দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে সরকারের সায় না পাওয়ার তিন দিনের মাথায় বাজারে সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত চাহিদায় টান পড়েছে; মিলছে না খোলা সয়াবিন তেলও। সংকটের সুযোগে বাড়ানো হয়েছে দামও।
Published : 05 Mar 2022, 01:05 AM
আর বাড়তি মুনাফার জন্য বোতলজাত তেল খুলে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
রাজধানীর কিছু বড় দোকান এবং সুপার শপ ঘুরে পাঁচ লিটারের বোতলজাত তেলও দেখা গেছে খুবই সামান্য পরিমাণ। ছোট বাজার কিংবা অলিগলির দোকানে সেটাও নেই।
কিছু দোকানে ৫০০ গ্রাম থেকে দুই লিটারের বোতলজাত তেল পাওয়া গেলেও দাম বেশি। গত কয়েক দিন ধরে এমন সংকট দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে প্রতি লিটার বোতলজাত তেল ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। আর ৫০০ গ্রামের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। কোথাও কোথাও বোতল থেকে মূল্যও মুছে ফেলা হয়েছে।
তাদের অভিযোগ, আসলে সেসব খোলা তেল নয়, বোতল থেকে খুলে খোলা তেল হিসেবে কেউ কেউ বিক্রি করছেন; যা লিটারে বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়।
শুক্রবার রাজধানীর রামপুরা, হাজীপাড়া বউবাজার, মালিবাগ ও শান্তিনগর বাজারের বেশ কয়েকজন বিক্রেতা জানান, খোলা তেলের দাম বেশি হওয়ায় ‘বোতলের তেল ভেঙে’ কোনো কোনো দোকানি খোলা তেল হিসেবে মেপে বিক্রি করছেন।
ক্রেতারা জানান, খুচরা বাজারসহ অলিগলির একাধিক দোকান ঘুরেও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককে তেল ছাড়া অন্যান্য বাজার-সদাই নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।
চৌধুরী পাড়ার বাসিন্দা মতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দেখলাম বহু দোকানে তেল নেই। এরা বলছে, কোম্পানি নাকি সাপ্লাই বন্ধ রেখেছে।
“পাঁচ লিটারের কোনো তেল পাওয়া গেল না। ১৮০ টাকা দরে দুই লিটারের দুটি বোতল কিনেছি।”
কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ
কোম্পানি ও ডিলাররা বাজারে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তেলের ‘কৃত্রিম সংকট’ তৈরি করেছে বলে অভিযোগ খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের।
রামপুরা হাজীপাড়ার আদিবা স্টোরের মালিক আব্বাস উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক দিন ধরে কোনো কোম্পানির ডিলারই তেল দিচ্ছে না, গ্রাহক এসে ফেরত যাচ্ছে।
“আমার যেহেতু মুদির দোকান, নানা জিনিস বিক্রি করি, কোনো একটা জিনিস যদি কেউ না পায় তাহলে কাস্টমার নষ্ট হয়। এজন্য গতকাল রাজারবাগের এক পাইকারি দোকান থেকে পাঁচ লিটারের কয়েক বোতল সয়াবিন তেল এনেছি।”
এসব বোতলের গায়ের মূল্য মুছে ফেলা হয়েছে জানিয়ে খুচরা এই ব্যবসায়ী বলেন, “পাঁচ লিটার আমাদের কেনা পড়েছে ৮১৫ টাকা, বিক্রি করছি ৮৩০ টাকা।”
এর ২০ দিনের মাথায় গত সপ্তাহে আবার সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা করে বাড়াতে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব দিলেও তাতে সায় দেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
শুক্রবার সকালে রামপুরা নতুন রাস্তা এলাকায় সুপার শপ স্বপ্নে গিয়ে দেখা যায়, তীর ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের পাঁচটি সয়াবিন তেলের বোতল রাখা আছে।
অন্য সয়াবিন তেল আছে কি না জানতে চাইলে বিক্রমকর্মী বলেন, “এই পাঁচটি বোতলই আছে। আগে ভ্যাট যুক্ত করা হতো না, এখন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে গতকাল থেকে ৪০ টাকা ভ্যাট যুক্ত করে ৮৩৫ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।”
মালিবাগ বাজারের মা স্টোরের মো. মাহিন জানান, তার দোকানে গত দুই দিন কোনো তেলই ছিল না। যে ডিলাররা আগে অর্ডার নিয়ে যেত তাদেরকে এখন ফোন করেও পাওয়া যায় না।
“এক জনের মাধ্যমে আজকে কয়েক লিটার বোতলজাত তেল সংগ্রহ করলাম। কিছু কাস্টমার আছেন অনেক ধরনের সদাই নেবেন, তারা এসে জিগায় তেল আছে কি না, না থাকলে চলে যান।”
হাজীপাড়া বউবাজারের মিন্টু স্টোরের মালিক মিন্টু মিয়া বলেন, “আমার দোকানে ৫০০ গ্রামের কয়েকটি বোতল আছে। এগুলো ৯০ টাকা করে বিক্রি করছি। কেউ কেউ পাঁচ লিটার বোতল খুলে বিক্রি করছে। এতে দাম বেশি পাওয়া যায়।”
শান্তিনগর বাজারের মুদি দোকানি আবুল ফজল বলেন, “সরকারের লোকেরা এসে আমাদের মতো ছোট-খাট খুচরা দোকানে অভিযান করে, জরিমানা করে। আমরা কী তেল মজুদ করি?
“যারা তেল আমদানি-রপ্তানি করে, বড় বড় কোম্পানি এদের গোডাউনে অভিযান করুক। তারাই জানে তেল কোথায় রেখেছে।”
সরকারের হিসাবে পর্যাপ্ত মজুদ
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। সে হিসেবে তেলের মজুদ ও সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে।
সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর জন্য মিল মালিকদের প্রস্তাব নাকচ করার বিষয়টি উল্লেখ করে মন্ত্রী জানান, সামনে রমজান মাসের বিষয়টি মাথায় রেখে তা করা হয়েছে।
যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটা মানতে হবে জানিয়ে বাজারে তেলের এ সংকটের কারণে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
আমদানি ও মজুদের হিসাব তলব
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সব রিফাইনারির কাছে ভোজ্যতেলের গত তিন মাসের আমদানি ও মজুদের হিসাব চাওয়া হয়েছে।
“কত পরিমাণ ইম্পোর্ট করেছে, কত পরিমাণ রিফাইন করেছে, কত পরিমাণ ডিও/এসও দিয়েছে, কত পরিমাণ ডেলিভারি করেছে, কত মজুদ আছে, কাস্টমসের পেপারসহ ভোক্তা অধিকার হতে তথ্য চাওয়া হয়েছে।”
সোমবারের মধ্যে এ সমস্ত তথ্য পাওয়া যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এ তথ্য পাওয়া গেলে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারা করছে ধরা পরবে। তথ্য পাওয়ার পর প্রতিটি রিফাইনারিতে ভোক্তা অধিকার অভিযান চালাবে।”
তেল কোথায় এবং কার কাছে আছে- সেই বিষয়টি নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা আরও বেশ কিছু দিন আগে থেকেই এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
“একটি মিল কতটুকু তেল আমদানি করে, আর কতটুকু বাজারে ছাড়া হয়, সেই হিসেবটা আমরা বের করার চেষ্টা করছি। সেজন্য গতকাল (বৃহস্পতিবার) আমাদের ডিজি স্যারের স্বাক্ষরে সব রিফাইনারি কোম্পানিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
“গত তিন মাসে কতটুকু তেল আমদানি করেছে এবং কতটুকু রিফাইন করেছে, সেই রিফাইন পেয়ে কতটুকু তারা এসও দিয়েছে ও সরবরাহ কতটুকু করেছে সেই হিসাবটা আমরা মেলাব।”
শাহরিয়ার বলেন, “সাপ্লাই চেইনে আগে যেমন নিচের দিকে তদারকি করা হতো, এখন আর নিচের দিকে যাচ্ছি না, আমরা এখন চেইনের একেবারে টপ লেভেলে গিয়ে কাজ করছি।”
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা হায়দারকে ফোন করলেও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধ পাওয়া যায়।