আমদানি শুল্ক বেশি হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
Published : 10 Dec 2023, 08:18 PM
প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়ে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার পরামর্শ উঠে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সেমিনারে।
রোববার ‘ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ ২০২৩’ এ আয়োজিত সেমিনার ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতি এই পরামর্শ রাখেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদারের বক্তব্যে ছিল একই সুর।
দুই সচিব মনে করেন, আমদানি শুল্ক কমালে রাজস্ব আদায় কমে যাবে না। বরং অটোমেশন করলে তা বাড়বে।
তাদের দৃষ্টিতে শুল্ক কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিলে রপ্তানি বাড়বে। পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের মোট রপ্তানি আয় যে বাংলাদেশের ছয় গুণেরও বেশি, সেটিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ ভ্যাট দেওয়া নয়টি প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননাও দেওয়া হয়।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবন সম্মেলন কক্ষে এই সেমিনারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি যাননি।
বাণিজ্য সচিব বলেন, “ভিয়েতনাম আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে কমিয়ে বৈচিত্র্যময় রপ্তানি খাত তৈরি করে এখন ৩০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করছে। আমাদেরকেও রপ্তানি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বৈচিত্র্যময় রপ্তানি খাত তৈরি করতে হলে অবশ্যই বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। আর বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে অবশ্যই আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনতে হবে।”
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে উন্নত বিশ্বের শুল্ক সুবিধা সর্বোচ্চ ২০২৯ সাল পর্যন্ত পাওয়া যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “তখন আমাদের বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে বিশ্বে আরও বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে। বিশেষ করে ভিয়েতনামসহ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।”
শুল্কহার কমালেও রাজস্ব আহরণ শঙ্কায় পড়বে না বলেও আশাবাদী তপন কান্তি। তিনি বলেন, “১৯৯১ সালে আমাদের রাজস্ব আহরণের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ আসত শুল্ক খাত থেকে। কিন্তু এখন সেটা অনেক কমেছে। এরপরও গত ১৪-১৫ বছরে আমাদের রাজস্ব আহরণ ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।”
আমদানি শুল্ক বেশি হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে মত দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হলেও আসলে ধান চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতে হয়।”
আমদানি শুল্ক কমানোর পক্ষে অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদারও। তিনি বলেন, “এক সময় কাস্টমস খাত থেকে রাজস্বের প্রায় ৭০ শতাংশ আসত। কিন্তু ট্যাক্স কালচার গড়ে উঠলে কাস্টমস শুল্ক থাকবে না। এ জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।”
রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এনবিআরকে আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন অর্থ সচিব। তিনি বলেন, “এনবিআরকে প্রশাসনিক এবং অটোমেশন- দুইভাবেই শক্তিশালী করা হচ্ছে। এর জন্য যত টাকা লাগে আমরা দেব এবং উদারভাবে দেব।”
‘পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীদের আচরণ মেনে নেওয়া যায় না’
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর একদিনে কেজিতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে যাওয়া নিয়েও কথা বলেন বাণিজ্য সচিব।
তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীদের এই আচরণ মেনে নেওয়া যায় না।”
অর্থসচিব জানান, চলতি অর্থবছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি আট শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার বিষয়ে আশাবাদী তিনি।
তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি প্রায় ০.৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। ডিসেম্বর শেষে এই হার ৯ শতাংশের নীচে নেমে আসবে বলে আমরা আশা করছি।
“চলতি অর্থবছর শেষে এই হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আমরা মনে করি।”
আগামী অর্থ বছরের জন্য মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা থাকতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রাজস্ব কম কেন?
সেমিনারে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মু. রহমাতুল মুনিম বলেন, “জিডিপির আনুপাতিক হারে আমাদের রাজস্ব আহরণ এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে কম বলে সমালোচনা করা হয়। রাজস্ব প্রবাহ ভারতের চেয়ে কম কীভাবে হয় তা বিশ্লেষণ করে দেখেছি। ভারতের রাজস্বের সিংহভাগ কয়েকটি শিল্প গ্রুপই যোগান দিচ্ছে। উন্নত প্রায় সব দেশেই এই অবস্থা। বাংলাদেশেও এটা হতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে এখনো সেভাবে শিল্প গ্রুপ গড়ে উঠেনি। তবে দেশে বড় শিল্প গ্রুপ গড়ে তুলতে যত ধরনের সুবিধা দেওয়া দরকার এখন তা দেওয়া হচ্ছে।”
উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর রপ্তানি সুবিধা কমে যাবে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, “তাই এখনই আমাদের ড্রাইভ দিতে হবে। এ জন্য দেরিতে হলেও আমরা অটোমেশন শুরু করেছি।”
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এনবিআর সদস্য (ভ্যাট নীতি) জাকিয়া সুলতানা। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম, এবং এনবিআর সদস্য (আয়কর নীতি) মো. সামস উদ্দিন আহমেদও এতে বক্তব্য রাখেন।
সর্বোচ্চ ভ্যাট দেওয়া নয় প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা
সেমিনারে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিনটি খাতে সর্বোচ্চ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) জমা দেওয়া নয় প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয় এনবিআর।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন অর্থ ও বাণিজ্য সচিব।
উৎপাদন খাতে সম্মাননা পেয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
ব্যবসা খাতে পুরস্কার পেয়েছে ওয়ালটন প্লাজা, ইউনিমার্ট লিমিটেড ও হ্যামকো করপোরেশন লিমিটেড।
সেবা খাতে বিকাশ লিমিটেড, ব্র্যাক আড়ং ও নগদ লিমিটেডকে সম্মানা দেওয়া হয়েছে।