Published : 14 Jul 2023, 01:00 AM
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে গত অর্থবছরে রপ্তানি কমেছে, অথচ এই পণ্য থেকে রপ্তানি আয় বেড়েছে। নতুন কয়েকটি বাজারে ভর করেই দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক খাত থেকে আয় আগের বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে।
এর মধ্যে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মতো অপ্রচলিত বাজারে এই প্রথম ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। জাপানে রপ্তানি গত বছর ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল, এবার তা দেড় বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
কোভিড মহামারীর খাঁড়ার পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে রাশিয়ার হামলা শুরু হলে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি নানামুখী বাধার মুখে পড়ে। নতুন বাজার হিসাবে বিবেচিত রাশিয়াও পড়ে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে।
এই পরিস্থিতিতে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া ও টানা কয়েকমাস প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তখন প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি যেখানে সাধারণত রপ্তানি তেমন হয় না, সেই দেশগুলোর দিকে নজর বাড়াতে থাকেন পোশাক শিল্প মালিকরা।
বছর শেষে পরিসংখ্যান দেখে নতুন বাজার নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে অপ্রচলিত বাজার বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
তবে এজন্য পণ্যের বহুমুখীকরণ ও ম্যান মেইড পোশাকের প্রসারে মনোযোগ দেওয়ার উপর জোর দিচ্ছেন তারা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সামগ্রিক রপ্তানির যে পরিসংখ্যান ইপিবি প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।
সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অঙ্ক ছিল ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
প্রচলিত বাজারে অস্থিরতা
দীর্ঘদিন ধরে যে সব দেশে নিয়মিত রপ্তানি হয়ে আসছে, সেগুলোকে প্রচলিত, আর যেসব দেশে নামমাত্র পরিমাণ রপ্তানি হয়, সেগুলোকে অপ্রচলিত বাজার হিসাবে বিবেচনা করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি।
প্রচলিত বাজারের মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সামগ্রিক পোশাক রপ্তানির ১৮ থেকে ২০ শতাংশ যায় এই দেশটিতে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, তা গত অর্থবছরে ৮ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
একইভাবে ইউরোপের বড় বাজার জার্মানিতে রপ্তানি ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং পোল্যান্ডে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ কমেছে।
জার্মানিতে ৬৬৮ কোটি ১১ লাখ ডলার এবং পোল্যান্ডে ১৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
বড় দুটি বাজারে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হলেও ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে পোশাক রপ্তানি ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে ২৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
জার্মানি ও পোল্যান্ডে কমলেও স্পেনে ১৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, ইতালিতে ৪২ দশমিক ১৪ শতাংশ, ডেনমার্কে ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং নেদারল্যান্ডসে ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে পোশাক রপ্তানিতে।
স্পেনে ৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্সে ২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, ইতালিতে ২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার, ডেনমার্কে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার এবং নেদারল্যান্ডসে ১ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
একই সময়ে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়ে ৫ দশমিক ২ বিলিয়নে এবং কানাডার বাজারে রপ্তানি ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
বড় সাফল্য ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপানে
গত অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত প্রথমবারের মতো এক বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানির মাইলফলক অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়ায় ৪২ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃ্দ্ধির ফলে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৫ কোটি ৭৩ লাখ ডলার; ভারতে ৪১ শতাংশ ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফলে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০১ কোটি ২৮ লাখ ডলার।
এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়ে যাওয়া জাপানে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রপ্তানিতে ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দেশটিতে আগের বছরে যেখানে ১০৯ কোটি ৮৬ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, সেখানে এবছর রপ্তানি হয়েছে ১৫৯ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের পণ্য।
অপ্রচলিত দেশের মধ্যে এবার দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৫৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলার, চীনে ৩০ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়ে ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেড়ে ২৯ কোটি ২৩ ডলার, মেক্সিকোয় ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়ে ৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার, মালয়েশিয়ায় ৪২ শতাংশ বেড়ে ২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার, সৌদি আরবে ২৯ শতাংশ বেড়ে ১৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, তুরস্কে ৫০ শতাংশ বেড়ে ২৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
সম্ভাবনা, তবে …
দীর্ঘদিন ধরেই সরকার রপ্তানি পণ্যের নতুন বাজার খুঁজতে ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়ে আসছিল।
তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের আশা করছেন বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তারা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য রপ্তানি আয়ে প্রায় ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করে ৬২ বিলিয়ন ডলার ঠিক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর সেক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে হবে পোশাক খাতকে।
রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও পোশাক খাত ভালো করেছে। সামগ্রিক রপ্তানি প্রায় ৭ শতাংশ হলেও পোশাক খাত ১০ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি রয়েছে।
“ম্যান মেইড ফাইবারের দিকে পোশাক খাত এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে। সেদিকে আমরা একটু এফোর্ট দিলে আরও ভালো করতে পারব।”
পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনের কিছু সুবিধা পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “চীন থেকে পোশাক শিল্প সরে যাচ্ছে। ভিয়েতনামে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কথা হচ্ছে, আমরা এসব সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত কিনা বা কতটুকু প্রস্তুত?”
ওই অনুষ্ঠানে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানসহ উন্নত দেশগুলোতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেই দেশগুলোতে পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমে গেছে। বৈশ্বিক পূর্বাভাসগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে নভেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মূল্যস্ফীতি কমে আসবে এবং তখন বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের চাহিদা এসব বাজারে আবার বাড়বে।
“অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো নতুন দেশগুলোতে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো হয়েছে। আমরা নতুন বাজার বা রপ্তানি গন্তব্যের বহুমুখীকরণ পরিকল্পনায় সফল হচ্ছি।”
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পোশাক রপ্তানিতে নতুন বাজারগুলোতে আমরা এবার বেশ ভালো করেছি। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির বাজারে যেভাবে রপ্তানি কমে গেছে, সেই ধাক্কা সামাল দেওয়া গেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তাদের আমদানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি ৩১ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ভিয়েতনাম ২৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়েছে। সেই তালিকায় বাংলাদেশ ১৭ শতাংশ নেতিবাচক। এটা হয়েছে তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে।”
সরকারের যে আশা, তা পূরণ করতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ চাইছেন ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের নতুন নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি চীন ভিয়েতনাম থেকে নতুন নতুন বিনিয়োগ এই দেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছে।
“গ্যাস বিদ্যুতের সংকটের কারণে গত অর্থবছর পোশাক শিল্প বেশ চ্যালেঞ্জিং সময় পার করেছে। সেজন্য গ্যাস- বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক করার মাধ্যমে সঠিক প্রস্তুতি নিতে হবে।”