জুতার দাম ‘বেশি’, দোকানে দোকানে তর্কাতর্কি

বিক্রেতাদের ভাষ্য, এ বছর জোড়াপ্রতি তাদের অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে জুতা কিনতে হয়েছে। ফলে কমে বিক্রির উপায় নেই।

মরিয়ম সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2023, 07:52 PM
Updated : 31 March 2023, 07:52 PM

“ধুর মিয়া! এইটার দাম ১৫০০ টাকা! আপনি কী মনে করেন? এই জুতার দাম কেমন হইতে পারে? তা আমি জানি না?”

ঢাকার নিউ এলিফ্যান্ট রোডের সিটি সুপার মার্কেটে এক দোকানের সামনে সোমবার দুপুরে দাঁড়াতেই দেখা গেল চার বছর বয়সী মেয়ের জন্য জুতা কিনতে আসা রফিকুল ইসলামের সাথে তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে দোকানের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ফরহাদ আহমেদের।

রফিকুল বললেন, “বাচ্চাদের জুতা কিনতে আসছি। কিন্তু ইচ্ছামত দাম চাইতেছে সবাই। ১৫০০ টাকা খরচ করতে হলে এলিফ্যান্ট রোড থেকে জুতা কে কেনে?”

বিক্রেতা ফরহাদের ভাষ্য, “আমরা এই মার্কেটের সবচেয়ে পুরান দোকানদার। এখানে যারা আসে, তাদের অধিকাংশ রেগুলার কাস্টমার। উনি যদি আমাদের রেগুলার কাস্টমার হইত, তাইলে উনি জানত যে আগের দামে এখন আর জুতা পাওয়া যায় না। তাছাড়া বাচ্চাদের জুতার দাম এমনিতেই বেশি।”

জুতার দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে এরকম মন কষাকষি দেখা গেল এলিফ্যান্ট রোডের জাহানারা ভবন, গফুর ম্যানশন, চৌরঙ্গী ভবন, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ও ফার্মগেইটের ফুটপাথের দোকান ঘুরে।

পণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা দর কষাকষি স্বাভাবিক। তবে দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, এবার ঈদ বাজারে জুতোর দাম গত বছরের তুলনায় অনেকটাই বেশি। আর দাম নিয়ে তর্কাতর্কি, রাগারাগি চোখে পড়ছে দোকানে দোকানে।

ক্রেতাদের অভিযোগ, বিক্রেতারা একজোট হয়ে অনেক বেশি দাম চাইছেন। দাম যে বেড়েছে, তা স্বীকার করছেন বিক্রেতারাও। তাদের দাবি, পাইকারিতে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাদের কিছুই করার নেই।

সোমবার সিটি মার্কেটে দুই ছেলে-মেয়ের জন্য ঈদের জুতা কিনতে এসেছিলেন শিল্পী বেগম। কিন্তু বাজেটের মধ্যে ভালো মানের জুতা খুঁজতে খুঁজতে তিনি হয়রান।

শিল্পী বলেন, “ঈদের আগে মার্কেটে ভিড় থাকবে অনেক। আর শেষ দিকে তো দাম স্বাভাবিকভাবেই অনেক বাড়বে। তাই এবার ভাবছি ওদের জুতাটা আগে আগে কিনে ফেলি। কিন্তু আগে আগেই যা দাম, পরে যে কী হবে তা শুধু আল্লাহ জানে!” 

সেই দুপুরে সিটি মার্কেটে রফিকুল বা শিল্পীদের মত কিছু ক্রেতার দেখা মিললেও জাহানারা ভবন কিংবা গফুর ম্যানশনে দেখা যায় একেবারে ভিন্ন চিত্র। সেখানকার অনেক বিক্রেতা চিন্তিত মুখে বসে আছেন। কোনো ক্রেতা মার্কেটের ভেতর পা রাখতে না রাখতেই তাকে নিজেদের দোকানে টেনে নিতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছেন তারা।

জাহানারা ভবনের লোটাস বাজারে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে জুতা দেখতে এসেছিলেন সুরাইয়া জাহান।

তিনি বলেন, “আমি শুনেছি, এখানে অনেক কম দামে ভালো মানের জুতা পাওয়া যায়। তাই ভাইকে নিয়ে এলাম। কিন্তু যেভাবে দাম চাচ্ছে, তা ব্র্যান্ডের জুতাকেও হার মানাচ্ছে। একটা আর্টিফিশিয়াল লেদারের যে লোফার, তার দাম চায় এখানে সতের-আঠারশ টাকা।”

“আমার নিজের জন্য জুত্তি (কারচুপির কাজ করা এক ধরনের জুতা) দেখলাম। কিন্তু ১৫০০-২০০০ এর নিচে কোনো জুত্তি নাই এখানে। একটু ভালো কোনো স্লিপার কিনবেন, মিনিমাম ৭০০ টাকা…দেখি, আজ একটু দেখে যাব। ব্যাটে-বলে মিললে নিব আজ। নয়ত একবারে ঈদের আগে আগে কিনব।”

আগে-ভাগে ঈদের জুতা কিনবেন বলে সেদিন চৌরঙ্গী ভবনে এসেছিলেন নওরিন জাহানও। কিন্তু জুতার দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তি দেখে অসন্তুষ্ট তিনিও। বললেন, “প্রতি বছর এখানে আসি, যাতে একটু কমে জুতা কিনতে পারি। কিন্তু যা দাম চাচ্ছে, মনে হয় না কিছু কিনতে পারব আজ।”

দাম কেন বাড়ল?

জুতার দাম নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে কেন এই অসন্তোষ, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে এলিফ্যান্ট রোডের দোকানিরা জানান, এ বছর জোড়াপ্রতি তাদের অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে জুতা কিনতে হয়েছে।

জাহানারা ভবনের লোটাস বাজার নামের জুতার দোকানে গত ১২ বছর ধরে কাজ করছেন জহির হোসেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে জুতাটা আগে ১০০ টাকা দিয়ে কিনতাম, সেটা এখন আমাদের ১৩০ টাকা দিয়া কিনতে হয়। তাইলে বেচার সময় অন্তত ২০০ টাকা তো লাভ করাই লাগবে আমাদের। 

“এখন আমাদের মিনিমাম ৩০% বেশি দিয়ে জুতা কিনতে হয়। পরিস্থিতি আমাদের নাগালের বাইরে। একটা জুতায় যদি ২০০ টাকা লাভও না করেন, তাইলে ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে এক জোড়া মালের পেছনে মিনিমাম ৫০ টাকা রোড খরচ আছে। ইলেক্ট্রিক বিল, দোকান ভাড়া, কর্মীদের বিল, কাগজ কলমের বিলে আরও ২০০ টাকা। এই খরচটা আগেও ছিল, কিন্তু তার পরিমাণও এবার বাড়ছে। ফলে এখন ক্রেতারাও হিমশিম খাচ্ছে, আমরা বিক্রেতারাও হিমশিম খাচ্ছি।”

তার ভাষ্য, চীন থেকে যেসব জুতা বাংলাদেশে আসে, আগে তা জাহাজে করে আসত। কিন্তু এবার ডলার সংকট এবং এলসি খুলতে না পারার জন্য সেসব বিমানে করে আনতে হয়েছে।

“ফলে পাইকারদের খরচ বেড়ে গেছে। সেই দাম তারা আমাদের থেকে তুলছে। আর বাংলাদেশে যে সব জুতা তৈরি হয়, সেগুলার খরচও তো বাড়ছে। কারণ, সেগুলার কাঁচামাল তো বাইরে থেকে আসছে।”

গফুর ম্যানশনের আলিফা শুজের কর্মী মো. শামছুল বলেন, “আগে আমরা ১১০০-১২০০ টাকা করে চায়না স্নিকার্স কিনতাম। এখন কিনতে হয় ১৪০০ করে। কেডস, স্নিকার্স, বুট, শু ইত্যাদি জিনিসে অন্তত ১০০ টাকা করে বাড়ছে। লোকাল প্রোডাক্টেও এখন দাম বাড়তি। এসব তো কাস্টমার বোঝে না।”

তিনি বলেন, “ঈদের সময় পাঞ্জাবির সঙ্গে পরার জন্য মানুষজন হাফ শু বা স্লিপার বেশি কেনে। কিন্তু এখনো আমাদের বাজারটা লাগে নাই। কারণ জুতাটা সবাই পরে কেনে। আগে প্যান্ট শার্ট কেনে। আপাতত লেডিস আর বাচ্চাদেরটা টুকটাক চলছে। জেন্টস শুরু হবে ২০ রমজানের পর।”

স্বর্ণা শুজের মালিক মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, “জুতাপ্রতি এক থেকে দেড় শ টাকা দাম বেড়ে গেছে এবার। কাস্টমাররা আসে কমে কিনতে, আর আমরা চাই বেশি দামে বেচতে।

“পাইকাররা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আমাদের থেকে ২০০-৩০০ টাকা বেশি রাখে। তারা বলে তারা শিপে আনতে পারছে না, আনছে এয়ারে। খরচ বেশি পড়ে যাচ্ছে। বাড়তি দাম দিয়ে কিনলে আমরা বাড়তি দামে বেচব না?

“কাস্টমার সবজির দোকানে গিয়ে বেশি দামে সবজি কিনতে পারে, কিন্তু জুতার দোকানে এলে সব পাবলিকের বাজেট পড়ে যায়।”

চৌরঙ্গী ভবনের পরশ মনি শুজের শফি গাজী বলেন, “আমরা বাধ্য হই বেশি দিয়া কিনতে, কাস্টমারের বাজেটে হয় না। আর ওরা এলসির ব্যাপারে যতটা বলে, অতটাই সমস্যা না। একটু বাড়ায়াই বলে। যদি ৫ হয়, তাহলে ৭ বলে। এলসি তো শিথিল করা হইছে। না হইলে মাল কেমনে আনে?”

চৌরঙ্গী ভবনের আঁখি শুজের পারভেজ হোসেন বলেন, “রোজার লাস্টের ১০ দিন আমাদের বেচা-কেনা হয়। আর এখন মানুষ জুতা কিনবে নাকি খাবে? জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।” 

সিটি সুপার মার্কেটের মিলন শুজের কর্মচারী মো. শাওন, “আমার দোকানে ছেলে, মেয়ে, বাচ্চা সবার জুতা আছে। কিন্তু তুলনামূলক বিচারে এখন বাচ্চাদের জুতার দাম বেশি। কারণ, এলসি আর ডলারের সংকট। এছাড়া, লোকাল প্রোডাক্টের ম্যাটেরিয়ালও শর্ট আছে।” 

ব্র্যান্ডের দোকানের চিত্র কী?

বাটা কিংবা এপেক্সের মত দেশের বড় জুতার ব্র্যান্ডগুলোতে ঈদের কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে বলেই জানাচ্ছেন বিক্রেতারা।

এপেক্সের সিনিয়র স্টোর ম্যানেজার মোহাম্মদ শামীম শেখ বলেন, “ঈদ উপলক্ষে আমরা ২০০০ নতুন মডেলের জুতা এনেছি এবার। গত রমজানের থেকে ডাবল প্রোডাক্ট। আমাদের লক্ষ্য দেড়গুণ প্রফিট।

“যদি ঈদের কথা ধরি, তাহলে আমি বলব যে রমজানের শুরুর তিনদিন খুব ভালো বিক্রি হয়েছে আমাদের। আমাদের শুরুটা খুব ভালো ছিল। কারণ, আমরা শুরুটাই করছি হলিডে দিয়ে।”

তারা জুতার দাম বাড়িয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঈদ প্ল্যান তো আরও ৬ মাস আগ থেকে হয়। আর আমাদের এক্সপোর্ট বিজনেস আছে, তাই আমাদের দাম নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের প্রফিট কম হলেও আগের দামই রেখেছি আমরা আমাদের সব প্রোডাক্টে।”

ঈদ উপলক্ষে বিক্রি কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে বাটার সেলস এক্সিকিউটিভ তাহমিনাও প্রায় একই কথা বলেন।

“আমাদের বিক্রি তো খুবই ভালো। ছুটির দিন থাকায় ক্রেতার সংখ্যা আরও বেশি ছিল।

“আমি গত প্রায় ৫ বছর ধরে এখানে আছি। আমার মনে হয়, জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও ক্রেতা সংখ্যা আগে যা ছিল, এখনও তাই আছে। আমাদের কোনো কোনো জুতার দামও বেড়েছে, তবে খুব-ই কম।”