Published : 29 Aug 2022, 10:36 PM
ইউক্রেইন ও রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব এতদিনে এসে পড়তে শুরু করেছে দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে; পশ্চিমে উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতিতে বিক্রিতে ভাটা পড়ায় রপ্তানি আদেশ কমার পাশাপাশি আগের ক্রয়াদেশ স্থগিতের তথ্যও দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
এতে কোভিড মহামারীর ধকল কাটিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে থাকা তৈরি পোশাক খাত আগামী কয়েক মাসে বড় অঙ্কের আয় কমার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, পোশাকের প্রধান দুই রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে কয়েক দশকের মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে খুচরা বিক্রি কমেছে উল্লেখযোগ্যহারে। এতে বড় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ওয়ালমার্ট ৩০ শতাংশের মত ক্রয়াদেশ ইতোমধ্যে স্থগিত করেছে।
অন্য বড় ব্র্যান্ডগুলোও চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে জানিয়ে সব পর্যায়ের রপ্তানিকারকরা বলছেন, ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা আদেশও পরে নেবে বলে অনেক ব্র্যান্ড জানিয়েছে। পরের কয়েক মাসের আদেশ কমিয়ে দেওয়ার সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে পোশাকের উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধিতে ভাটা পড়ার আশঙ্কা তাদের। জুলাইয়ের রপ্তানি আয়েও এর কিছুটা প্রভাব দেখা গেছে বলে জানান তারা।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজেএমইএ এর সহ সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিমের আশঙ্কা জুলাইয়ের তুলনায় অগাস্টে রপ্তানি ৫০ কোটি ডলার কমে যেতে পারে।
অগাস্টে ক্রয়াদেশও অনেক কমে গিয়েছে জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এর প্রভাব দেখা যাবে অক্টোবর ও নভেম্বরের দিকে।
“অনেকেই ক্রয়াদেশ হেল্ডআপ করছে। নতুন অর্ডার কম দিচ্ছে। ওয়ালমার্ট ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। ইউরোপ আমেরিকা সব বাজারেই একই পরিস্থিতি। রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপে এখন মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি।”
পোশাক রপ্তানিকারক ফ্যাশন ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান মনিরুল আলম শুভ তার কারখানায় রপ্তানি আদেশ কমার তথ্য দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে একজন ক্রেতা আমার কাছে ৮/৯ আইটেমের পোশাক মিলে ২০ হাজার পিসের অর্ডার দিয়েছেন। অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল ২/৩ আইটেম মিলিয়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার পিস।“
এর কারণ হিসেবে রপ্তানির প্রধান বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাকের বিক্রি কমে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। এসব বাজারে পোশাকের বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে তুলে ধরে তিনি বলেন, এর প্রভাব ইতোমধ্যে ক্রয়াদেশে পড়তে শুরু করেছে।
অগাস্টের রপ্তানি পণ্যের ক্রয়াদেশ এপ্রিল-মে মাসে এসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ওই সময় পর্যাপ্ত অর্ডার থাকায় রপ্তানি হয়ত অতটা কমবে না। কিছু অর্ডার স্থগিত করা হলেও টাকার অঙ্কে তা হয়ত অতটা স্পষ্ট হবে না।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ এর সহ সভাপতি ফজলে শামীম এহসানও প্রায় একই রকম তথ্য দেন।
তার মতে, গত বছর কোভিড পরবর্তী অগাস্টে বিক্রি খুব খারাপ ছিল। সে কারণে শেষ হতে চলা অগাস্টে রপ্তানিতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি পাওয়া যাবে। কিন্তু গত জুলাইয়ের প্রকৃত রপ্তানির সঙ্গে তুলনা করলে অগাস্টে রপ্তানি কম হবে। দৃশ্যত টাকার অংকে হয়ত বেশি হবে।
জুলাইতে ঈদের জন্য কারখানা ৯ দিন বন্ধ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ওই মাসে ৭০ শতাংশ কাজ হয়েছিল। জুলাইয়ের তুলনায় অগাস্টে ৩০ শতাংশ বেশি কর্মদিবস পেলেও প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা তার।
দিনে দিনে ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, অগাস্টে নতুন ক্রয়াদেশও খুব ভালো আসেনি। গত ২৪ অগাস্টের হিসাব অনুযায়ী এ খাতের কারখানাগুলোতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ কম ছিল ক্রয়াদেশ।
তার মতে, “সেপ্টেম্বরেও রপ্তানি পরিস্থিতি খারাপ থাকবে। অক্টোবরের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এর মধ্যে পরিবর্তন হবে। ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি হলে এবং রাশিয়া একটু ছাড় দিলে হয়ত বাজার পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াবে।“
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার কারণে এখন বিকল্প বাজার খোঁজা হচ্ছে জানিয়ে বিজিএমইএ সহ সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, রপ্তানি কমে যাওয়ার এই ট্রেন্ডটা শঙ্কাজনক। সামনে আরও কমবে। রপ্তানি ও ক্রয়াদেশ ব্যালেন্স করার জন্য এশিয়ার বাজারগুলোতে জোর দিচ্ছি আমরা। বিশেষ করে চায়না, জাপান, কোরিয়া, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে।
“ভারত মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলোতে এফটিএ করে ফেলছে। সামনের মাসে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে করতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও হয়নি। আমাদের লোকজন বসে বসে কী করছে। এখনই মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে এফটিএ করতে হবে।”
রপ্তানি বাজার শঙ্কুচিত হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, লোডশেডিং ও গ্যাসের স্বল্পতার বিষয়গুলোও পোশাক খাতকে বেশি চাপে ফেলতে বলে মনে করেন কারখানা মালিকরা।
অথচ চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি থেকেই পোশাক রপ্তানির চিত্র ছিল খুবই আশা জাগানিয়া। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ের নেতিবাচক অবস্থা কাটিয়ে অগাস্ট থেকে জুন পর্যন্ত ১১ মাসে সর্বনিম্ন ১১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
পোশাকের রেকর্ড আয়ের উপর ভর করে প্রথমবারের মত দেশের মোট রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়ায়। গত বছর পোশাক থেকে মোট আয় আসে ৪২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। সেটির ওপর ভিত্তি করে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেইনে সামরিক অভিযান শুরু করলে রপ্তানি পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা বাড়তে থাকে। এতদিন পর্যন্ত তা টের পাওয়া না গেলেও চলমান যুদ্ধের কারণে পশ্চিমের দেশগুলোতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাপনে প্রকট হতে শুরু করে। এর কবলে এখন পড়তে যাচ্ছে দেশের পোশাক খাত। আগের সেই শঙ্কাই বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে অগাস্টে ক্রয়াদেশ কমার মধ্য দিয়ে।
ইউরোপে শক্ত অবস্থানে
চলতি পঞ্জিকা বর্ষে ২০২২ সালের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ব্যাপক হারে বাড়ার সুবাদে ইউরোপের বাজারেও তৈরি হয়েছে শক্ত অবস্থান। এসময়ের মধ্যে ইউরোপে অন্যান্য প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে প্রবৃদ্ধিতে সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাট ২০২২ সালের জানুয়ারি-মে সময়ের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পোশাক আমদানির সর্বশেষ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
এতে দেখা যায়, ওই সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইইউতে রপ্তানি ৪৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেড়ে ৯ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর এ সময়কালে সেখানে সব দেশ থেকে পোশাক আমদানি বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ইইউ দেশগুলো টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি পোশাক কিনেছে চীন থেকে; মোট আমদানি ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার।
অন্যান্য দেশের মধ্যে ইইউতে কম্বোডিয়ার প্রবৃদ্ধি ৩২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, পাকিস্তানের ২৯ দশমিক ২৮ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ভিয়েতনামের ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং মরক্কোর ২০ শতাংশ।
বিজিএমইএ এর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এখন পর্যন্ত ইইউর আমদানির পরিসংখ্যানে সেখানে বাংলাদেশের পোশাকের ভালো অবস্থান নির্দেশ করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে সেখানে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ফলে খুচরা বিক্রি কমেছে। এতে পোশাক খাত বিশ্ব বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সংগ্রাম করছে।
অনেক ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের খুচরা বিক্রি কমে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, যা তাদের ‘ইনভেন্টরি স্টক’ বাড়িয়েছে। এসব কারণে আগামী মাসগুলোতে ইইউ বাজারে আমাদের রপ্তানি কমে যেতে পারে।
আরও পড়ুন
৬৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য