বিশ্ববাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সম্ভাব্য সব কৌশল প্রয়োগে সরকারের ‘জোরালো’ পদক্ষেপের দাবি উঠেছে জাতীয় একটি কর্মশালা থেকে।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে নবায়নযোগ্য ‘জ্বালানি অর্থায়ন বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন বৈঠক এবং কর্মশালা’য় সব আলোচকই নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন।
ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশন এর অর্থায়নে চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ কর্মশালার আয়োজন করে।
সরকার নবায়নযোগ্য উৎস থেকে যে হারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছিল তা অনেকাংশেই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ ‘ক্লিন এনার্জি’ থেকে আসার কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। ২৬ হাজার মেটাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে ‘ক্লিন এনার্জি’ আছে ৭০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে সৌর বিদ্যুতের পরিমাণ ১০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি।
কর্মশালার মূল উপস্থাপনায় চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসাইন খান বলেন, সরকারের ২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ আসতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রায় সবকটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে; কখনও অর্থায়নের কারণে, কখন পর্যাপ্ত জমির প্রাপ্যতার কারণে। নীতি সহায়তার অভাবে উদ্যোক্তারাও সেভাবে এগিয়ে আসেননি।
চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ হিসাব করে দেখেছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ৬ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অর্থায়ন পেয়েছে।
আন্তর্জতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে গ্লোবাল এনভাইরনমেন্ট ফেসিলিটিস, গ্লোবাল ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যালায়েন্স, জিসিএফ-পিপিএফ, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, গ্লোবাল এনার্জি ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি, ক্লিন টেকনলজি ফান্ডসহ আরও কয়েকটি উৎস থেকে ৩৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের বলে কর্মশালায় জানানো হয়।
মূল প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বাংলাদেশে ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৪ একর অকৃষি খাস জমি রয়েছে যেখান থেকে ২৮ হাজার ১০৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলের খাস জমিতেই ২২ হাজার ৩১৯ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আবার অকৃষি খাস জমির ৫ শতাংশ কাজে লাগাতে পারলে সৌর বিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য খাত থেকে ২৮ হাজার মেগাওয়াট পাওয়া সম্ভব।
বর্তমানে সৌর বিদ্যুতের চার ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে ১১ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রয়েছে উল্লেখ করে এসব শুল্ক কমিয়ে আনা বা পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি আসে সেমিনারে একাধিক বক্তার কাছ থেকে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও ক্লাইমেট পার্লামেন্টের সদস্য আহসান আদেলুর রহমান বলেন, আমাদেরকে অতি দ্রুত নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দিকে যেতে হবে এটা এখন সবাই একমত। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দিকে গেলে জ্বালানি নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় হবে। আগে সৌর বিদ্যুৎ অনেক ব্যয়বহুল হলেও এখন প্রযুক্তির খরচ কমে এসেছে। ভ্যাটের যেই বাধাটা আছে তা দূর করতে সংসদে কথা বলব।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির উপদেষ্টা ওয়াসেকা আয়েশা খান বলেন, ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে আমাদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। নীতিমালা পরিবর্তন করতে হলে সেটাও সম্ভব। বিদ্যুৎ জ্বালানিতে সাশ্রয়ী হওয়া ও নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও বাড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ২০০৯ সালের শেষ দিকে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ সৌর বিদ্যুতের বাধ্যবাধকতা করা হয়েছিল। পরে দেখা গেল বাড়িওয়ালারা সোলার প্যানেল ভাড়া করে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে পরে তা আবার ফেরত দিচ্ছে। এর মানে হচ্ছে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে সবার সদিচ্ছা থাকতে হবে। এরপর নেট মিটারিং পদ্ধতি চালু করলেও সেটা নানা কারণে খুব ভালো বাস্তবায়ন হয়নি।
“এখন আমরা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ নীতিমালা পরিবর্তন করছি। প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন যেন মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ ক্লিন এনার্জি থেকে আসে। টাকা কোনো সমস্যা নয়। উন্নয়ন সহযোগীরা এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। সৌর বিদ্যুতের প্রযুক্তির দামও কমে এসেছে। সুতরাং সোলার আমাদের পরবর্তী অগ্রাধিকার,” বলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে গত এক দশকের প্রচেষ্টার পরও ক্লিন এনার্জি এখন ৩ শতাংশের শেয়ারে রয়ে গেছে। এটা কোনোভাবেই সুখকর নয়। ইউক্রেইন যুদ্ধের ধাক্কায় পুরো ইউরোপ এখন উইন্ড পাওয়ার বা বায়ু বিদ্যুতের দিকে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সেটা সম্ভব নয় বিধায় ‘এগ্রেসিভলি’ নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনে বড় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বাধ্য করার নিয়ম চালুর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে গ্রামে শাখা খুলতে বাধ্য করেছে। পিডিবি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কিছু সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাধ্যবাধকতা করে দিতে পারে। বাংকগুলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে বিনিয়োগে অনীহা দেখাচ্ছে বিভিন্ন কারণে। নীতিমালা পরিবর্তন করে তাদেরকেও একটা নির্দিষ্ট হারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
“একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সৌর বিদ্যুৎ বড় ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারে। বাসাবাড়ি, শিল্পকারখানা, সরকারি অফিস সবাই এগিয়ে আসলে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।”
আহসান মনসুর বলেন, নিজস্ব উপায়ে সৌর বিদ্যুৎকে টেকসই করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে সেচ কৃষির কাজটি সোলারের মাধ্যমে করা যায়। তাহলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির অনিশ্চয়তা হলেও তা কৃষির ওপর প্রভাব ফেলবে না। আর শহরাঞ্চলের জন্য করতে হবে নেট মিটারিং পদ্ধতি। এখন যেসব বিদ্যুৎচালিত বাহনগুলো গ্রামে চলে সেগুলো পুরোপুরো সৌর বিদ্যুতে নিয়ে গেলে চার্জ বাবদ মাসে সাশ্রয় হবে তিন হাজার থেকে ৩৫০০ টাকা।
সোলার ইলেকট্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবর রহমান সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে বলেন, এখানে এখনও সরকারি দপ্তরগুলোর ভবনের ছাদ সৌর প্যানেলের আওতায় আসেনি। এসব ছাদ থেকে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। এখনই উদ্যোগ নিলে আগামী এক বছরের মধ্যে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
নিজের গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে এক মিটার উচ্চতার যেকোনো সবজির ক্ষেতে ১৫ মিটার উচ্চতায় সৌর প্যানেল বসালে ফলনের ক্ষতি হওয়া ছাড়াই বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। একইভাবে জলাশয়ে কীভাবে মাছের উৎপাদন ব্যাহত না করে ভাসমান প্যানেল বসানো যায় সেই মডেলও আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি।
২০ বছর আগে শুরু হওয়া সোলার হোম সিস্টেমে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৬৫ ওয়াটের একটি প্যানেল বসাতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা তখন খরচ হয়ে গেছে। ২০ বছরে তিনবার ব্যাটারি বদল করতে হয়েছে যা মোট খরচের অন্তত ৪৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেখা গেছে ২০ বছর আয়ুষ্কাল হিসেবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে গেছে ১১৪ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে।
“এত বৈষম্য করে তো সোলারকে সবার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া যাবে না।“
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ও এসডিজি বিষয়ক সাবেক প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সোলার যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক কমানো এখন সময়ের দাবি। আগামী ১৫ বছরের জন্য এই শুল্ক কমাতে হবে। সময় ধরে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। আগামীতে কোনো ছাদ ফাঁকা রাখা যাবে না।
বেসরকারি খাতকে সৌর বিদ্যুতের দর কত দিলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে সেটিও জানতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক পরিচালক ও গ্রিনটেক এর উপদেষ্টা মোরশেদ মিল্লাত বলেন, এ খাতে অর্থায়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে তথ্যের ঘাটতি। এপর্যন্ত ১৯টি সার্কুলার জারি করা হয়েছে গ্রিন ফিন্যান্সিং নিয়ে। কিন্তু আমার মনে হয় সেগুলো সবাই পড়ে দেখেনি। এধরনের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ছয় মাস থেকে দেড় বছরের গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো রক্ষণশীল ভূমিকায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নীতিমালার একটি ধারা পরিবর্তন করেই অর্থায়ন বাড়ানো যায়।
সৌর বিদ্যুতের উচ্চ আমদানি শুল্কে পরিবর্তন আনার পরামর্শও দেন সাবেক এ ব্যাংকার।
টোটাল এনার্জির প্রতিনিধি ইমরানুর রহমান বলেন, উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারী ও পিডিবির মধ্যে অনেক শর্তের বেড়াজাল সৃষ্টি হয়। ফলে একটি প্রকল্প হাতে নিলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। এসব কারণে বিদেশি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতে চান না।
কর্মশালার সুপারিশ
>> নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য আগামী ১০ বছর কর রেয়াত সুবিধাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া।
>> প্রতিযোগিতা বাড়াতে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন বাতিল করা।
>> বিনিয়োগকারীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অকৃষজ খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া।
>> দীর্ঘ মেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ও তহবিল গঠন করা।
>> নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে টেকসই বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন।
>> বিদ্যুতের ট্যারিফের ক্ষেত্রে যেন কোনো বৈষম্য না হয় সেই নিশ্চিয়তা দেওয়া।