দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যে সংকটে আছে, তারই প্রভাব দর্জিবাড়িতে পড়েছে বলে মনে করছেন টেইলার্স মালিকরা।
Published : 08 Apr 2024, 12:00 AM
“আগের মতো এখন আর মানুষ কাপড় বানায় না। জিনিসপত্রের দাম তো বেশি, এইজন্য হয়ত মানুষ কাপড় না বানায়ে রেডিমেড কিইন্না পড়ে। খরচও কম হয়।”
ঈদের আগে দর্জিবাড়িতে যে আগের মতো চাপ নেই, সেই কথাই বলছিলেন কাটিং মাস্টার শিমুল আহমেদ।
ধানমন্ডির অরচার্ড পয়েন্টের আঁচল টেইলার্সের এ কর্ণধার জানান, গতবার ১০ রোজার পরে তিনি আর কাজের অর্ডার নেননি। তবে এবার চাপ না থাকায় ২২ রোজাতেও কাজের অর্ডার নিয়েছেন তিনি।
শিমুল বলছিলেন, মহামারীর আগের বছরগুলোতে রোজায় কাজের চাপে ফুরসত মিলতো না তাদের।
“পাঁচ বছর আগে ঈদের মৌসুমেই বাড়তি ৫-৭ জন কারিগর লাগতো কাপড় বানানোর জন্য। কত ডিজাইনের কত যে অর্ডার আসতো! অনেক ব্যবসা হইতো এই রোজার ঈদে।”
কোভিড মহামারীর পর ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের ডামাডোলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন শিমুল। তার মতে, একদিকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে, অন্যদিকে অনেকেই ঈদ বোনাস পেয়েছেন পরে।
শিমুল বলেন, “অনেকে আগেভাগে বোনাস পায় নাই। বোনাস পাইছে পরে। পরে তো আর অর্ডার নেওয়া হয় না। এজন্য তারা কাপড় বানাতেও দেয় নাই। করোনাভাইরাসের আগে যেভাবে জমজমাট ব্যবসা ছিল, সেভাবে আর ব্যবসা হচ্ছে না।
“আগামীতেও হবে বলে মনে হয় না। কারণ এখন তো রেডিমেড কাপড় বিক্রি হয় বেশি। ডিজাইন করা কাপড়ও পায়। আবার অনলাইন থেকে রেডিমেড কাপড় কিনে ফেলে। কেউ কেউ বড় বড় ব্র্যান্ড থেকে রেডি ড্রেস কেনে। এসব কারণে আগের মতো আর ব্যবসা নাই।”
ভিড় নেই কোথাও
রাজধানীর নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি, গুলিস্তান ও মিরপুর এলাকার বিপণিবিতানের পাশাপাশি গলির দর্জি দোকানে এবার ভিড় কম দেখা গেছে।
ধানমন্ডির প্লাজা এ আর শপিং মলের ইভা অ্যান্ড রিফাত টেইলার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মকবুল হোসেন বলেন, “এবার তেমন অর্ডার পাই নাই। প্রতিদিন অর্ডার আসছে। দিনের কাজ দিনে শেষ করছি। স্টকে যে কাজ থাকে, সেরকম কিছু নাই।
“অন্যান্যবার ১০ রোজা গেলেই স্টকের কাজ করে আমরা কুলায়ে উঠতে পারি না। ঈদে কাজ শেষ করতে পারব কি পারব না- এমন একটা অবস্থা হয়। কিন্তু এবার এমন কিছু নাই। ২০ রোজাতেও অর্ডার নিছি, কিছু কাজ আছে। সেগুলো করতেছি।”
গুলিস্তানের পীর ইয়ামেনী মার্কেটের বাবুল টেইলার্সের বাবুল মিয়াকে কাপড় সেলাই করতে দেখা গেল।
কাজের মধ্যেই তিনি বললেন, “এবার কাজ অনেক কম, বাজার ভালো না বেশি। এখন ৬০ ভাগ কাজ চলতেছে, ৪০ ভাগ কাস্টমার নাই হয়ে গেছে। আমরা বুঝতেছি টাকা পয়সার সংকট চলতেছে।”
কাজের চাপ কম থাকায় তিনি নিজেই কাপড় সেলাই করছেন বলে জানালেন।
এই বিপণিবিতানের নিচতলার এম ইসহাক টেইলার্সের মালিক আবু ইসহাকও এবার খুব বেশি কাজ পাননি।
তিনি বলেন, “ব্যবসা তেমন একটা হয় নাই। বিশ্বে মন্দা পরিস্থিতির জন্য এমন একটা অবস্থা। সবাই ব্যালেন্স করে চলার চেষ্টা করতেছে। ক্যাশ কিছু টাকা যে রাখব, তার উপায় নাই। কারিগরদের টাকা দিয়ে সমান সমান অবস্থা।
“আগে রোজার ঈদে আমাদের সারা বছরের ব্যবসা হইতো। অনেক আনন্দ, আবার অনেক প্রেশার নিয়ে কাজ করতাম। সারা বছর কোনোরকম চলি। ঈদই তো আমাদের সিজন। কিন্তু এখন আর তেমন সাড়া পাচ্ছি না।”
মিরপুরের দর্জির দোকানগুলোতেও এবার আশানুরূপ কাজের অর্ডার আসেনি বলে জানিয়েছেন টেইলর মাস্টাররা।
তারা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারীর পর থেকে তাদের ব্যবসায় আগের মতো লাভের মুখ দেখছেন না।
মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরের রঙধনু শপিং কমপ্লেক্সের নিউ ফ্যাশন টেইলার্সের পরিচালক জুলমত মাস্টার জানালেন, এবার মোটামুটি কাজ পেলেও বছর পাঁচেক আগে যে চিত্র ছিল, তেমন ্যবসা জমেনি।
জুলমত বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ অর্ডার আসছে। এখন আর আগের দিন নাই। সেই সময় জমজমাট হইতো। করোনাভাইরাসের পর থেকে দর্জি ব্যবসা আর জমে নাই।”
পাশের সৌখিন টেইলার্সের কর্ণধার ওয়াহিদ মাহমুদের ভাষ্য, এক সময় পাঁচ রোজার মধ্যেই তাদের অর্ডার নেওয়া শেষ হয়ে যেত; কাজের চাপে দম ফেলারও সময় পেতেন না।
“এবার এখনও অর্ডার নিচ্ছি। ১০০-১৫০ টাকা বাড়ায় দিলেই নিচ্ছি। আমার পরিচিত এক কাস্টমার গতকাল ফোন দিছে, সে এখনো কাপড় পাঠায় নাই। তারটা বানায় দিব। আগে ঈদ ছাড়াও পূজা, বিজয় দিবসে অনেক কাজ আসতো। এখন সেটা আসে না।”
মিরপুরের দোকানগুলোতে সুতি থ্রি পিস বানাতে ৫০০-৬০০ টাকা এবং সিনথেটিক থ্রিপিসে ৮০০-৯০০ টাকা বানি গুনতে হচ্ছে।
এই মার্কেটের ছেলেদের পোশাক তৈরির দোকান টুডে ফ্যাশনের মালিক শামীম হোসেন এবার পাঞ্জাবি বানানোর কাজ বেশি পেয়েছেন। তিনি ৭০০ টাকায় বিভিন্ন নকশার পাঞ্জাবি বানাচ্ছেন।
“২০ রোজায় অর্ডার বন্ধ করছি। অন্যান্যবার ১০ রোজার পর থেকে অর্ডার নিতেই পারি না। এইবারে অবস্থা উল্টা হইছে। অর্ডার বেশি আসছে ১৫-২০ রোজায়। আগের মত অবস্থা নাই। এই ব্যবসার অবস্থাও ভালো না। টেইলরের কাজ শিখে অনেকেই বিদেশে চলে যাচ্ছে।”
তবে তুলনামূলক ভালো সাড়া পেয়েছে নিউ মার্কেটের দর্জি দোকানগুলো।
নিবেদিতা টেইলার্সের স্বত্ত্বাধিকারী শহীদুল ইসলাম ও তার কারিগরদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। তিনি কামিজ কাটছিলেন, আর তা সেলাই করছিল কারিগর।
এবার মজুরি না বাড়ানোর কারণে কাজ বেশি পেয়েছেন বলে মনে করছেন শহীদুল।
“এবার ভালোই অর্ডার পেয়েছি। এখন ড্রেস ডেলিভারি দিচ্ছি। ঈদের দিনও কাউকে কাউকে ডেলিভারি দিব। এখন কাজের অনেক চাপ।”
তিনি সুতি থ্রিপিস বানাতে সাধারণ সময়ের মতো ৫০০ টাকা মজুরি নিচ্ছেন। আর সিনথেটিক কাপড়ের জন্য নিচ্ছেন ৭০০-৮০০ টাকা।
এই মার্কেটের আরেক দর্জির দোকান ভাই ভাই টেইলার্সের মালিক হাবিবুর রহমানও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি কাজ পেয়েছেন।
হাবিবুর বলেন, “গতবারের মতই কাজ এসেছে। আল্লাহ যতটুকু রিজিকে রাখছে, ততটুকুই আসছে। ছেলেদের পাঞ্জাবি এবং মেয়েদের থ্রিপিসের অর্ডার এবার বেশি এসেছে।”
পোশাক তৈরির ব্র্যান্ড টপ টেনে এবার গতবারের চেয়ে বেশি কাজ এসেছে।
টপ টেনের কাস্টমার সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজার মাহবুবুল হক বলেন, “১০-১৫ রোজার মধ্যে আমরা অর্ডার নিয়েছি। গত বছর থেকে এবার আমাদের কাজ বেশি এসেছি। পাঞ্জাবির অর্ডার বেশি পেয়েছি। ডেলিভারি নেওয়ার অপেক্ষায় আছে কাস্টমাররা।”
টপ টেন মার্ট থেকে এখন রেডিমেড পোশাক যেমন শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ক্রেতাদের আগ্রহ রেডিমেইডে
ঈদের সময় ঘনিয়ে আসায় বানানো পোশাকের দিকে ঝুঁকছেন বেশির ভাগ ক্রেতা। পোশাক তৈরির ঝক্কি এড়াতে তারা রেডিমেইড পোশাকে ঝুঁকছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাসরিন নাহার, তার বোন, মা, ভাবী কেউই এবার পোশাক বানাতে দর্জিবাড়িতে যাননি।
নাসরিনের কথায়, “এখন সবকিছু রেডিমেড পাওয়া যায়, সেগুলো বেশি স্টাইলিশও হয়- কোন একটা পছন্দ করে কিনে ফেলা যায়৷ দর্জিদের অনেকসময় ঠিক বোঝানো যায় না যে, জামায় আমি কোন ডিজাইনটা চাচ্ছি, তখন মন মতো হয় না।
“কেনার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয় না। এছাড়া কাপড় বানাতে গেলে প্রথমে কাপড় কিনে আমার দর্জির কাছে যেতে, বিভিন্ন ঝামেলার মধ্য দিয়ে এ প্রসেসটা শেষ হয়; খরচও হয় একটু বেশি। কিনে ফেললে কোনো ঝামেলা নেই। এসব বিবেচনায় আমি সবসময়ই রেডিমেড কাপড় কিনি৷”
মিরপুরের বাসিন্দা ফারুক হোসেন নিজের জন্য এবং আত্মীয়স্বজনকে উপহার দেওয়ার জন্য রেডিমেইড পাঞ্জাবি কিনেছেন।
ফারুক বলেন, “একটা পাঞ্জাবির মজুরি ৭০০ টাকা। এতো টাকা মজুরি দিয়ে কাপড় বানাবো, আবার ফিটিংটাও দেখা যাবে- ভালো হরো না। তখন তো মন খারাপ হয়ে যাবে। তাই ভালো দোকান থেকেই কিনেছি।”
এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা হোসনে আরা বেগম নিজের জন্য এবং তার মেয়ে ও ভাতিজির জন্য ব্র্যান্ডের শোরুম থেকে থ্রিপিস ও ওয়ান পিস কিনেছেন।
“থ্রিপিস গিফট করলে সে হয়তো এটা এই ঈদে পরতে পারবে না। তাই সাইজ অনুযায়ী রেডিমেড পোশাক কিনে ফেলেছি। ওগুলোর ফিটিংও ভালো হয়। ডিজাইনটাও হয় ইউনিক,” বলছিলেন হোসনে আরা।
আবার কেউ কেউ দর্জিবাড়ি থেকে কাপড় বানালেও তাদের কাছে মজুরি বেশি ঠেকছে।
মিরপুরের পাইকপাড়ার গৃহিণী তানজিলা হক প্রিমা বেশ কয়েকটি থ্রিপিস ও ব্লাউজ বানিয়েছেন দর্জির কাছ থেকে।
তার ভাষ্যে, “ঈদ উপলক্ষে মজুরি নিয়েছে অনেক বেশি। আবার কাপড়ও মন মতো হয়নি। এগুলো ঈদের পরে আবার ঠিক করতে হবে। এখন আর ঠিক করে দিবে না বলেছে।”