বাংলাদেশে ঋতু বৈচিত্র্য অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে, একদিন আগে শেষ হওয়া শীতে এবার সেভাবে শীত পরেনি। সেভাবে ঝড়েনি গাছের শুষ্ক পাতা! বসন্ত শুরু হয়েছে, তবে গাছে গাছে নেই আগের রং! শোনা যায় না এখন কোকিলের ডাকও! কেন? কেন? কেন?
যুক্তি নির্ভর দুনিয়া বলবে- এতো বৈশ্বিক উষ্ণতার ফল, যে কারণে হারিয়ে যাচ্ছে ঋতু বৈচিত্র্য। কিন্তু আমার মন বলে- না, বৈশ্বিক উষ্ণতা একটা বাকওয়াস। ঋতু বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবার কারণ দৈত্যের স্বার্থপরতা!
অস্কার ওয়াইল্ডের বিখ্যাত গল্প 'স্বার্থপর দৈত্য' কি আপনাদের মনে আছে? ঐ যে শিশুরা খেলতো দৈত্যের বাগানে। কিন্তু স্বার্থপর দৈত্যের তা সহ্য হবে কেন? তাই বাগানের চারদিকে তুললো উঁচু দেয়াল। নোটিশ টাঙ্গিয়ে দিলো- প্রবেশ নিষেধ। ফলে শিশুদের আর খেলার জায়গা রইলো না! তারপর সারাদেশে বসন্ত এলো, শুধু দৈত্যের বাগান ছাড়া। সেখানে কোন পাখি ডাকলো না, ফুল ফুঁটলো না, একটি সুন্দর ফুল ফোঁটার জন্য যেই মাথা তুলেছে অমনি নোটিশবোর্ড দেখে বাচ্চাদের জন্য দুঃখিত হয়ে আবারও ডুব দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো!
আপনাদের কি মনে হয়- এ কেবলই গল্প? না, এটাই জীবন। স্বার্থের ইমারত তুলে তুলে আমরাও তো খেয়ে ফেলেছি শিশুদের খেলার মাঠ, ভরাট করেছি দুরন্ত দুপুরে ঝাপানোর পুকুর। আমরা চুরি করেছি শিশুদের শৈশব। প্রশ্নপত্র ফাঁসে তাদের শেখাচ্ছি চুরির বিদ্যা। তবে কেন এ দেশে বসন্ত আসবে? কেন ফুল ফুটবে? কেন পাখি ডাকবে?
এতো গেলে সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুদের কথা, আর যারা সুবিধা বঞ্চিত তাদের অবস্থা তো কল্পনার অতীত! তাদের শৈশব চুরি হয়নি বরং দরিদ্র ঘরে জন্ম নেয়ায় জন্মের সময়ই জন্মের নাড়ি কাটার সাথেই কাটা পড়েছে তাদের শৈশব, শিক্ষা, সকল সুবিধা।
আমার বাসা মিরপুর। ২০১১ সালের এক সন্ধ্যায় স্টেডিয়াম আঙিনায় আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি কয়েকজন যুবক পথশিশুদের পড়াচ্ছে। বিষয়টি আমার ভালো লাগলেও, সত্যি বলতে আমি গুরুত্ব দেইনি। সেলফির যুগ হয়তো সেটা ছিলো না, কিন্তু ফটোসেশনের সময় তো ছিলো! টুকটাক সামাজিক দায়বদ্ধতার আড়ালে হিরোইজম ফলানোর ব্যাপারও ছিলো!
তবে আস্থাহীন সময়ে, আমার সন্দেহবাতিক মনকে লজ্জায় ফেলে 'সম্ভাবনার' উদ্যোগ এ পুষ্পকলি স্কুল চলেছে ২০১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ এবং চলছে ২০১৭ সালেও। সাত বছর ধরে চলা সম্ভাবনার এ পুষ্পকলি স্কুল চলছে মিরপুর, ধানমন্ডি ও কালশী, এ তিন শাখায়। যেখানে প্রায় ১৫০ পথ শিশুকে শিক্ষাদান করা হচ্ছে। চলতি শীতে সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করেছে একটি চমৎকার উদ্যোগ। তারা এ ১৫০ পুষ্পকলিকে শীতের উষ্ণতা দিয়েছে। এ উষ্ণতা শুধু গতানুগতিক শীতবস্ত্র দিয়ে নয়। অভাবের সাথে লড়ে যাওয়া এ ১৫০ শিশুর কল্পনায় মায়ের হাতের পিঠাতেও আছে মায়াময় উষ্ণতা। তাই সম্ভাবনা, ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্র সরোবরে আয়োজন করেছিলো এ ১৫০ পুষ্পকলিকে শীতবস্ত্র প্রদান ও পিঠা উৎসব।
আমি ভাবছিলাম- স্বার্থপরতার এ যুগে যখন বসন্ত হারিয়ে যাচ্ছে, তখন সম্ভবনা ও সম্ভবনার মত নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানো সংগঠনগুলোর জন্য বনটা নিরাপদ থাকবে, বসন্তও আসবে। কথা হলো এ শুভ উদ্যোগগুলোর পাশে আমরা থাকবো কিনা? আমরা কি স্বার্থপর দৈত্য হবো নাকি বসন্তের পক্ষ নেবো?