জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, “এখন যে অবস্থায় আছে, কয়েক দিনের মধ্যে তা আরও কমে যাবে এবং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে বাজার।”
Published : 13 Dec 2023, 09:45 PM
ভারতের বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানির পথ সঙ্কুচিত হলেও বিকল্প আরও ১০টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়ে রেখেছে সরকার; এর মধ্যে পাঁচ দেশ থেকে পেঁয়াজ আনছেন ব্যবসায়ীরা।
ফলে ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবরে বাংলাদেশে বাজার অস্থিতিশীল হলেও তিন দিনের ব্যবধানে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পেঁয়াজের দাম ধীরে ধীরে পড়ছে। এখন যে অবস্থায় আছে, কয়েক দিনের মধ্যে তা আরও কমে যাবে এবং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে বাজার।”
গত বৃহস্পতিবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। তবে কোনো দেশের সরকার অনুরোধ করলে সেক্ষেত্রে রপ্তানির সুযোগ রেখেছে দেশটি। ইতোমধ্যে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধের প্রতিবাদে ভারতে কৃষকদের বিক্ষোভের খবর সে দেশের গণমাধ্যমে এসেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, গত অগাস্টে ভারত পেঁয়াজের রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার পর থেকেই ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশ থেকে পণ্যটি আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে অন্তত ১০টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন (আইপি) নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশগুলো হল- চীন, মিশর, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, কাতার, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র।
এর মধ্যে মিশর, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ডস, কাতার ও তুরস্ক থেকে কোনো পেঁয়াজ আসার খবর পাওয়া যায়নি। তবে অন্যান্য দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেঁয়াজ আনা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের মঙ্গলবারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মোট ২০ লাখ ২০ হাজার টন আইপির বিপরীতে সাত লাখ ১০ হাজার ৩৭৯ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।
এর মধ্যে পৌনে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ এসেছে ভারত থেকে। বাকিটা এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে। এর মধ্যে চীন থেকে এক হাজার ২৫৯ টন, পাকিস্তান থেকে এক হাজার ২১৮ টন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৫ টন পেঁয়াজ এসেছে।
তবে পেঁয়াজের চড়া বাজার আবার পড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকরা এখন নতুন করে আমদানি নাও করতে পারেন বলে মনে করছেন রাজধানীর শ্যামবাজারে পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতা ও আমদানিকারক আব্দুল মাজেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পাইকারি বাজারে আজকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা পরশুদিনও ৯০ টাকা ছিল। ফলে এই মুহূর্তে আর নতুন করে আমদানি করতে আগ্রহী হবে না ব্যবসায়ীরা। কারণ বাজার পড়ে গেলে আমদানি করা পেঁয়াজ আবার লোকসানে বিক্রি করতে হবে।”
গত একমাস ধরে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছিল। ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দাম একলাফে দ্বিগুণ বেড়ে ২০০ টাকা থেকে ২৪০ টাকায় পৌঁছে যায়।
তবে এই চড়া দাম দুই দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। এখন আবার ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ১১০ টাকা থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন রকম পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।
দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যটির ওপর আরোপিত শুল্ক বিলোপ করার সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। অবশ্য সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। পণ্যটির ওপর এখনও ৫ শতাংশ আমদানি শুল্কসহ মোট ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। দেশি উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, মৌসুমের এই পর্যায়ে মুড়িকাটা ও আগাম মওসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। আগামী তিন মাসে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও আগাম মওসুমে চাষাবাদ হওয়া পেঁয়াজ থেকে আট লাখ টনের যোগান পাওয়া যাবে। এগুলো শেষ হতে না হতেই চলে আসবে মওসুমের মূল পেঁয়াজ। ফলে সঙ্কট হওয়ার কথা নয়।
মিরপুর-১ নম্বর বাজারের আড়ৎদার কানাই লাল সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজারে বর্তমানে দেশীয় মুড়িকাটা পেঁয়াজই বেশি। ভারতীয় পেঁয়াজ কেজি ১১০ টাকা আর দেশীয় নতুন পেঁয়াজ ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশী পেঁয়াজ গতকালকের চেয়ে আজকে ১০ টাকা কমেছে।”
পেঁয়াজের দাম আর বাড়ার ‘যৌক্তিক কোনো কারণ এখন নেই’ বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, “এগুলো শেষ হতে না হতেই চৈত্র মাসে হালি পেঁয়াজ চলে আসবে। এর মধ্যে মিয়ানমার, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশ থেকে আনা কিছু পেঁয়াজও বাজারে থেকে যাবে।
রাজধানী শহরের মত একই পরিস্থিতি রয়েছে পাশের জেলা মানিকগঞ্জে। এই জেলা থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ করে ঢাকায় এনে বিক্রি করেন মোহাম্মদ আলী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, তার জেলায় সোমবারের তুলনায় মঙ্গলবার পেঁয়াজের দাম প্রতিমণে ৫০০ টাকা কমে গেছে।
“গতকাল পেঁয়াজের মণ ছিল চার হাজার টাকা, আজকে বিক্রি হয়েছে ৩৫০০ টাকা। বাজারে প্রচুর পরিমাণে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসছে। ফলে দাম ধীরে ধীরে কমে যাবে বলে মনে হচ্ছে।”
বুধবার রাজধানীর মিরপুর এলাকায় বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিকেজি সর্বনিম্ন ৯০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। এর মধ্যে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০ টাকায়।
মিরপুর বড়বাগ কাচাবাজারের মীম অ্যান্ড প্রান্তিকা নামের এক মুদি দোকানের কর্মী জানান, প্রতিকেজি ২০০ টাকা করে কেনা পেঁয়াজ এখন তারা ১৬০ টাকা করে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে ক্রেতারা এই পেঁয়াজ না নিয়ে ৯০ টাকা দামের নতুন পেঁয়াজের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এছাড়া কিছু বড় আকারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১২০ টাকায়।
‘দুষ্টু মনোভাব’
বুধবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক অংশীজন সভায় সম্প্রতি বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামের অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে নিজেদের কর্মকাণ্ডগুলো তুলে ধরেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান।
পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “ভারত ৭ ডিসেম্বর পেঁয়াজ বন্ধ করার দিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাম বাড়ল। সেটা বাজার সিন্ডিকেট করে নাই। শত শত ব্যবসায়ী এই কাজটি করেছে। যারা এটা করছে, তাদের বিরুদ্ধেই আমাদের যুদ্ধ।
“বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। হাত বদলের ফলে প্রতিটা জায়গায় তারা অধিক দাম বাড়াচ্ছে। প্রতিকেজি ৯০ টাকার পেঁয়াজ তারা ২০০ টাকার বেশি দামে নিয়ে গেল। সেখানেই শেষ নয়, তারা পেঁয়াজগুলো গোডাউনে নিয়ে গিয়ে বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল।”
পরিস্থিতি সামাল দিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা তুলে ধরে সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা ৩৫০টির মত অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ টাকার মত জরিমানা করেছি। পেঁয়াজ উদ্ধার করে আমরা যেটা ১১০ টাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিলাম সেগুলো নিয়ে তারা আবার চড়া দামে বিক্রি করল।”
সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “৮ ডিসেম্বর সীমান্তের ওপারে ২২০টি পেঁয়াজের ট্রাক আটকা পড়ে ছিল। সেগুলো আমরা দেশে আনার ব্যবস্থা করলাম। সরকার যোগাযোগ করলে সেটেল না হওয়া এলসির ৫৪ হাজার টন পেঁয়াজ ভারত থেকে দেশে আনার সুযোগ রয়েছে।
“রোববার সোনামসজিদ থেকে ২৮ ট্রাক পেঁয়াজ ঢুকেছে। সেজন্য ব্যবসায়ীরা আমাকে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু তারা পেঁয়াজটা বিক্রি করেছে ১৪০ টাকায়, যেই পেঁয়াজটা ৯০ টাকায় বিক্রি করতে পারত। এই হল মানসিকতা। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অসংলগ্নতাগুলো গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।”