ব্যাংকে টাকা রাখা বা সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে এখন সরকারি এই বিলে বিনিয়োগ করা লাভজনক। এখানে বিনিয়োগের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।
Published : 31 Oct 2024, 09:13 AM
ট্রেজারি বিলের সুদের হার আরও বেড়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত এমনকি সঞ্চয়পত্রের সুদহারকে ছাড়িয়ে গেছে।
গত ২১ অক্টোবর ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যেটি সেপ্টেম্বরের তুলনায় ০ দশমিক ১৬ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।
১৮২ দিনের বিলের সুদের হার আরও একটু বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
একই দিনে ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ, সেপ্টেম্বরের তুলনায় এটি ০ দশমিক ০৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালের একই সময়ে এসব ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে।
ভালো ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমানতে ৮ শতাংশ থেকে শুরু করে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ সুদ দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে নানা কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার।
সরকার সাধারণত ৯১ দিন, ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিল এবং ২ বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ধার নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ২১ অক্টোবর বিলের মাধ্যমে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা নিলামের জন্য তোলা হয়েছিল। বেশি সুদ চাওয়ার কারণে এদিন সব বিল বিক্রি করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
ট্রেজারি বিল কী
ট্রেজারি বিল হল একটি স্বল্পমেয়াদি আর্থিক ঋণপত্র যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার কর্তৃক জারি করা হয়।
সাধারণত এই বিলগুলো এক বছর বা এর কম মেয়াদি হয়ে থাকে। এটি একটি নিরাপদ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবেও পরিচিত। কারণ এর উপর সুদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে এবং সরকারের পক্ষে ইস্যু করা হয়।
ট্রেজারি বিল ও বন্ড সাধারণত যে কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি কিনতে পারেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত তারল্য ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে।
২০২৩ সালে বীমা কোম্পানি মেটলাইফ বাংলাদেশ তাদের বিনিয়োগের ১৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা রেখেছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে। আগের বছরের তুলনায় তারা বিনিয়োগ বাড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা।
২০২৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের মুনাফা ৪১ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনেও অবদান রেখেছে এই বিনিয়োগ।
আরও কয়েকটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের কারণে রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা হয়েছে তাদের।
ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। তাই যত খুশি তত বিনিয়োগ করা যায়।
কোথায় পাওয়া যায়
ব্যাংক, পুঁজিবাজার, ব্রোকারেজ হাউস ও বিনিয়োগ ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার সুযোগ রয়েছে। তবে সব ব্যাংক এই সেবা দেয় না। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োজিত ডিলার ব্যাংকই এই সেবা দিয়ে থাকে। সেসব ব্যাংকের সহযোগী ব্যাংক থেকেও কেনার সুযোগ আছে।
পুঁজিবাজার থেকেও এই বিল-বন্ড কেনার সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও হিসাব থাকতে হবে।
মূলত ট্রেজারি ব্যাংকের মাধ্যমে কিনতে বিপি হিসাব খুলতে হবে। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে শুধু বন্ড কেনা যায়। সেখানে ১০০ টাকার বন্ডও কেনা যায়। তবে ব্যাংক থেকে বন্ড কিনতে হলে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই কারণে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদের হার বাড়ছে। প্রথমত গত ২২ অক্টোবর পলিসি রেট বা রেপো রেট যে বাড়বে তা আগেই বলা হয়েছিল। সে কারণ ২১ তারিখে সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ডের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে যে টাকা ধার করেছে, সেটার সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
২২ অক্টোবর থেকে পলিসি রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
অন্য আরেকটি বিষয় হল ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বেশ ভালো হওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এ খাতে বিনিয়োগ করছে।
নিরাপদ বিনিয়োগ
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকগুলোও বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা হিসাবে বিল-বন্ড কিনছে। কারণ, টাকাটা সরকার নিলে সময় মতো ফেরত পাওয়া যাবে। সুদের হারও বেশ ভালো।”
বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। তাই গত দেড় বছর ধরেই ব্যাংকগুলো ব্যক্তিখাতের চাইতে ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করাকে নির্ভরযোগ্য মনে করেছে।”
একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দুই মাসে বেশ কয়েকবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। চলতি অক্টোবরে এটি আরও বাড়তে পারে বলে আমরা জানতে পেরেছিলাম।
“রেপো রেট বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমাদের টাকা ধার করার খরচ বেড়ে যায়। ফলে ট্রেজারি বিল কেনার ক্ষেত্রেও আমাদের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালে বা বাড়ানোর সম্ভাবনার কথা বললে সব ধরনের ইন্টারেস্ট রেটই বাড়ে, এটাই স্বাভাবিক।”