বেসিক ব্যাংকের শনি কাটাতে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেসিক ব্যাংকে ‘সমন্বয়ক’ নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Dec 2022, 11:18 AM
Updated : 21 Dec 2022, 11:18 AM

রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের আর্থিক দশার উন্নয়ন ঘটাতে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দ্রুত ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ জমা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

খেলাপি ঋণ কীভাবে আদায় করা হবে, ঋণে অনিয়মের মাধ্যমে বেরিয়ে যাওয়া অর্থ শনাক্ত করে তা ফেরত আনার কৌশলও থাকতে হবে ওই কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে। বেসিক ব্যাংক পরিকল্পনা জমা দেওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর্থিক কেলেঙ্কারিতে পর্যুদস্ত দশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকা এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে গত মঙ্গলবার বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ওই বৈঠকে বেসিক ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক সূচক ও সার্বিক অবস্থা জানাতে একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা ছিল।

বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেসিক ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বৈঠক করেছেন গভর্নর। আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে একটি অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

গত জুলাইয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর গভর্নর ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর্থিক অবস্থা ‍‘দুর্বল’ যেসব ব্যাংকের, সেগুলোকে ‘বিশেষ তদারকির’ আওতায় আনা হবে। এরপর গত অগাস্টে এরকম দশটি ব্যাংকের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

সেই দশ ব্যাংকের নাম এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ন্যাশনাল, এবি, ওয়ান ব্যাংক, পদ্মা (সাবেক ফার্মার্স) ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে এসব ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করলেন গভর্নর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেসিক ব্যাংকেও সমন্বয়ক নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটিতে একজন পর্যবেক্ষক নিযুক্ত রয়েছেন।

শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালে ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা বেসিক ব্যাংক এখন ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের হার ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এই হার ছিল ৫৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।

ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে এর ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। সে সময় মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। ওই বছর খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছিল ১০৭ কোটি টাকা। আর অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় হয়েছিল ৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। মূলধনে ঘাটতি ছিল এক হাজার ৭১৪ কোটি টাকা।

২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আবদুল হাই বাচ্চু। তখনই ব্যাংকটির দিলকুশা, গুলশান ও শান্তিনগর শাখা থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।

ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়াসহ নিয়ম না মেনে ‍ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে তখনকার পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে ২০১০ সালে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালে রাজধানীর তিনটি থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে কমিশন।

আব্দুল হাই বাচ্চু ব্যাংকটির দায়িত্ব নেওয়ার আগের বছর, অর্থাৎ ২০০৮ সালেও ৫৪ কোটি টাকা নিট লাভ ছিল বেসিক ব্যাংকের।

আব্দুল হাই বাচ্চুর দায়িত্বকালীন সময়কে ‘অস্বস্তিকর’ হিসেবে বর্ণনা করে ব্যাংকের ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০০৯ থেকে জুন, ২০১৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ের অস্বস্তিকর ব্যাংকিং কার্যক্রমের পর থেকে ব্যাংক গত ৭-৮ বছর ধরে আরও বেশি সময় এবং অর্থ ব্যয় করে হারানো ইমেজ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করেছে।”

বাচ্চু দায়িত্বে থাকার সময়েই ২০১৩ সালে ব্যাংকের নিট লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। এরপর থেকে ব্যাংকটি লোকসানই ‍গুনে চলছে। বর্তমান নেতৃত্ব ওই লোকসান কমিয়ে আনতে পরিচালন খরচ কমিয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছে।

গত পাঁচ বছরের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে ৩৫৩ কোটি, ২০১৯ সালে ৩২৬ কোটি, ২০২০ সালে ৩৭১ কোটি এবং ২০২১ সালে ৩৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে বেসিক ব্যাংক।