Published : 01 Jun 2016, 12:33 AM
পাবলিক পরীক্ষার অপর নাম এখন জিপিএ-৫। ছলে বলে কৌশলে পঞ্চ গ্রেডিং পয়েন্ট অর্জনটাই এখন অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা আধিকারিক ও শিক্ষার্থীদের একমাত্র তপস্যা। ফলে পাবলিক পরীক্ষায় বছর বছর বাড়ছে জিপিএ পাঁচ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। তবে এতে শিক্ষার মান বাড়ছে না মোটেও। জিপিএ-৫ শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না জিপিএ মানে কি! বাংলাদেশ সর্ম্পকেও তাদের ধারণা কম। মুখস্থবিদ্যা নির্ভর পড়াশোনা এবং শুধুমাত্র ভাল ফলাফলমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই শিক্ষার্থীদের এ অবস্থা বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। এই নিয়ে গেল ২৯ মে ২০১৬ তারিখে মাছরাঙা টেলিভিশনে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখানো হয়।
আনোয়ার হোসেনের ঐ প্রতিবেদনে ১৩ জন শিক্ষার্থীকে জাতীয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, রাষ্ট্রপতির নাম, রাজধানীর নাম, গণিতের জনকের নাম ইত্যাদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে খুব সাধারণ মাপের কয়েকটি প্রশ্ন করা হলে কোনো শিক্ষার্থীই যথার্থ উত্তর করতে পারেনি। এই সংবাদ থেকে উঠে আসে আমরা জিপিএ-৫ এর নামে আসলে কেমন প্রজন্ম তৈরি করছি। সংবাদটি মাছরাঙা টেলিভিশনের ফেসবুক পেইজে আপলোড করা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠে।
সংবাদটি পরদিন নাট্যব্যক্তিত্ব শুভাশিস ভৌমিক তাঁর নিজের ফেসবুক আইডি থেকে শেয়ার করে স্ট্যাটাস দেন, 'এ কি ভয়াবহ অবস্থা। এ তো বিশ্বাস করাও কঠিন। এই যদি হয় প্রকৃত চিত্র সামনে ভয়াবহ দিন আসছে, আর এইসব কোমলমতি ছাত্রদের ভবিষ্যৎ ভেবে শংকিত হচ্ছি'। সেখানে শেয়ার করা সংবাদটি দেড় মিলিয়নেরও অধিকবার তা দেখা হয়। খবরটি ভাইরাল হয়ে যায়।
কিন্তু বিতর্ক ওঠে সংবাদটি নিয়ে এটিএন বাংলার চিফ এক্সিকিউটিভ এডিটর জ. ই. মামুন এই সংবাদ পরিবেশনের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কড়া সমালোচনামূলক স্ট্যাটাস দেওয়ার পর। 'জিপিএ ফাইভ এবং আমাদের সাংবাদিকতা' শিরোনামের ঐ লেখায় মামুন লিখেন, জিপিএ ফাইভ নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একটি রিপোর্ট নিয়ে ফেসবুকে বেশ হইচই দেখছি দু'দিন ধরে। রিপোর্টটি দেখে সাংবাদিক হিসেবে আমি কিছুটা বিব্রত। সাংবাদিকতার নীতি- নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধ নিয়ে আমার সীমিত সাধ্যের ভেতরে অনেক বছর ধরে অনেক কথা বলছি, বলেছি টেলিভিশনে বা বিভিন্ন ট্রেইনিং/ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই মান হতাশাজনক জায়গাতেই নেমে যাচ্ছে বলে আমি আবারও উদ্বিগ্ন বোধ করছি। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছেলেমেয়েরা জিপিএর মানে জানে না, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কবে জানে না বা নেপালের রাজধানী কোথায় জানে না- এই বিষয়গুলো যেভাবে সংবাদে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সাংবাদিকতার কোন নীতিমালায় পড়ে, আমার জানা নেই। সাংবাদিকরা যদি পথে পথে মানুষকে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নের পরীক্ষা নিয়ে বেড়ান, সেটাকে সাংবাদিকতা বলা যাবে নাকি জনমত জরিপ বলা যাবে তাও আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সাধারণভাবে আমার মনে হয়েছে ওই রিপোর্টের মাধ্যমে বাচ্চাগুলোকে চরম অবমাননা করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, আমাদের সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এমনকি শিক্ষকদেরও একটি বিরাট অংশ এসব প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর দিতে পারবেন না। যে রিপোর্টার এই রিপোর্ট করেছেন, বা যে সম্পাদক এটি দেখেছেন- প্রচার করেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও এসব প্রশ্ন করা হলে ক'জন সঠিক উত্তর দিতে পারেন তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। মামুন তাঁর স্ট্যাটাসে সকলপক্ষকে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করারও অনুরোধ জানান।
এই স্ট্যাটাসের প্রেক্ষিতে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক রউফ রনি তাঁর ফেসবুক আইডিতে লিখেন, যিনি অন্য টেলিভিশনের রিপোর্টার ও এডিটরের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, তাঁর উচিৎ নিজের দিকে আগে আঙ্গুল তোলা। আপনি হলেন সেই গ্রামারের সাংবাদিক যিনি তার সহকর্মী খুনের বিচার দাবিতে ২দিন রাস্তায় নামেননি৷ উল্টা মালিকের ঘুনঘ্রান(গুণগান) গেয়েছেন৷ আপনাদের মত গ্রামারওয়ালা(!)দের জন্যই সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনের বিচার হয় না৷..সাগর রুনীরা ওপারে বসে কাঁদে৷
এমন অবস্থায় জিপিএ-৫ নিয়ে করা ঐ সংবাদটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াবাজরা বস্তুত প্রধান দু'টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ বলছেন, এভাবে শিক্ষার্থীদেরকে অপমান করাটা সাংবাদিকতার নীতি বিরুদ্ধ। আবার কেউ বলছেন, যাদের অযোগ্যতার মাপ এমন সীমাছাড়া, তাদের মুখ ঢাকবার কিছু নাই। কিন্তু কেউ জোর গলায় বলছেন না, বর্তমান শিক্ষানীতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা দপ্তর এবং খোদ শিক্ষামন্ত্রীর কোনো কার্যক্রমই আসলে দেশের শিক্ষাবিস্তারে ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। শুধুমাত্র ভুরিভুরি জিপিএ-৫ পাওয়াকে পরীক্ষায় সাফল্যের মানদন্ড বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থার কোমর ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে, সে খবর কেউ রাখছে না।
এই নিউজে শিক্ষার্থীদের মুখ ব্লার বা ঝাপসা করা বিষয়ে, 'প্রসঙ্গঃ জিপিএ ফাইভ অনুভূতিতে আঘাত' শিরোনামে নিজের ফেসবুক আইডিতে প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক মাসকাওয়াথ আহসান জানিয়েছেন, টিভিতে কোন ধর্ষণ-নির্যাতন-নিগ্রহ-অসম্মানের শিকার মানুষের মুখ ব্লার বা ঝাপসা করে দেয়া প্রচলিত সাংবাদিকতা নৈতিকতা। কিন্তু 'সফল যারা কেমন তারা' বা জিপিএ ফাইভ পাওয়া 'বিজয়ী'-দের চেহারা ঝাপসা করতে হবে কেন! কেউ কোন কিছু না জেনেও সফল হয়েছে; এমন মুখ ঝাপসা করে দিতে হলে তো টকশো'র অনেক আলোচকের চেহারা বা অসংলগ্ন পরস্পরবিরোধী কথা বলা নীতি নির্ধারক ও রাজনীতিকদের চেহারাও ঝাপসা করে দেয়া উচিৎ। কত মুখ ঝাপসা করবে টেলিভিশন!
পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ওদের গড়পড়তা নাগরিকদের সাধারণ জ্ঞানের অভাব তুলে ধরতে ভক্সপপ বা জন সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে সমাজ তার বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যের কথা জানতে পারে। তবে ওদের সমাজের সুবিধা চট করে কেউ হেয় করে না বা কেউ হেয় বোধ করে না। কারণ বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখলে জাতিগতভাবে ভবিষ্যতে হেয় হবার আশংকা থাকে।
সোশ্যাল মিডিয়ার সোশালিস্টরা কেউ আবার পুরনো কাসুন্দি ঘেটেছেন, বিএনপির এক মন্ত্রী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমাদেরকে শেক্সপিয়রের মতো বিজ্ঞানী হতে হবে। আজ থেকে ১৪/১৫ বছর আগে বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রি যদি শেক্সপিয়রকে বিজ্ঞানী বানান, তাহলে আজকে যে ছেলেটি পিথাগোরাসকে উপন্যাসিক বানিয়েছে, তাকে নিয়ে হাসাহাসির কারণ কি? এমন হাসাহাসির ঢলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মূর্খ পন্ডিতের গল্পও শুনিয়েছেন অনেকে, এক পন্ডিত নৌকা পার হচ্ছিলেন। মাঝিকে বলছিলেন, জোয়ার ভাটা কেন হয় জানো? সূর্য কেন ঘুরে জানো? মাঝি কিছুই জানে না। পন্ডিত লোক মাঝিকে মূর্খ বলে হাসাহাসি করছিলেন। একটু পর ঝড় উঠলো। মাঝি বলল, পন্ডিত জি, আপনি সাঁতার জানেন? পন্ডিত সাঁতার জানতেন না। মাঝি তখন বলেছিলো, তাইলে তো আপনার সব জানাই বৃথা।
এতোসব আলোচনা সমালোচনার ভিড়ে আমাদের বক্তব্য একটাই, কোনো প্রশ্নেরই উত্তর না জানা জিপিএ-৫ ওয়ালা ঐ বাচ্চাদের মুখগুলো ঢেকে দিলে হয়ত সংবাদ মূল্যের আশি মন দুধে একফোঁটা চনা থাকত না। তাই বলে কি বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্যতাগুলো ঢাকা পড়ে যেত। যে এসএসসি পাশ বালক-বালিকা জাতীয় দিবস, জাতীয় সঙ্গীত, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধের খবর জানে না, তাদের জ্ঞানগম্যির বহর দেখে সোশালিস্ট সমালোচকদের জাতীয়তাবোধে টান পড়ে না, কষ্ট হয় না? আপনারা শিশুর অপমান নিশ্চয় আলোচনা করবেন, কিন্তু পচনধরা শিক্ষার বিনষ্টি নিয়ে কোনো রাও শব্দ করবেন না? তা কী করে হয়! শিক্ষাবাণিজ্যের নামে দেশে আসলে এখন কীসব ভূতুরে কান্ডকারখানা ঘটছে তা নিয়ে অনেক কথা বলবার আছে, দেখাবারও আছে, যদি আপনি না হন, তোষক, চামচে বা তেলের কারবারি। নিজেদের গায়ে কাদা ছোড়াছুড়ির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের রাষ্ট্রীয় অসঙ্গতিগুলো মাছরাঙা টেলিভিশনের মতো এইভাবে আরো বেশি বেশি উপস্থাপন করাই উচিৎ। এখানে মুখ ব্লার করা না করা, মান অপমানের বিষয়টি নিতান্ত গৌণ বলেই বোধ করি।
আমরা বরং এমনটা ভাবতে পারি, বই না পড়ে, শর্টকাটে হাই গ্রেডে পরীক্ষা পাশের হিড়িকের সাথে এখনকার বেশিরভাগ তরুণদের ট্রেন্ড হলো, যা খুশি তাই করে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হওয়া। এমন অবস্থায় ঐ ১৩ জন শিক্ষার্থী নিজেদের জনপ্রিয়তার টিআরপি'র উত্থান দেখে নিজেদের অজ্ঞতায় বিমর্ষ না হয়ে বরং উৎফুল্লও হতে পারে! আমরাতো আসলে জিপিএ-৫ এর নামে বোধ বিবর্জিত এমন শিক্ষাই সন্তানদের দিচ্ছি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'শিক্ষার হেরফের' প্রবন্ধে বলেছেন, 'ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই, তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে, নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না -বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।
গুটিকয়েক অধ্যবসায়ী বিদ্যার্থীর কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে দিন দিন রবীন্দ্রভাবনার উর্ধ্বেই নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এদের আর এখন না লাগে অত্যাবশ্যকীয় পাঠ, না লাগে স্বাধীন পাঠ। কেবলমাত্র ফেসবুক পাঠ করলেই চলে। পরীক্ষার আগেই ফেসবুকে প্রশ্ন চলে আসে আর পরীক্ষার হলে ডিজিটাল শিক্ষক সব মুশকিল আসান করে দেন। পরীক্ষককে নির্দেশনা দেয়া থাকে ৮০ মার্কস দিতেই হবে। আরামসে চলে আসে গ্রেডিং পয়েন্ট এভারেজ-ফাইভ।
তাই ওদের জন্য যাদের কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে, তাদের উচিৎ এই জাতিকে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সেই ফাটা বুকে একফালি জায়গা রাখা। নইলে জাতীয়ভাবে আমাদের অনিবার্য পতনের অশনি সংকেতটাকে সামাল দেয়াটা অসম্ভব ছাড়া আর কিছুই হবে না।
জিপিএ-৫ নিয়ে হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গায় সাংবাদিক সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি খুনের একমাত্র অব্যাহত প্রতিবাদকারী প্রতিষ্ঠান মাছরাঙা টেলিভিশনের গলদ খুঁজবার আগে, এখানকার রিপোর্টার ও সম্পাদকদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবার আগে দয়া করে শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গন্ধ দূরীকরণের পথ বাতলানোর বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলের ঝড় তুলুন।
সাংবাদিকতার 'এথিক' এর দোহাই তোলে শিক্ষার্থীর অপমানকে অগ্রাধিকার দিয়ে টোটাল শিক্ষাব্যবস্থার নোংরা ঢাকবেন না প্লিজ। আমাদের মেধাবী ও সুন্দর কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের আনন্দধারায় মাতিয়ে দিতে প্রকৃত শিক্ষা অন্বেষণের মাধ্যমে কবিগুরু'র ভাষায় মুক্তি খুঁজবার দিশা দিন।
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে ॥
আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।
শিক্ষার অবক্ষয় বিষয়ে এই লেখকের আরেকটি নিবন্ধঃ