আসছে বাজেটে করপোরেট করহার কোনো খাতে না কমানোর ইঙ্গিত দিয়ে বরং যেসব খাত বর্তমানে অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছেন সেখানেও বাড়বে বলে জানিয়েছেন তিনি।
Published : 13 Apr 2025, 10:07 PM
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ চুক্তির আওতায় যখন রাজস্ব আদায় বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), তখন ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক সামাল দিতে বাংলাদেশ বিভিন্ন মার্কিন পণ্যে যে কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাতে রাজস্ব আদায় আরও কমবে বলে জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
বাংলাদেশে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় শুল্ক বেশি থাকায় সেখানে ‘যৌক্তিকীকরণ’ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, “ইউএস ট্রেজারি যে ব্যবস্থা, সেখানে যে আমরা কিছু কমিটমেন্ট করেছি, আমাদের ডিউটি স্ট্রাকচার কিছুটা র্যাশনালাইজ করতে হবে। সেখানে আমাদের কালেকশন কমবে।
“একইভাবে ইনকাম ট্যাক্সের ক্ষেত্রেও, যে কথাগুলো বললেন যে মিনিমাম ট্যাক্স, টিডিএস এসব অনেক হাই, এগুলো যদি র্যাশনালাইজ করতে যাই, এখানেও কালেকশন কমবে।”
কর আদায়ের প্রধান এ সংস্থার চেয়ারম্যানের প্রশ্ন, “তাহলে কালেকশনটা বাড়বে কোথায়? বাড়ানোও তো দরকার। দেশ চালানোর জন্য বাড়ানোটাও তো দরকার।”
ঢাকা চেম্বার, সমকাল এবং চ্যানেল-২৪ আয়োজিত ‘প্রাক-বাজেট আলোচনা ২০২৫-২৬: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কথা বলছিলেন মো. আবদুর রহমান খান।
আসছে বাজেটে করপোরেট করহার কোনো খাতে না কমানোর ইঙ্গিত দিয়ে বরং যেসব খাত বর্তমানে অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছেন সেখানেও কমবে বলে তিনি জানান।
চেয়ারম্যানের ভাষ্য, “এমনিতেই আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ে এবং কর্পোরেট কর হার তুলনামূলক বেশ কম, তাই এবছর উক্ত খাতে কর অপরিবর্তিত থাকবে। তবে আগামী বাজেটে রাজস্ব হারে বিদ্যমান বৈষম্য দূর হবে।”
অর্থ্যাৎ অব্যাহতি কমিয়ে সকলকে একই হারের দিকে আনার ইঙ্গিত দেন তিনি।
আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের শর্তের আওতায় এনবিআরকে আসছে অর্থবছরে কেবল নীতি প্রণয়নের মাধ্যমেই বাড়তি ৫৭ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। এনবিআর সেখানে কেবল ৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ে সক্ষম বলে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে হওয়া সাম্প্রতিক বৈঠকে জানানো হয়।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন শতাধিক দেশে বাড়তি সম্পূরক শুল্ক বসিয়েছে; বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়েছিল বাড়তি ৩৭ শতাংশ। আগের গড়ে ১৫ শতাংশের সঙ্গে যোগ হয়ে বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে শুল্ক দাঁড়িছিল ৫২ শতাংশে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধে সেই বাড়তি শুল্ক ৩ মাসের জন্য স্থগিত করা হলেও বাড়তি ১০ শতাংশ, অর্থৎ মোট ২৫ শতাংশ শুল্ক ঠিকই দিতে হবে।
ইন্টারন্যাশন্যাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের রপ্তানির উপর শুল্কারোপের প্রসঙ্গে বলেন, “সরকারের উচিত এ ব্যাপারে নেগোশিয়েশনের উদ্যোগ নেওয়া এবং ডিসিসিআই সহ বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিবৃন্দের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো মানের তুলা আমদানি বৃদ্ধিতে ওয়্যার হাউস নির্মান সুবিধা প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “তাতে সেদেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে। এছাড়া ম্যান মেইড ফাইবারের মত হাই ভ্যালু পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।”
‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’ চান ব্যবসায়ীরা
বৈশ্বিক অস্থিরতা ও শুল্ক যদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সংকট নিয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, “আভ্যন্তরীণভাবে আমরা দেখছি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির উন্নত না হওয়া, জ্বালানি সংকট ও অকার্যকর সরবরাহ, প্রাইভেট সেক্টরের ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়া, নতুনভাবে কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ তৈরি না হওয়া, উচ্চ আমদানি নির্ভরতা এবং ক্রমানবতি রাজস্বের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিতে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শিল্প সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
তার ভাষায়, এমন বাস্তবতায় ‘বিনিয়োগের একদম বড় পূর্ব শর্ত হল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ।
এসময় শুধু কর ব্যবস্থাপনা নয়, শুল্ক কাঠামোকে সম্পূর্ণ অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা, দেশি বিনিয়োগকারীদের আগামী বাজেটে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুবিধা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বিনিয়োগ ও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি না বাড়লে অর্থনীতি সম্প্রসারিত হবে না, তবে এজন্য সহায়ক নীতিমালা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় সংষ্কার আবশ্যক। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে, ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না, কারণ হলো স্বল্পমেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ প্রদান কখনই টেকসই হয় না।”
তিনি মনে করেন, “বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য কার্যকর এবং সহায়ক কর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি।”
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিকল্পে করজাল সম্প্রসারণ এবং কর ব্যবস্থাপনার সহজীকরণ আবশ্যক।”
এছাড়াও অটোমোটেড কর্পোরেট কর রিটার্ন পদ্ধতি চালু, আমদানি পর্যায়ে আগাম কর উৎপাদনকারীদের জন্য বিলুপ্তি ও বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের জন্য হ্রাস করা, অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য ১ শতাংশ এবং অন্যান্যদের জন্য ভ্যাটের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নির্ধারণের প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
ডিসিসিআইয়ের পক্ষে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয় সীমা বছরে সাড়ে তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
রাজস্ব আদায় নয়, ব্যয় যৌক্তিক করার প্রস্তাব
এফবিসিসিআইয়ে সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু অভিযোগ করেন, সরকারি খাতের জন্য যেখানে সম্প্রসারিত নীতি নেওয়া হয়েছে, সেখানে বেসরকারি খাতের জন্য ‘সংকুচিত নীতি’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তার প্রশ্ন, “এ আবার কেমন নীতি?”
মিন্টু বলেন, “দীর্ঘদিন যাবত সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বজায় থাকলে বেসরকারিখাতে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হবে না। আমাদের উদ্যোক্তারা পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করতে আগ্রহী, তবে প্রয়োজন সহায়ক নীতিমালা।”
রাজস্ব নীতিমালার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য নীতির মধ্যে সমন্বয় আনারও তাগিদ দেন এ ব্যবসায়ী।
কর-জিডিপি’র হার বাড়াতে তিনি টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা কর দেন না, তাদের করের আওতায় নিয়ে আসার ওপর জোর দেন এবং যারা কর দেন, তাদের হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানান।
এফবিসিসিআইয়েল আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, “গতানুগতিক ঘাটতি বাজেট এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি।”
তিনি সরকারের কাছ থেকে একটি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বান্ধব, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বাস্তবমুখী এবং সময়োপযোগী বাজেট প্রত্যাশা করেন।
এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদন্নোতি দেওয়ায় ব্যয় বাড়বে মন্তব্য করে রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে সরকারি ব্যয় হ্রাসে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান নাসির হোসেন।