ধি নতুন বাজারে

তৈরি পোশাক খাতের নেতা ফারুক জানান, পোশাক রপ্তানির নতুন বাজারগুলোতে রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের বাজার বহুমূখীকরণ খাতে দেওয়া প্রণোদনার ইতিবাচক ফল দিচ্ছে অপ্রচলিত বাজারগুলোতে।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি ছিল ৮৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এটা তখনকার রপ্তানির ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা হয় ৬৩৭ কোটি ডলার; মোট রপ্তানির প্রায় ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ আর বেড়ে ৫৬৯ কোটি ডলার বা মোট রপ্তানির ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ হয়েছে বলে জানান তিনি।

এমন বাজারের মধ্যে ভারতে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৭৫ কোটি ৩৯ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধির হার ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এসময়ে জাপানে ১০৮ কোটি ডলারের রপ্তানির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

মধ্যপ্রাচ্যেও পোশাক রপ্তানি বাড়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, আরব আমিরাতে ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং সৌদি আরবে ৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

নতুন এসব বাজারকে আরও সম্প্রসারণে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর সৌদি আরবে ২৮টি স্পোর্টস ইভেন্ট আছে। এগুলোকে কেন্দ্র করে সরবরাহ আদেশ নেওয়ার কাজ হচ্ছে।

আরও নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগের কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, আগামী মে মাসে বিজিএমইএ অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশ অ্যাপারেল সামিট আয়োজন করবে।

সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সহসভাপতি মো. নাছির উদ্দিন, পরিচালক শোভন ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।